জালালাবাদের যুদ্ধ (১৯৮৯)
জালালাবাদের যুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: আফগান গৃহযুদ্ধ (১৯৮৯–১৯৯২) | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
সমর্থক: সোভিয়েত ইউনিয়ন |
মুজাহিদিন:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
মোহাম্মেদ ফাহিম আব্দুল রাশিদ দোস্তাম নূর-উল-হক উলুমি |
আব্দুল রসুল সায়েফ গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার হামিদ গুল | ||||||
শক্তি | |||||||
১৫,০০০ সৈন্য | ~১০,০০০ যোদ্ধা | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
অজ্ঞাত | ~৩,০০০ যোদ্ধা নিহত[১] | ||||||
১২,০০০–১৫,০০০ বেসামরিক মানুষ নিহত |
জালালাবাদের যুদ্ধ ১৯৮৯ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত আফগানিস্তানের জালালাবাদে আফগান কমিউনিস্ট সরকার এবং পাকিস্তান-সমর্থিত মুজাহিদ দলগুলোর মধ্যে সংঘটিত হয়। যুদ্ধের প্রথমদিকে মুজাহিদ যোদ্ধা ও পাকিস্তানি সৈন্যরা সাফল্য অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত তারা শোচনীয়ভাবে আফগান সরকারি বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়।
নিয়মিত যুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের অপারদর্শিতা ও অনভিজ্ঞতা এবং আফগান সরকারি বাহিনী কর্তৃক স্কাড ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার ছিল এই যুদ্ধে মুজাহিদদের পরাজয়ের মূল কারণ। জালালাবাদের যুদ্ধে মুজাহিদদের শোচনীয় পরাজয় তাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকে প্রকটিত করে তোলে ও তাদের মনোবল হ্রাস করে[২]। অন্যদিকে, সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর মনোবল হারিয়ে ফেলা আফগান সরকার ও তাদের সমর্থকদের আত্মবিশ্বাস এই সাফল্যের পর বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
পটভূমি
[সম্পাদনা]১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ সোভিয়েত সৈন্যদল প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কিন্তু ১৯৮৯ সালের বসন্তকাল পর্যন্ত আফগান সরকারের পতনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় নি। এজন্য কিছু মুজাহিদ দলের মার্কিন ও পাকিস্তানি সমর্থকরা আফগান সরকারের পতন ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ওকলে এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর চাপে জালালাবাদ শহরটি দখল করার জন্য একটি পরিকল্পনা করা হয়। মার্কিন ও পাকিস্তানি উভয় পক্ষই নিজ নিজ কারণে নিয়মিত যুদ্ধে একটি বিজয় অর্জন করতে চাইছিল। মার্কিনরা মার্ক্সবাদীদের আফগানিস্তান থেকে "হেলিকপ্টারে করে" পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে চাইছিল, যার মাধ্যমে তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতনের প্রতিশোধ নিতে চাইছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তান তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন সোভিয়েত সমর্থনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চাইছিল। এই যুদ্ধের পর পাকিস্তান গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বে জালালাবাদকে অস্থায়ী রাজধানী করে একটি নতুন আফগান সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছিল[৩]। পাকিস্তান-সমর্থিত আফগান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের প্রধানমন্ত্রী এবং আব্দুল রসুল সায়েফের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ লাভ করার কথা ছিল। এই আক্রমণের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুল।
যুদ্ধ
[সম্পাদনা]শক্তিমত্তা
