জার্মপ্লাজম মতবাদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অগাস্ট ভাইজম্যান ১৮৯২ সালে জার্মপ্লাজম মতবাদ দিয়েছিলেন। জার্মপ্লাজম হলো বংশগতীয় উপাদান যা জননাঙ্গের (Gonad) শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে বাহিত হয়।
অগাস্ট ভাইজম্যান - আধুনিক জিনতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপনের পূর্বেই যিনি ১৯ শতকে জার্মপ্লাজম সোমাটোপ্লাজম মতবাদ প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি নব্য-ডারউইনবাদের জনক।

জার্মপ্লাজম (জার্মান: কেমপ্লাজমা) মতবাদ হলো একটি জৈবিক ধারণা যা ১৯ শতকে জার্মান জীববিজ্ঞানী অগাস্ট ভাইজম্যান প্রকাশ করেছিলো। জার্মপ্লাজম মতবাদ অনুসারে, বংশগত তথ্য বা বৈশিষ্ট্য শুধু গোনাডের (ডিম্বাশয় এবং শুক্রাশয়) জার্ম কোষ দ্বারা সঞ্চারিত হয় কিন্তু দেহকোষ দ্বারা সঞ্চারিত হয় না। বংশগত বৈশিষ্ট্য দেহকোষ থেকে জার্মলাইনে সঞ্চারিত হতে পারে না। এই মতবাদ ল্যামার্কবাদের সাথে সাংঘর্ষিক, যাকে ভাইজম্যান বাধা বলা হয়। এই তত্ত্বটি আধুনিক জিনতত্ত্বের বিকাশে অবদান রেখেছে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

কেমপ্লাজমা (জার্মপ্লাজম) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন জার্মান জীববিজ্ঞানী অগাস্ট ভাইজম্যান (১৮৩৪-১৯১৪)। ১৮৮৩ সালে তিনি জার্মপ্লাজম মতবাদ প্রস্তাব করেন। পরবর্তীতে ১৮৯২ সালে তার লেখা জার্ম প্লাজম: একটি বংশানুক্রম তত্ত্ব (জার্মান:Das Keimplasma: eine Theorie der Vererbung; ইংরেজি:Germ Plasm: A Theory of Inheritance) বইয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। [১]

অগাস্ট ভাইজম্যানের তত্ত্ব অনুযায়ী, বহুকোষী জীব জার্মকোষ নিয়ে গঠিত, যা বংশগত তথ্য ধারণ করে এবং প্রেরণ করে। অন্যদিকে, দেহকোষ সাধারণ শারীরিক কাজ সম্পাদন করে। [১][২] জার্মপ্লাজম তত্ত্বে, একটি বহুকোষী জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্য শুধু গোনাডের (ডিম্বাশয় এবং শুক্রাশয়) জার্ম কোষ দ্বারা সঞ্চারিত হয় কিন্তু দেহকোষ দ্বারা সঞ্চারিত হয় না। সুতরাং দেহকোষ বংশগতির বাহক হিসাবে কাজ করে না।

জার্মকোষ (কার্যকরভাবে, জিন) দেহকোষ উৎপাদন করতে পারে যার প্রভাব একমুখী। অর্থাৎ জার্মকোষ দেহকোষ উৎপাদন করতে পারে কিন্তু দেহকোষ জার্মকোষ উৎপাদন করতে পারে না। জার্মকোষগুলো আরও জার্মকোষ এবং দেহকোষ তৈরি করতে পারে; জার্মকোষগুলো- শারীরিক বৃদ্ধি বা দেহকোষ, কোনো কিছু দ্বারাই প্রভাবিত হয় না। ফলে জিনগত তথ্য দেহকোষ থেকে জার্মপ্লাজমে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঞ্চারিত হতে পারে না। যাকে ভাইজম্যান বাধা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। [৩] যদি এই ধারণাটি সত্য হয় তাহলে জঁ-বাতিস্ত লামার্ক প্রস্তাবিত অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার তত্ত্বকে বাতিল করে দেওয়া হয়। অন্যদের মতো চার্লস ডারউইন ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস বইয়ে এবং বংশানুক্রম তত্ত্ব বা প্যানজেনেসিস তত্ত্বের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। [৪]

যাইহোক,অগাস্ট ভাইজম্যানের পুরো কর্মজীবনবৃত্তান্ত পড়লে বোঝা যায়, কাজের প্রতি ভাইজম্যানের সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো। তিনি ডারউইনের মতোই জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, বংশগতির ভিন্নতা বা প্রকরণ ঘটাতে একটি পরিবর্তনশীল পরিবেশ প্রয়োজন। [২] দেহকোষ এবং জার্মপ্লাজমের উপর বিভিন্ন বাহ্যিক প্রভাব বিস্তার করে। এই বাহ্যিক অবস্থার জন্য তিনি বিশ্বাস করেন যে, বংশগত বৈশিষ্ট্য দেহকোষ থেকে জার্মপ্লাজমে যেতে পারে না। যার কারণে বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ রাসমাস জি উইনথার বলেন, ভাইজম্যান একজন ভাইজম্যানিয়ান ছিলেন না, কারণ তিনি ডারউইনের মতো অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকারে বিশ্বাস করতেন, যা পরবর্তীতে ল্যামার্কিয়ান নামে পরিচিতি লাভ করে। [২]

ভাইজম্যানের তত্ত্বের যে অংশটি সবচেয়ে দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য প্রমাণিত হয়েছিল তা হলো যে, সোমাটিক বা দেহকোষের বিভাজনের সময় জার্মপ্লাজম (কার্যকরভাবে, জিন) ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পায়। আধুনিক জিনতত্ত্ব বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই ধারণাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল। [৫]

জার্মান বিজ্ঞানী অগাস্ট ভাইজম্যান ইঁদুর নিয়ে গবেষণাকালে কিছু পুরুষ ও স্ত্রী ইঁদুরের লেজ কেটে বাক্সে ছেড়ে দেন। এদের মিলনে যেসব ইঁদুর জন্মে তাদের সবগুলোর লেজ ছিলো স্বাভাবিক। এভাবে ২২ প্রজন্ম (জেনারেশন) পর্যন্ত ইঁদুরের লেজ কেটে পরীক্ষা করে প্রমাণ করেন যে, লেজকাঁটা কোনো ইঁদুরের জন্ম হয়নি। এভাবে তিনি ল্যামার্কের বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। ক্লোন করা ডলি (ভেড়া) এর মতো ঘটনা, যা দেহকোষের দেহকোষের নিউক্লিয়ার স্থানান্তরের নিউক্লিয়ার স্থানান্তরের মাধ্যমে প্রমাণিত যে, প্রাপ্তবয়স্ক কোষসমূহ সম্পূর্ণ তথ্যের সেট ধরে রাখে – এই তথ্য ভাইজম্যানের জিনগত তথ্যের ক্রমবর্ধমান বিলুপ্তি হয় মতবাদের সাথে সাংঘর্ষিক। ধারাবাহিক ক্ষতির বিপরীতে - ভাইজম্যানের তত্ত্বের অন্যান্য দিকগুলো মেটাজোয়ান (Metazoa) বিকাশের জন্য একটি সাধারণ নিয়ম হিসাবে বিবেচিত হয়। যাইহোক, দেহকোষের জিনোম প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্রাণীদের কিছু গ্রুপের দেহকোষ দ্বারা জেনেটিক তথ্য (জিনগত বৈশিষ্ট্য) সহজেই হারিয়ে যায়। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো নেমাটোডা পর্বের প্রাণী, যেখানে ক্রোমাটিন হ্রাসের ঘটনাটি ১৮৮৭ সালে থিওডোর বোভারি দ্বারা প্রথম বর্ণনা করা হয়েছিল। [৬]

ধারণাটি কিছুটা প্রত্যাশিত ছিল ফ্রান্সিস গ্যালন এর একটি ১৮৬৫ সালের প্রবন্ধে, যা ম্যাকমিলান'স ম্যাগাজিন-এ প্রকাশিত হয়েছিলো, যা ধারণাটির একটি দুর্বল সংস্করণ নির্ধারণ করেছিল। ১৮৮৯ সালে অগাস্ট ভাইজম্যান স্বীকার করে লিখেছিলেন যে, "আপনি আপনার গবেষণাপত্রে এমন একটি ধারণা প্রকাশ করেছেন যা একটি অপরিহার্য বিন্দুতে প্রায় আমার জার্ম-প্লাজমের ধারাবাহিকতার তত্ত্বের মূল ধারণার সাথে যুক্ত"।

আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি[সম্পাদনা]

ভাইজম্যান বাধার ধারণা, যেমন একটি জীবের জীবনকালে অর্জিত পরিবর্তনগুলি তার বংশকে প্রভাবিত করতে পারে না, যা এখনও ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। এটিকে জীববিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় প্রত্যয় হিসাবে আণবিক পরিভাষায় প্রসারিত করা হয়েছে। যা দাবি করে যে, প্রোটিন আকারে লেখা তথ্য নিউক্লিক অ্যাসিডে এনকোড করা জেনেটিকালি ট্রান্সমিসিবল তথ্যে ফেরত দেওয়া যায় না। [৭]

