গণচীনে তিব্বতের অন্তর্ভুক্তি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

গণচীনে তিব্বতের অন্তর্ভুক্তি বলতে গণ প্রজাতন্ত্রী চীন দ্বারা বর্তমান তিব্বত স্বয়ংশাসিত অঞ্চলকে অধিগ্রহণকে বোঝানো হয়। তিব্বত সরকার দ্বারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিলাভ ও সেনাবাহিনী আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা, চীনের সঙ্গে তিব্বতের মধ্যস্থতা, চামদোর যুদ্ধ এবং তিব্বতের শান্তিপূর্ণ মুক্তির সতেরো দফা চুক্তি স্বাক্ষরের পর এই অধিগ্রহণ হয়। চীনের শাসনাধীনে তিব্বতের সরকার ও সামাজিক গঠন অপরিবর্তিত থাকলেও ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের তিব্বতী বিদ্রোহের পর চতুর্দশ দলাই লামা ভারত পালিয়ে গেলে তিব্বত সরকারকে লোপ করে দেওয়া হয়।

প্রেক্ষাপট[সম্পাদনা]

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে ত্রয়োদশ দলাই লামা ভারত থেকে যাত্রা করে লাসা শহরে প্রবেশ করে ১২ই ফেব্রুয়ারি চীনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে তিব্বতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন।[১] কিন্তু তিব্বতী সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণের ব্যাপারে ত্রয়োদশ দলাই লামার প্রচেষ্টা তিব্বতের শক্তিশালী অভিজাত ও লামা সম্প্রদায়ের বিরোধিতায় সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হয়।[২]:১১৯-১২২[৩]:৫,১১[৪]:৩৪,৩৫[৫]:৪৮ ব্রিটিশ ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত বিশ্বের অন্য কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের বৈদেশিক সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে।[৩]:৭,১৫,১৬[৪]:৩৭ এরফলে তিব্বত কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকায় তার অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলির সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রগুলিকে অবহিত করতে ব্যর্থ হয়।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয়তাবাদী চীন সরকারের প্রতিনিধিদের তিব্বত থেকে বিতাড়ন করা হয়।[৩]:৫,৭,৮ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিব্বত সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনমাও সে তুংয়ের নিকট পত্র পাঠিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, গণচীনের সমস্ত রকমের সামরিক অভিযান প্রতিরোধ করতে তিব্বত বদ্ধপরিকর।[৩]:২০[৪]:৪২ এই সময় তিব্বতী সেনাবাহিনীকে দ্রুত আধুনিকীকরণের একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা করা হয়।[৩]:১২,২০,২১[৪]:৩৭, ৪১-৪৩ ভারত কিছু অস্ত্রসাহায্য ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিলেও[৩]:২৬ চীনের সামরিক বাহিনী তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত, অস্ত্রসমৃদ্ধ, বৃহৎ ও অভিজ্ঞ বাহিনী ছিল।[২]:১৪২[৩]:১২[৪]:৪১

গণচীনের যুদ্ধপ্রস্তুতি[সম্পাদনা]

প্রজাতন্ত্রী চীন ও গণচীন উভয় সরকারই তিব্বতকে চীনের অংশ হিসেবে দাবী করত।[২]:১৪২ এছাড়া, তিব্বতের ধর্মপ্রধান সামন্ততন্ত্র থেকে তিব্বতীদের মুক্তি দেওয়ার গণচীনের সাম্যবাদী সরকারের একটি আদর্শগত তাগিদ ছিল। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে গণচীন সরকার তিব্বত, তাইওয়ানহাইনান দ্বীপকে বলপূর্বক অথবা শান্তিপূর্ণভাবে চীনের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করাকে নিজেদের প্রধান কাজ বলে গণ্য করে।[৩]: তিব্বত চীনের পরাধীনতা স্বীকারে অপারগ থাকায় মাও সে তুং তিব্বত সরকারকে মধ্যস্থতায় বসতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে ঐ বছর ডিসেম্বর মাসে চীনা বাহিনীকে চামদো আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেওয়ার আদেশ দেন।[৪]:৪৪[৬]:৪৮,৪৯

মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা[সম্পাদনা]