[সম্পাদনা]জালালাবাদ আক্রমণের জন্য গঠিত মুজাহিদ বাহিনীতে যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১০,০০০। হেকমতিয়ারের হেজব-এ-ইসলামি গুলবুদ্দিন, আব্দুল রসুল সায়েফের ইত্তিহাদ-ই-ইসলামি এবং আরব স্বেচ্ছাসেবকরা এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একাদশ কোরের ৪০তম ডিভিশনের কিছু সৈন্য এবং আইএসআই-এর উপদেষ্টারা মুজাহিদদের সঙ্গে ছিল।
আক্রমণ
[সম্পাদনা]১৯৮৯ সালের ৫ মার্চ মুজাহিদরা জালালাবাদ আক্রমণ করে। আক্রমণের প্রথমদিকে মুজাহিদরা সাফল্য অর্জন করে এবং জালালাবাদ বিমানঘাঁটি দখল করে নেয়[৪]:১৩৮। কিন্তু আফগান সরকারি সৈন্যরা আত্মসমর্পন করতে আরম্ভ করলে হেকমতিয়ার ও সায়েফের বাহিনীর যোদ্ধারা নিরস্ত্র জনসাধারণের সঙ্গে যুদ্ধবন্দিদের ওপরও নির্যাতন চালায় এবং হত্যা করে। এর ফলে কমিউনিস্টদের পক্ষে আত্মসমর্পণ অসম্ভব হয়ে ওঠে এবং তারা দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করে।
যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন বা
[সম্পাদনা]আক্রমণকারী মুজাহিদ বাহিনী শীঘ্রই আফগান সেনাবাহিনীরা ১১তম ডিভিশনের মূল অবস্থানগুলোর সম্মুখীন হয়, যেগুলো পরীক্ষা, কাঁটাতার এবং মাইনফিল্ড দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। সরকারি সৈন্যরা বিস্তৃত বিমান সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে পারত, কারণ আফগান বিমানবাহিনী প্রতিদিন যুদ্ধক্ষেত্রে মুজাহিদদের ওপর গড়ে ২০টি করে আক্রমণ পরিচালনা করে। আফগানরা আন্তোনভ এএন-১২ পরিবহন বিমানকে বোমা বহনকারী বিমানে পরিণত করে এবং মুজাহিদদের ব্যবহৃত এফআইএম-৯২ স্টিঞ্জার ক্ষেপণাস্ত্রের আওতার বাইরে অনেক উঁচু থেকে বোমাবর্ষণ করে; গুচ্ছবোমাও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়[৪]:১৩৯।
কাবুলের আশেপাশে মোতায়েনকৃত তিনটি স্কাড নিক্ষেপক ব্যাটারি জালালাবাদে আফগান সৈন্যদের সমর্থনে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ৪০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো লক্ষ্যভেদের মাত্রা কম হলেও এগুলো মুজাহিদদের মনোবলের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে, কারণ তারা এই আক্রমণের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারত না[৫]।
মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুজাহিদরা জালালাবাদের সরকারি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করতে পারে নি এবং তাদের গোলাবারুদ দ্রুত শেষ হয়ে আসছিল। জুলাইয়ে আফগান সৈন্যবাহিনী কর্তৃক সামারখেল দখল তারা প্রতিরোধ করতে পারে নি এবং জালালাবাদ তখনও দৃঢ়ভাবে নাজিবুল্লাহ সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে এই যুদ্ধে মুজাহিদদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।
ক্ষয়ক্ষতি
[সম্পাদনা]জালালাবাদের যুদ্ধের সময় প্রায় ৩,০০০ মুজাহিদ যোদ্ধা নিহত হয়[১]। এছাড়া যুদ্ধ চলাকালে প্রায় ১২,০০০–১৫,০০০ বেসামরিক আফগান নিহত হয় এবং আরো ১০,০০০ বেসামরিক আফগান যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে পালিয়ে যায়[৬]।
ফলাফল
[সম্পাদনা]মার্কিন ও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের আশাকে ভঙ্গ করে দিয়ে এই যুদ্ধ প্রমাণ করে দেয় যে, আফগান সৈন্যবাহিনী সোভিয়েতদের সহায়তা ছাড়া যুদ্ধ করতে সক্ষম। এই যুদ্ধে বিজয় লাভের ফলে আফগান সরকারের সমর্থকদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। অন্যদিকে, আক্রমণে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদদের মনোবল হ্রাস পায় এবং হেকমতিয়ার ও সায়েফের বাহিনীদ্বয়ের অনেক স্থানীয় কমান্ডার আফগান সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করে[২]। আইএসআই কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মেদ ইউসুফের মতে, জিহাদ জালালাবাদ থেকে কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারে নি[৫]। বিশেষত হেকমতিয়ারকে ক্ষমতায় বসানোর পাকিস্তানি পরিকল্পনা এ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের ফলাফলে পাকিস্তানি ও মার্কিন উভয় সরকারই হতাশ হয়ে পড়ে। এই ব্যর্থতার জন্য পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো জেনারেল হামিদ গুলকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করেন এবং জেনারেল শামসুর রহমান কাল্লুকে আইএসআই-এর নতুন মহাপরিচালক নিযুক্ত করেন। কাল্লু আফগান গেরিলাদের সহায়তার ক্ষেত্রে একটি অধিকতর সংযত নীতি গ্রহণ করেন[৫]। তার পূর্বসূরি আখতার আব্দুর রহমান এবং হামিদ গুল মুজাহিদ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে যে বাধা স্থাপন করেছিলেন, তিনি তা দূর করেন। ফলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রথম বারের মতো আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে।
বিভিন্ন মুজাহিদ নেতার প্রতিক্রিয়া
[সম্পাদনা]স্থানীয় সমালোচনা
[সম্পাদনা]জালালাবাদ অভিযানকে আহমদ শাহ মাসুদ এবং আব্দুল হকের মতো মুজাহিদ নেতারা একটি মারাত্মক ভুল হিসেবে অভিহিত করেন। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, নিয়মিত যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো বড় শহর দখল করার সামর্থ্য মুজাহিদদের নেই[৭]। মাসুদ বা হক কেউই জালালাবাদ আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন নি। এমনকি মাসুদ এটিও দাবি করেন যে, তিনি বিবিসি রেডিও থেকে প্রথম এই অভিযানের খবর জানতে পারেন[৮]। হক সমন্বিত গেরিলা যুদ্ধ চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন, যার ফলে কমিউনিস্ট সরকার ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এর পতন ঘটবে। হক এই প্রশ্নও তোলেন যে: এটা কিরকম যে আমরা আফগানরা, যারা কখনো একটি যুদ্ধেও হারি নি, অবশ্যই পাকিস্তানিদের কাছ থেকে সামরিক নির্দেশনা নেব, যারা কখনো একটি যুদ্ধেও জেতে নি[৬]? আহমদ শাহ মাসুদ পাকিস্তান ও পাকিস্তানের অনুসারী আফগান মুজাহিদদের একাকী যুদ্ধ চালানোর মনোভাবের সমালোচনা করে বলেন: আমাদের একটি যৌথ কমান্ড না থাকার ক্ষতি সুস্পষ্ট। এখানে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই, যার অর্থ আমরা একই সঙ্গে বিভিন্ন রণাঙ্গনে আক্রমণ চালাচ্ছি না। এর ফলে সরকার তাদের শক্তি জড়ো করতে পারে এবং এক এক করে আমাদের বেছে নিতে পারে। জালালাবাদে এটিই ঘটেছে[৮]।
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Marshall, p.7
- ↑ ক খ "Rebels without a cause"। PBS। ১৯৮৯-০৮-২৯। ২০১২-১১-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৭-২৭।
- ↑ Kaplan, p.178
- ↑ ক খ Wright, Lawrence (২০০৬)। The Looming Tower: Al-Qaeda and the Road to 9/11। New York: Random House। আইএসবিএন 9780375414862।
- ↑ ক খ গ Yousaf, Mohammad; Adkin, Mark। "Afghanistan – The bear trap – Defeat of a superpower"। sovietsdefeatinafghanistan.com। ২০০৭-১০-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৭-২৭।
- ↑ ক খ Roy Gutman (২০০৮)। How We Missed the Story: Osama Bin Laden, the Taliban and the Hijacking of Afghanistan (January 15, 2008 সংস্করণ)। United States Institute of Peace Press। পৃষ্ঠা 304। আইএসবিএন 1-60127-024-0।
- ↑ Kaplan, Robert D. (2001); Soldiers of God: With Islamic Warriors in Afghanistan And Pakistan; Vintage Departures; আইএসবিএন ১-৪০০০-৩০২৫-০, p.166
- ↑ ক খ "Afghanistan – the Squandered Victory"। BBC। ১৯৮৯।