একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতা হচ্ছে সেইসব দক্ষতা ও সামর্থ্য যেগুলো শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ একবিংশ শতাব্দীর আবশ্যকীয় যোগ্যতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমান সময়ের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে শিক্ষার্থীদের এই দক্ষতাগুলো অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করা হয়। এই দক্ষতাগুলোর ভেতরে অনেকগুলো আবার অর্জন করা বেশ পরিশ্রমসাধ্য, যেমন: যুক্তিপ্রদর্শন, জটিল সমস্যার সামধান করা, দলগত কাজ ইত্যাদি। এই দক্ষতাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত নয়। একইসাথে এগুলো জ্ঞানমূলক দক্ষতাও নয়।[১]

বিংশ শতাব্দীর শেষ কয়েক দশক এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকে পৃথিবীর অর্থনীতি এবং প্রযুক্তিতে প্রচুর যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। চাকুরি করার জায়গাগুলোতে এখন নতুন ধরনের দক্ষতা চাওয়া হচ্ছে, ফলে শিক্ষার্থীরা এই দক্ষতাগুলো শিখে আসবে, এটাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে। আশির দশকে সরকার, শিক্ষাবিদ ও বিখ্যাত চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন যুগে চাকরিপ্রার্থী তরুণদের থেকে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতাগুলোর একটা সিরিজ রিপোর্ট তৈরি করে। এই রিপোর্টে বিভিন্ন দক্ষতার কথা উঠে আসে।

বর্তমান সময়ে চাকরির যোগ্যতার সংজ্ঞা আগের তুলনায় অনেকটাই বদলে গেছে। এর আগের এক বা দুই প্রজন্মের মানুষেরা প্রধানত কর্মক্ষেত্রে স্থিরতা ও চাকরির নিরাপত্তা চাইতেন। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম চায় তাদের কাজে আনন্দ খুঁজে পেতে। একইসাথে বর্তমান প্রজন্মের লোকজন একই চাকরিতে বেশিদিন থাকতে চায় না। দেখা গেছে, তারা গড়ে প্রতি ৪.৪ বছরে একবার চাকরি বদল করে।[২] যেহেতু চাকরিদাতাদের প্রত্যাশা বদলেছে, একইসাথে চাকরিপ্রার্থীদের কর্মক্ষেত্রে নমনীয়তা ও খাপ খাইয়ে নেবার ধরনও সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে।

21st Century Skills
একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতাসমূহ

পশ্চিমা অর্থনীতি বর্তমানে শিল্পনির্ভর নয়, বরং কর্মনির্ভর হয়ে উঠেছে। ফলে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে।[৩] কিছু নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন করার মাধ্যমে কর্ম বাজারে নিজের চাহিদা বৃদ্ধি করা যায়। তথ্যপ্রযুক্তির সাক্ষরতা এর ভেতরে অগ্রগণ্য। মানুষের সাথে যোগাযোগ, সমন্বয় করে কাজ করা, অন্যদেরকে পরিচালনা করতে জানা এই বিষয়গুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়।[8] এগুলোকে অনেক সময় ফলিত দক্ষতা বা কমনীয় দক্ষতা বলা হয়ে থাকে[৪], যার ভেতরে রয়েছে ব্যক্তিগত, আন্তঃব্যক্তিক অথবা শিখনকেন্দ্রিক দক্ষতা; যেমন জীবনদক্ষতা (সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা), মানবিক দক্ষতা ও সামাজিক দক্ষতা। এই দক্ষতাগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:[৫]

  • শিখন ও সৃজন দক্ষতা: সমালোচনা ও সমস্যা সমাধান, যোগাযোগ ও সমন্বয়, সৃজন দক্ষতা ও নতুনত্ব।
  • ডিজিটাল সাক্ষরতা: তথ্য সাক্ষরতা, গণমাধ্যম সাক্ষরতা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক সাক্ষরতা।
  • ক্যারিয়ার ও জীবনদক্ষতা: নমনীয়তা ও খাপ খাওয়ানো, উদ্যোগ ও পরিকল্পনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ, উত্পাদনশীলতা ও জবাবদিহিতা।