ভাইসম্যানিয়ান ধারণা যে, জীবাণু কোষগুলি দেহকোষ বা তাদের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় না; তবে এটি পরম সত্য বলে প্রমাণিত না। নিউক্লিওটাইড ক্ষারের রাসায়নিক পরিবর্তন যা জেনেটিক কোড গঠন করে যেমন সাইটোসিন এর পরিবর্তন এবং সেই সাথে হিস্টোন এর পরিবর্তন যার চারপাশে ডিএনএ সংগঠিত হয় উচ্চ-ক্রম কাঠামোতে জীবের বিপাকীয় এবং শারীরবৃত্তীয় অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে বংশগত হতে পারে। এই ধরনের পরিবর্তনগুলিকে অধিবংশাণুবিজ্ঞান বলা হয় কারণ তারা নিউক্লিওটাইড ক্রম পরিবর্তন করে না। [৮]

নব্য-ডারউইনবাদ[সম্পাদনা]

ডারউইনের মতবাদ প্রকাশ হওয়ার দেড়শ বছরেরও বেশি সময় পর, অগাস্ট ভাইজম্যান ও তার অনুগামীরা মিলে ডারউইনের মতবাদের দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে নতুন জ্ঞানের আলোকে সবল করে তোলে। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের এ নবমূল্যায়কে নব্য-ডারউইনবাদ (Neo-Darwinism) বলা হয়।

অগাস্ট ভাইজম্যানের গবেষণা থেকে প্রমাণিত যে, জীবদেহে পরিবেশ থেকে উদ্ভূত বাহ্যিক প্রভাব বংশানুসৃত হয় না। তিনি ২২ প্রজন্ম ইঁদুর ছানার লেজ কেটে পরীক্ষা করেন কিন্তু কোনো প্রজন্মে লেজের দৈর্ঘ্য কমতে দেখেননি।

১৮৯২ সালে Das Keimplasma (1892; The Germ-Plasm: A Theory of Heredity) বইয়ে অগাস্ট ভাইজম্যান তাঁর জার্মপ্লাজম-সোমাটোপ্লাজম (Germplasm-Somatoplasm) তত্ত্বে উল্লেখ করেন যে,

  • জীবের জননাঙ্গে উপস্থিত জননকোষে থাকে জার্মপ্লাজম,
    • আর দেহের অবশিষ্ট কোষে (Somatic Cell) থাকে সোমাটোপ্লাজম।
  • পরিবেশের প্রভাবে সোমাটোপ্লাজমে (দেহকোষ) পরিবর্তন ঘটলেও, জার্মপ্লাজমে কোনো পরিবর্তন নাও ঘটতে পারে।
  • শুধু সোমাটোপ্লাজমে সংঘটিত পরিবর্তন বংশগতি লাভে সামর্থ হয় না।
  • পরিবেশের সব প্রত্যক্ষ প্রভাব বিবর্তনের শর্ত নয়।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Weismann, August (১৮৯২)। Das Keimplasma: eine Theorie der Vererbung। Jena: Fischer। 
  2. Winther, Rasmus G. (২০০১)। "August Weismann on Germ-Plasm Variation"। Journal of the History of Biology34 (3): 517–555। আইএসএসএন 0022-5010জেস্টোর 4331686 
  3. Germ-Plasm, a theory of heredity (1893)
  4. Huxley, Julian (১৯৪২)। Evolution, the Modern Synthesis। পৃষ্ঠা 17জেস্টোর 4331686 
  5. For example, by studies of polytene chromosomes in salivary glands (i.e. somatic cells) of larval Drosophila.
  6. Streit, Adrian (নভেম্বর ২০১২)। "Silencing by Throwing Away: A Role for Chromatin Diminution"। Developmental Cell25 (5): 918–919। ডিওআই:10.1016/j.devcel.2012.10.022অবাধে প্রবেশযোগ্যপিএমআইডি 23153488 
  7. Turner, J. Scott (২০১৩)। Henning, Brian G.; Scarfe, Adam Christian, সম্পাদকগণ। Biology's Second Law: Homeostasis, Purpose, and DesireBeyond Mechanism: Putting Life Back Into Biology। Rowman and Littlefield। পৃষ্ঠা 192। আইএসবিএন 978-0-7391-7436-4Where Weismann would say that it is impossible for changes acquired during an organism's lifetime to feed back onto transmissible traits in the germ line, the CDMB now added that it was impossible for information encoded in proteins to feed back and affect genetic information in any form whatsoever, which was essentially a molecular recasting of the Weismann barrier. 
  8. Berger, S. L.; Kouzarides, T.; Shiekhattar, R.; Shilatifard, A. (২০০৯)। "An operational definition of epigenetics"Genes & Development23 (7): 781–83। ডিওআই:10.1101/gad.1787609পিএমআইডি 19339683পিএমসি 3959995অবাধে প্রবেশযোগ্য