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ তিব্বত সরকারের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের কালিম্পং শহরে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত গণচীন সরকারের প্রতিনিধিদলের সাথে তিব্বতের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আলোচনার জন্য উপস্থিত হন। কিন্তু সভাস্থল নিয়ে তিব্বতী, ভারতীয়, ব্রিটিশ ও চীনা প্রতিনিধিদলের মধ্যে বিরোধ শুরু হওয়ায় সভা শুরু হতে বিলম্ব হয়। তিব্বতীরা সিঙ্গাপুর বা হংকং, ব্রিটিশরা নতুন দিল্লি এবং চীনারা বেইজিং শহরকে সভার সম্ভাব্য আলোচনা স্থল হিসেবে মনোনয়ন করেন। তিব্বতীরা বেইজিং শহরে আলোচনা করতে রাজী ছিলেন না, অন্যদিকে ব্রিটিশ ও ভারতীয়রা কোন ধরনের আলোচনার পক্ষপাতী ছিলেন না। যাই হোক, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই সেপ্টেম্বর নতুন দিল্লি শহরে তিব্বতী প্রতিনিধিদল চীনের বিদেশদূত জেনারেল ইয়ুয়ান ঝোংজিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ইয়ুয়ান তাঁদের নিকট তিব্বতকে চীনের অংশ হিসেবে এবং তিব্বতের প্রতিরক্ষা, ব্যবসা ও বৈদেশিক সম্পর্ক চীনের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব পেশ করেন। তিব্বর সরকার এই প্রস্তাব মেনে নিলে তিব্বতের শান্তিপূর্ণ মুক্তিপ্রদান এবং না মানলে যুদ্ধের হুমকি দেওয়া হয়। তিব্বতীরা এর বিপরীতে চীনকে ঐতিহাসিকভাবে তাঁদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেই মনে করতেন। তিব্বতী প্রতিনিধিদলের প্রধান ত্সি-দ্পোন-দ্বাং-ফ্যুগ-ব্দে-ল্দান-ঝ্বা-স্গাব-পা (ওয়াইলি: tsi dpon dbang phyug bde ldan zhwa sgab pa) চীন ও তিব্বতের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার কথা বলেন। বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রমণের কোন সম্ভাবনা না থাকায় চীনা সৈন্যদের তিব্বতে অবস্থান করার বিপক্ষে তিব্বতীরা সওয়াল করেন। ভারত বা নেপাল দ্বারা আক্রান্ত হলে তিব্বতীরা চীনাদের নিকট সামরিক সাহায্যের অনুরোধ করবেন বলেও জানান।

তিব্বত আক্রমণ[সম্পাদনা]

বেশ কয়েক মাসের ব্যর্থ আলোচনা[৩]:২৮-৩২ ও তিব্বতীদের বৈদেশিক সমর্থনলাভের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর[৩]:১২,২০,২১ চীনের সামরিক বাহিনী ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের ৬ ও ৭ তারিখ জিনশা নদী অতিক্রম করে।[৩]:৩২ চীনা বাহিনীর দুইটি দল খুব শীঘ্রই তিব্বতী সেনাবাহিনীকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে ১৯শে অক্টোবরের মধ্যে চামদো অধিকার করে নেয়। এই লড়াইয়ে ১১৪ জন চীনা[৭] ও ১৮০ জন তিব্বতী সৈন্য[২]:১৪৪[৭] নিহত বা আহত হন। এই অভিযানে চীনা সেনাপতি ঝাং গুয়োহুয়ার মতে, ৫৭০০ জন তিব্বতী নিহত হন এবং ৩০০০ জন শান্তিপূর্ণ ভাবে আত্মসমর্পণ করেন। খাম্স অঞ্চলের তিব্বতীরা চীনা বাহিনীর চামদো আক্রমণের বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিরোধ না গড়ে তোলায় চীনের সামরিক বাহিনী প্রায় বিনা প্রতিরোধে খাম্স অঞ্চল অধিকার করে নেয়।[৮]

সতেরো দফা চুক্তি[সম্পাদনা]

চীনের সামরিক বাহিনী তিব্বত আক্রমণের সময় ঙ্গা-ফোদ-ঙ্গাগ-দ্বাং-'জিগ্স-'মেদ (ওয়াইলি: nga phod ngag dbang 'jigs med) নামক চামদো অঞ্চলের তিব্বতী সেনার সর্বাধিনায়ককে বন্দী করে। পরে তাঁকে মুক্ত করে চতুর্দশ দলাই লামার নিকট মধ্যস্থতার জন্য পাঠানো হয়। চীনাদের তরফ থেকে জানানো হয় যে, তিব্বতকে শান্তিপূর্ণভাবে মুক্তি দেওয়া হলে তিব্বতী অভিজাতদের তাঁদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বজায় রাখতে দেওয়া হবে।[৯]:৩০৬ এরপর তিব্বত সরকার তাঁদের পক্ষ থেকে বেইজিং শহরে তাঁদের প্রতিনিধিদল পাঠাতে সম্মত হন। এই সময় এল সালভাদোর জাতিসংঘে তিব্বতের অভিযোগ উত্থাপনের চেষ্টা করলেও ভারতব্রিটেনের প্রতিরোধে এই নিয়ে কোন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়নি।[১০]