এই দক্ষতাগুলোর বেশিরভাগকে আধুনিককালের শিক্ষার অন্যতম চাবিকাঠি বলা হয়ে থাকে। এগুলো ছাড়া শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে অসম্পূর্ণ মনে করা হয়।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা উন্নয়ন বিষয়ক একটি কমিষন গঠন করা হয়। এই কমিশন ১৯৮৩ সালে একটি রিপোর্ট প্রদান করে। এতে শিক্ষার গুণগত উন্নয়নের জন্য পঠিত বিষয় ও মূল্যায়নে বেশকিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়।[৬] এগুলোর সারসংক্ষেপ হচ্ছে:

অধ্যয়নের প্রধান পাঁচটি ভিত্তিগত বিষয়: ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক অধ্যয়ন, কম্পিউটার বিজ্ঞান।

শিক্ষাক্রমের যেসব স্থানে উন্নয়ন আবশ্যক: দক্ষতা বাড়ানো, সহানুভূতিশীল করে তোলা, বিদেশি ভাষায় দক্ষতা, শিল্প-সংস্কৃতি ও চারুকলা, কারিগরি শিক্ষা ও মানসম্মত উচ্চশিক্ষা।

যে দিকগুলো আলোচ্য:

  • শেখার অদম্য ইচ্ছা
  • গভীরভাবে বুঝতে পারা
  • জ্ঞানের বাস্তবিক প্রয়োগ
  • পরীক্ষণ, অনুসন্ধান, সমালোচনা ও যুক্তিদানের ক্ষমতা ও ইচ্ছা
  • যোগাযোগ (উত্তমভাবে লেখা, কার্যকর শ্রবণ, বিশদভাবে আলোচনা করা, বিদেশি ভাষায় দক্ষ হওয়া)
  • সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত বিষয়ে সচেতনতা
  • প্রযুক্তির কার্যকর ও দক্ষ ব্যবহার করতে জানা
  • শিখনে বৈচিত্র‍্য ও বিভিন্নতা নিয়ে আসা

পরবর্তীতে এই দক্ষতাগুলোর সংজ্ঞায়নে নানা কাটাছেঁড়া হয়েছে এবং আরো অনেক দক্ষতা সংযোজিত হয়েছে। ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ও শিক্ষাবিষয়ক গবেষণায় এই দক্ষতাগুলো নির্ধারিত হয়েছে।

দক্ষতাসমূহ[সম্পাদনা]

বিংশ শতাব্দীর দক্ষতা হিসেবে বিভিন্ন গবেষণা বা রিপোর্টে ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতার নাম এলেও এগুলোর ভেতর কিছু সাধারণ মিল লক্ষ করা যায়। এই দক্ষতাগুলোর বেশিরভাগই মূলত একজন ব্যক্তিকে তার পারিপার্শ্বিক বিষয়াবলী সম্পর্কে সচেতন করার জন্য নির্দে‌শিত। একইসাথে সময়ের সাথে অগ্রসর হওয়া পৃথিবীতে একজন যোগ্য ও গুণসম্পন্ন ব্যক্তি হয়ে ওঠার জন্য এগুলো অর্জন করা দরকার।

আমেরিকান ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন[সম্পাদনা]

এরা চাকরিপ্রার্থীদের ভেতরে তিনটি দক্ষতা আশা করে। এগুলো হচ্ছে: যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা, যোগাযোগ দক্ষতা ও সমন্বয়।[৭]

কমন কোর স্ট্যান্ডার্ড[সম্পাদনা]

এটি ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত একটি পদক্ষেপ, যা শিক্ষার উন্নয়নকল্পে নেয়া হয়েছিলো। এতে নিম্নের দক্ষতাগুলো উল্লেখিত হয়:[৮]

  • সুসংগত যুক্তিদানের ক্ষমতা
  • প্রমাণ সংগ্রহ
  • যৌক্তিক সমালোচনা, সমস্যা সমাধান, বিশ্লেষণ
  • যোগাযোগ

স্ক্যান্স‌[সম্পাদনা]

১৯৮৩ সালের রিপোর্টটিকে অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি শ্রমবিভাগ Secretary's Commission on Achieving Necessary Skills (SCANS) বা স্ক্যান্স-কে একুশ শতকের কাঙ্ক্ষিত দক্ষতাসমূহ নিরূপণের দায়িত্ব দেয়। তারা নিচের দক্ষতাগুলো সুপারিশ করে:[৯]

