ইরানীয় ক্ষুদ্রমহাদেশ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ইরানীয় ক্ষুদ্রমহাদেশ (ইংরেজি - Iranian microcontinent) হল একটি ভূতাত্ত্বিক তত্ত্ব। ১৯৭৪ সালে প্রখ্যাত সুইস ভূতত্ত্ববিদ ইয়োভান স্ট্যোকলিন এই তত্ত্বের কথা প্রথম বলেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী আজকের ইরান প্যালিওজোয়িক মহাযুগের শেষভাগ বা পরবর্তী মেসোজোয়িক মহাযুগের প্রথমভাগ থেকে ট্রায়াসিক যুগের শেষভাগ বা পরবর্তী জুরাসিক যুগের প্রথমভাগ পর্যন্ত একটি আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু আলাদা মহাদেশ হিসেবে অবস্থান করত।[১] এর উত্তরে ও দক্ষিণে দুই দিকেই দুই মহাসাগরের অস্তিত্ব ছিল। ভূত্বকীয় পাতের চলনের ফলে এই ক্ষুদ্রাকার মহাদেশটি ক্রমশ উত্তরে এগিয়ে চলার ফলে প্রথমে উত্তরের মহাসাগরটি বুজে আসে। পরবর্তীতে দক্ষিণ থেকে আরবীয় পাত এগিয়ে এসে ইরানীয় পাতের সাথে মিলিত হলে এই ক্ষুদ্রাকার মহাদেশটির আলাদা অস্তিত্বের বিলোপ ঘটে।

বর্তমানে অবশ্য এই তত্ত্ব আর সেইভাবে মান্যতা পায় না। ইরানীয় পাতকে বর্তমানে একটি বৃহত্তর মহাদেশীয় টুকরো (Terrane বা Kleinkontinent) কিমেরিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এই কিমেরিয়া একটি ফালির মতো লম্বা অবিচ্ছিন্ন মহাদেশীয় টুকরো ছিল না অনেকগুলি বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্রমহাদেশের সমষ্টি ছিল, তা নিয়ে ভূতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে।

তত্ত্ব[সম্পাদনা]

১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে সুইস ভূতাত্ত্বিক ইয়োভান স্ট্যোকলিন মধ্যপ্রাচ্যে যে বিশদ ক্ষেত্রসমীক্ষা চালান, তাতে তিনি দেখতে পান যে ইরানের উত্তরাংশে অবস্থিত আলবুর্‌জ পর্বতমালার উত্তরপ্রান্ত দু'টি মহাদেশীয় পাতের সংযোগস্থলের (suture) উপরে অবস্থিত। তিনি এই অঞ্চলকে প্যালিওজোয়িক মহাযুগে গন্ডোয়ানার উত্তর উপকূল ও পুরাতন টেথিসের অবশেষ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্যালিওজোয়িক মহাযুগে ইরান আরব তথা গন্ডোয়ানারই উত্তর অংশ হিসেবে বিরাজ করত, যা উত্তরে একটি সাগর দ্বারা আরও উত্তরের ভূভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। আজকের কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ অংশের গভীর খাত ও আশেপাশের পর্বতাঞ্চলকে তিনি এই পুরনো বুজে যাওয়া সাগরেরই অবশেষ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি সেই সঙ্গে দক্ষিণপশ্চিম ইরানের জগ্রোস পর্বতমালা বরাবর ইরানীয় পাতআরবীয় পাতের সংযোগস্থলে আরেকটি অতি পুরাতন চ্যুতির অস্তিত্বও খুঁজে পান, যা সম্ভবত প্যালিওজোয়িক মহাযুগের শেষের দিক বা মেসোজোয়িক মহাযুগের (২৫.২২ কোটি - ৬.৬ কোটি বছর আগে পর্যন্ত সময়কাল) প্রথমদিকে এই দুই পাতকে আলাদা করে দিয়েছিল। এরউপর ভিত্তি করে তিনি অনুমান করেন যে নিশ্চয়ই এই দক্ষিণের চ্যুতিটি বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে দক্ষিণে আরেকটি সাগরের (নব্য টেথিস) উদ্ভব হয়েছিল। এর থেকে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে এই নতুন সাগরটির উদ্ভবের সাথে সাথে আজকের ইরান গন্ডোয়ানার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মেসোজোয়িক মহাযুগের শেষের দিকে নিশ্চয়ই একটি ক্ষুদ্র মহাদেশে পরিণত হয়েছিল। তিনি একে ইরানীয় ক্ষুদ্রমহাদেশ নামে অভিহিত করেন। কিন্তু এই দক্ষিণের এই নব্য সাগরটি প্যালিওসিন উপযুগে (৬.৬ কোটি - ৫.৬ কোটি বছর আগে পর্যন্ত সময়কাল) হিমালয় ও আল্পস পর্বতমালার গঠনপ্রক্রিয়ার সময় আবার বুজে যায়। অর্থাৎ, এই অঞ্চলের দক্ষিণে আরও একটি মহাদেশীয় পাত সংযোগস্থল নিশ্চিতভাবে অবস্থান করছে, যা ইরানীয় পাতের সাথে তার দক্ষিণের মহাদেশীয় পাতের পুনরায় একত্রিত হওয়াকে সূচিত করে।[১] দক্ষিণের এই মহাদেশীয় পাত সংযোগস্থল সম্পর্কিত স্ট্যোকলিনের এই অনুমান পরবর্তী গবেষণায় বহুলাংশেই প্রমাণিত হয়েছে। দক্ষিণ ইরানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উদ্ভিদজগতের বিবর্তনের নিবিড় পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে, কার্বনিফেরাস যুগ (৩৫.৮৯ কোটি থেকে ২৯.৮ কোটি বছর আগে পর্যন্ত সময়কাল) পর্যন্ত তার সাথে গন্ডোয়ানার ঐ জাতীয় উদ্ভিদের বিবর্তনের অত্যন্ত মিল, কিন্তু ট্রায়াসিক যুগ (২৫.২২ কোটি - ২০.১৫ কোটি বছর আগে পর্যন্ত সময়কাল) থেকে ইউরেশীয় উদ্ভিদের বিবর্তনের সাথে তার মিল বেশি। অর্থাৎ এই দুই সময়ের মধ্যবর্তীযুগে ইরান গন্ডোয়ানা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে নিশ্চয়ই পৃথকভাবে অবস্থান করেছিল ও অবশেষে ইউরেশিয়ার সাথে মিলিত হয়েছিল।[২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Stöcklin, J. (1974). "Possible Ancient Continental Margins in Iran". In Burk, C. A.; Drake, C. L. The geology of continental margins. Springer Berlin Heidelberg. pp. 873–887. সংগৃহীত ২১ অক্টোবর, ২০১৭।
  2. Stampfli, G. M. (2000). "Tethyan oceans" (PDF). Geological society, London, special publications. 173 (1): 1–23. সংগৃহীত ২১ অক্টোবর, ২০১৭।

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]