তিব্বতী প্রতিনিধিদল বেইজিং পৌছলে তাঁদেরকে তিব্বতের শান্তিপূর্ণ মুক্তির সতেরো দফা চুক্তি নামক একটি পূর্বপ্রস্তুত চুক্তি প্রদান করা হয়। চীনের তরফ থেকে মধ্যস্থতার কোন বার্তা না থাকলেও তাঁরা তিব্বতকে চীনের অংশ হিসেবে রেখে তিব্বতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংস্কারব্যবস্থা তিব্বতীদের হাতে রাখার কথা বলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বাক্ষরের পূর্বে তিব্বতী প্রতিনিধিদলকে তাঁদের সরকারের সঙ্গে আলোচনার কোন সুযোগ দেওয়া হয় না এবং ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মে তাঁরা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।[১১]:১১৩-১১৬ এরফলে তিব্বতে সাম্যবাদী চীনের শাসন এবং চীনের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে বৈধতা প্রদান করা হয়।[৪]:৪৭ তিব্বত সরকারের সঙ্গে কোন রকম আলোচনা না করে শুধুমাত্র তিব্বতী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় এই চুক্তির বৈধতা মানার ব্যাপারে তিব্বত সরকার দ্বিধাবিভক্ত হয়। এইসময় চতুর্দশ দলাই লামা সরকারের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হলে তিনি অক্টোবর মাসে এই চুক্তির শর্ত মানতে প্রস্তুত হন।[৪]:৪৮,৮৯,৫২ এরফলে কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত তিব্বত গণচীনের অধীনে একটি স্বয়ংশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Proclamation Issued by His Holiness the Dalai Lama XIII (1913)", Tibet Justice Center ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ মার্চ ২০০৯ তারিখে. Retrieved 20 March 2009
  2. Feigon, Lee. Demystifying Tibet: Unlocking the Secrets of the Land of Snows (1996) Ivan R. Dee Inc. আইএসবিএন ১-৫৬৬৬৩-০৮৯-৪
  3. Shakya, Tsering. The Dragon In The Land Of Snows (1999) Columbia University Press. আইএসবিএন ০-২৩১-১১৮১৪-৭
  4. Goldstein, M.C., "The Snow Lion and the Dragon", (1997) University of California Press. আইএসবিএন ০-৫২০-২১২৫৪-১
  5. Goldstein, Melvyn C. A History of Modern Tibet, Volume 2: The Calm Before the Storm 1951-1955 (2007) University of California Press. ISBN978-0-520-24941-7.
  6. Goldstein, Melvyn C. A History of Modern Tibet, Volume 1: 1913–1951: The Demise of the Lamaist State (1989) University of California Press. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৫২০-০৬১৪০-৮
  7. Jiawei Wang et Nima Gyaincain, The historical Status of China's Tibet, China Intercontinental Press, 1997, p.209 (see also The Local Government of Tibet Refused Peace Talks and the PLA Was Forced to Fight the Qamdo Battle ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ মার্চ ২০১২ তারিখে, china.com.cn): "The Quamdo battle thus came to a victorious end on October 24, with 114 PLA soldiers and 180 Tibetan troops killed or wounded."
  8. Knaus, John Kenneth (২০০৮)। Orphans of the Cold War: America and the Tibetan Struggle for Survival। PublicAffairs। পৃষ্ঠা 71। আইএসবিএন 078672403X। ২৬ জুন ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ এপ্রিল ২০১৪ 
  9. Laird, Thomas. The Story of Tibet: Conversations with the Dalai Lama (2006) Grove Press. আইএসবিএন ০-৮০২১-১৮২৭-৫
  10. Tibet: The Lost Frontier, Claude Arpi, Lancer Publishers, October 2008, আইএসবিএন ০-৯৮১৫৩৭৮-৪-৭
  11. Powers, John. History as Propaganda: Tibetan Exiles versus the People's Republic of China (2004) Oxford University Press. আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৫১৭৪২৬-৭

আরো পড়ুন[সম্পাদনা]