  • মৌলিক দক্ষতাসমূহ
    1. বুনিয়াদি দক্ষতাসমূহ: পড়া, লেখা, গাণিতিক হিসেব করতে পারা, শোনা, বলা।
    2. চিন্তন দক্ষতাসমূহ: সৃজনশীলভাবে চিন্তা করা, সিদ্ধান্তগ্রহণ করা, সমস্যার সমাধান করা, দর্শন, শেখার পদ্ধতিসমূহ জানা, যুক্তি।
    3. ব্যক্তিগত গুণাবলি: দায়িত্বশীলতা, আত্মসম্মানবোধ, সামাজিকতা, আত্মসচেতনতা, সততা।
  • কর্মক্ষেত্রের দক্ষতাসমূহ
    1. সম্পদ ও প্রয়োজনীয় বস্তু: সনাক্তকরণ, সজ্জিতকরণ, পরিকল্পনা করা, বরাদ্দ করা।
    2. আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক: অন্যদের সাথে দল হিসেবে কাজ করা, সুসম্পর্ক বজায় রাখা, দর কষাকষির সক্ষমতা।
    3. তথ্য: তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে জানা।
    4. ব্যবস্থাপনা: পুরো ব্যবস্থাপনার জটিল দিক ও সম্পর্কগুলো জানা ও বোঝা।
    5. প্রযুক্তি: প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহার জানা থাকা।

পি-২১ দক্ষতাসমূহ[সম্পাদনা]

Partnership for 21st Century Skills (P21) বা পি-২১ নামক একটি বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক ২০০২ সালে এই দক্ষতাগুলো নির্দেশিত হয়।[১০]

৪সি দক্ষতা

এতে ইংরেজি 'সি' বর্ণ দ্বারা সূচিত চারটি দক্ষতার কথা বলা হয়।

  1. Collaboration (সমন্বয়)
  2. Communication (যোগাযোগ)
  3. Critical thinking (যৌক্তিক সমালোচনা)
  4. Creativity (সৃজনশীলতা)

সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়[সম্পাদনা]

এরাও 'সি' দিয়ে সূচিত চারটি দক্ষতা প্রস্তাব করে।

  1. Create (সৃজন করো)
  2. Circulate (ছড়িয়ে দাও)
  3. Connect (সংযুক্ত হও)
  4. Collaborate (সমন্বয় করো)

প্রয়োগ[সম্পাদনা]

২১ শতকের দক্ষতা অর্জন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রাখছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে এই দক্ষতাগুলো বিবেচনা করছে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Bellanca, James A. (২০১০)। 21st Century Skills : Rethinking How Students Learn.। Solution Tree Press। আইএসবিএন 9781935542377ওসিএলসি 956656144 
  2. Meister, Jeanne। "The Future Of Work: Job Hopping Is the 'New Normal' for Millennials"Forbes (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-০৫ 
  3. "Futurework - Trends and Challenges for Work in the 21st Century - Chapter 4: Workplaces"web.archive.org। ২০১৬-০৩-১৩। Archived from the original on ২০১৬-০৩-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-০৫ 
  4. Gewertz, Catherine (২০০৭-০৬-১২)। "'Soft Skills' in Big Demand - Education Week"Education Week। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-০৫ 
  5. Trilling, Bernie. (২০০৯)। 21st century skills : learning for life in our times। Fadel, Charles., Partnership for 21st Century Skills. (1st ed সংস্করণ)। San Francisco: Jossey-Bass। আইএসবিএন 9780470553909ওসিএলসি 498376594 
  6. National Commission on Excellence in Education. (1983). A Nation at Risk. US Department of Education.
  7. Critical Skills Survey (PDF). New York: American Management Association. 2012.
  8. "Read the Standards | Common Core State Standards Initiative"www.corestandards.org। ২০২১-০৬-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-০৫ 
  9. "Secretary's Commission on Achieving Necessary Skills - Final Report | Academic Innovations, Publisher of Career Choices"www.academicinnovations.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-০৫ 
  10. "Battelle for Kids"www.battelleforkids.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-০৫