গুড়পুকুরের মেলা
গুড়পুকুরের মেলা বা গুড়পুকুর মেলা, বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা, যা প্রায় ৩০০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয় বলে অনুমিত করা হয়। সাধারণত এলাকার পলাশপোল স্কুলের মাঠ আর পলাশপোল গ্রামই হলো মেলার মূল কেন্দ্রস্থল।[১] বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনসা পূজাকে কেন্দ্র করে এই মেলা একমাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়।[২]
বিবরণ
[সম্পাদনা]বাংলার আবহমান কালের সকল গ্রাম্য মেলার মতোই এই মেলায়ও বিভিন্ন জিনিসের পসরা বসে। কাঠ, মাটি, বাঁশ, বেত আর লোহার সামগ্রীতে ঠাসা এই মেলার প্রধান আকর্ষণ থাকে সাতক্ষীরার নানা প্রজাতির কলম-করা-গাছগাছড়া।[৩] ঢাকা, ফরিদপুর, বাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসেন স্টেশনারী পণ্যের বিক্রেতারা। কলম-করা-চারা আর আসবাবপত্র ছাড়াও মেলায় থাকে শিশুদের বিভিন্ন খেলনা; থাকে বিভিন্ন মৌসুমী ফল, থাকে গৃহস্থালী উপকরণ (ঝুড়ি, ধামা, কুলা, বাটি, দেলকো, শাবল, খোন্তা, দা, ছুরি, কোদাল প্রভৃতি)।[১] এছাড়া বিনোদনের জন্য থাকে নাগোরদোলাসহ বিভিন্ন আয়োজন; সার্কাস, যাদু প্রদর্শনী, পুতুল নাচ[৪] এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। একসময় কলকাতা, ও লন্ডন থেকে ব্যবসায়ীরা এই মেলায় আসতেন।[৫]
বর্তমানে (২০১০) সাতক্ষীরা পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসবকে কেন্দ্র করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হলেও সাতক্ষীরা শহরবাসীর জন্য এই মেলা হয়ে উঠছে গরিব-ধনী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক মিলনমেলা।
মেলায় অশ্লীল নৃত্য, জুয়া খেলা, হাউজি ও লটারি খেলাকে স্থানীয় প্রশাসন নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি যাত্রাও সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।[৪]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]প্রতিবছর বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ভাদ্র মাসের শেষদিনে অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মনসা পূজা। এই পূজাকে কেন্দ্র করে ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই 'গুড়পুকুরের মেলা'।[২] তবে কে বা কারা মেলাটির গোড়াপত্তন করেছিলেন তার কোনো ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায় না।
তবে জনশ্রুতি রয়েছে শহরের পলাশপোলে একটি গোলাকৃতির পুকুরের পাড়ে বট গাছের নিচে একবার এক ক্লান্ত পথিক বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। গাছের ফাঁক দিয়ে আসা রোদ পথিকের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলো দেখে এসময় একটি বিষধর সাপ ফণা তুলে তাকে ছায়া দেয়। পথিক এই দৃশ্য দেখে [হিন্দু ধর্মমতানুসারে] মনসার উদ্দেশ্যে পূজা দেওয়া শুরু করেন অথবা এলাকার লোকজনকে মনসা পূজা করতে বলেন।[ক] এই পূজার মিষ্টি প্রসাদ পুকুরে ফেলে দেওয়ায় পুকুরের পানি মিষ্টি হয়ে যায়। এই বিশ্বাস থেকে গোলাকৃতি পুকুরের নাম হয়ে যায় গুড়পুকুর। সেই থেকে শুরু হয় গুড়পুকুরের মেলা। এলাকার প্রবীণেরা তাদের বাল্যকাল থেকেই এ মেলা দেখে আসছেন বলে জানা যায়।[৩]
তবে গুড়পুকুর নামকরণের অন্যান্য অভিমতও রয়েছে, যেমন: কারো মতে পুকুরে মনসা পূজার বাতাসা ফেলা হতো আর ঐ বাতাসার জন্য পুকুরের পানি মিষ্টি লাগতো বলেই এধরনের নামকরণ। কারো মতে, পুকুরটিতে পানি থাকতো না বেশিদিন; পরে স্বপ্নে দেখা গেলো পুকুরে ১০০ ভাড় গুড় ঢালতে হবে, আর সেমতে কাজ করার ফলেই পুকুরে পানি এলো, তাই এই নামকরণ। আবার শোনা যায়, পুকুরের তলদেশ থেকে একসময় মিষ্টি পানি উঠতো বলে এমন নামকরণ। কারো মতে পুকুরের পাড়ে একসময় প্রচুর খেজুর গাছ হতো। একবার সব গাছের রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুড় তৈরি করে তার বিক্রীত মূল্যে খনন করা হয় এই পুকুর। আর সেই থেকেই এই পুকুরের নাম গুড়পুকুর। তবে ঐতিহাসিক আবদুস সোবহান খান চৌধুরীর মতে, চৌধুরীপাড়ার রায় চৌধুরীরা গৌরবর্ণের ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাই তাদের পুকুরকে বলা হতো গৌরদের পুকুর। সেই 'গৌরদের পুকুর'-ই কথার বিবর্তনে হয়ে যায় 'গুড়পুকুর'।[১]
মেলাটি আবহমান কাল ধরে চলে এলেও ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর মেলা চলাকালে শহরের একটি সিনেমা হল আর সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে সার্কাসের প্যান্ডেলে বোমা হামলা করে জঙ্গীরা। এই ঘটনায় ৩ জন নিহত হয়, আহত হয় শতাধিক নারী-পুরুষ আর শিশু। এর ফলে ৬ বছর ধরে মেলা পরিচালনার অনুমতি না পাওয়ায় মেলা বন্ধ ছিলো। অবশেষে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে আবার শুরু হয় এই মেলা। মেলা সাধারণত এক মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হলেও ঐবছর মেলা ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়।[২]
পাদটীকা
[সম্পাদনা]- ^ ঐতিহাসিক আবদুস সোবহান খান চৌধুরী লিখেছেন, ‘অনেক পথ হেঁটেছেন’ আজ ক্লান্তিতে পা আর উঠতে চায় না। শেষ ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে মিইয়ে এসেছে সমস্ত শরীর। ওই যে গৌরদের পুকুরপারের বটগাছটা ওর ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেয়া যাক। বটের ছায়ায় বসতে না বসতেই ঘুম এসে গেল ফাজেলের, শেকড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। ...বটের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তীব্র রশ্মি এসে পড়লো ফাজেলের মুখে। ঘুম ভেঙে যেতে লাগলো। অস্বস্তিবোধ করলেন তিনি। মগডালে বসেছিল এক পদ্মগোখরো সাপ। সে তা লক্ষ্য করলো এবং নেমে এলো নিচে, যে পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মি এসে ফাজেলের মুখে পড়েছে ঠিক সেখানে। ফণা তুলে দাঁড়ালো সাপটা। ফণার ছায়া এসে পড়লো ফাজেলের মুখে। তিনি আরাম পেয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার পর আবার ঘুম ভেঙে গেলো। এর মধ্যে ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেছে। বটের পাতায় পাতায় দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন সেই সাপটিকে। তখনও সে ফণা তুলে সূর্যকে আড়াল করে আছে। এবার ফণাটা একটু দুলে উঠলো, দুলে উঠলো গাছের পাতারা। তখন তার চোখে ঘুমের রেশমাত্র নেই। শরীরে নেই একবিন্দু ক্লান্তি। ফাজেল বটতলা ত্যাগ করলেন এবং এলাকার হিন্দুদের ডেকে বললেন, ‘এখানে তোমরা মনসা পূজা কর’।[১]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ "জেলার ঐতিহ্য: গুড়পুকুর মেলা"। ওয়েব। সাতক্ষীরা জেলা তথ্য বাতায়ন। ১১ জুলাই ২০১০ তারিখে মূল (ওয়েব) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ ডিসেম্বর ২০১০।
- ↑ ক খ গ নিজস্ব প্রতিবেদক (২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯)। "ছয় বছর পর আবার গুড়পুকুরের মেলা"। দৈনিক প্রথম আলো (প্রিন্ট) । ঢাকা। পৃষ্ঠা ২৪।
- ↑ ক খ মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১০)। "সাতক্ষীর গুড়পুকুরের মেলা শুরু শুক্রবার" (ওয়েব)। বাংলানিউজ২৪.কম। ঢাকা। সংগ্রহের তারিখ ২ ডিসেম্বর ২০১০।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ সাতক্ষীরা প্রতিনিধি (১৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)। "সাতক্ষীরায় শুরু হয়েছে গুড়পুকুরের মেলা" (ওয়েব)। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন। ঢাকা। সংগ্রহের তারিখ ২ ডিসেম্বর ২০১০।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ নিজস্ব প্রতিবেদক (২৬ সেপ্টেম্বর ২০১০)। "সাতক্ষীরায় গুড়পুকুরের মেলা শুরু" (ওয়েব)। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। সংগ্রহের তারিখ ২ ডিসেম্বর ২০১০।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- সাতক্ষীরা জেলা তথ্য বাতায়নে গুড়পুকুরের মেলা সংক্রান্ত তথ্য