আব্দুল্লাহ আল মাহাদ
আব্দুল্লাহ আল মাহাদ (৬৯০-৭৬২) হলেন একজন ইসলামী পন্ডিত, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি হাসান ইবনে আলী এবং হুসেন ইবনে আলীর উভয়ের নাতি। তার পূর্ণ নাম হলো আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে আল-হাসান ইবনে আল-হাসান ইবনে আলি ইবনে আবি তালিব আল-হাশিমি আল-কুরাশী। তিনি আবদুল্লাহ আল-মাহাদ, আব্দুল্লাহ আল মাহাজ (বাংলাদেশে) এবং আব্দুল্লাহ আল-কামিল নামেও পরিচিত ছিলেন। তার পুত্রদের মধ্যে মুহাম্মদ এবং ইব্রাহিম আব্বাসীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ইদ্রিস উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় বিদ্রোহ করেছিলেন এবং ইদ্রিস রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিয়াদের মধ্যে তিনি একজন শহীদ হিসাবে বিবেচিত হন। আব্বাসীয় শাসক আল মানসুর তাকে বন্দী করেছিলেন। আল-মনসুর তার বিদ্রোহী পুত্রদের লুকানোর জায়গার ঠিকানা জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করতে অস্বীকার করার জন্য বন্দী হন এবং তিন বছর কারাভোগ করার পর তাকে হত্যা করা হয়। ইরাকের আল-শিনাফিয়া শহরে তার সমাধি রয়েছে। বর্তমানে সমাধিটি আবদুল্লাহ আবু নাজমের মাজার বলে পরিচিত। [১]
জীবনী
[সম্পাদনা]আবদুল্লাহ আল মাহাদ ৬৯০ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হাসান আল-মুথান্না (হাসান আল মাসনা নামেও পরিচিত) এবং তার মায়ের নাম ফাতিমা বিনতে আল-হুসেইন। তার মা-বাবা উভয়ই আলী ইবনে আবু তালিবের নাতি। [১][২] আবদুল্লাহ আল মাহাদ ছিলেন তার মা-বাবার প্রথম সন্তান। তার মামা আলী ইবনে হুসেন জয়নাল আবেদিনের কাছে শৈশবে লালিত পালিত হন। [৩][৪] তিনি তার মামার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। [৫] আবু আল-ফারাজ আল-ইসফাহানির বর্ণনা অনুসারে, আবদুল্লাহ আল মাহাদ ছিলেন উগ্র মেজাজি। তিনি বনু হাশিম গোত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি উমাইয়া শাসক দ্বিতীয় উমরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কিছু শিয়া বর্ণনা অনুসারে, আবদুল্লাহ আল মাহাদ নিজেকে ইমাম দাবি করেছিলেন এবং অন্যান্য ইমামদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছিলেন। [৬][৭][৮][৯] উমাইয়া খিলাফতের পতনের পর আব্বাসীয় যুগ শুরু হলে আবদুল্লাহ আল মাহাদের পুত্রগণ নতুন শাসককে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। নতুন শাসক তাদের বিদ্রোহী সাব্যস্ত করে। [১০] আব্বাসিয় প্রথম খলিফা আল-সাফ্ফাহ আবদুল্লাহ আল মাহাদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতেন, যদিও তাদের মতের অমিল ছিলো। কিন্তু পরবর্তী শাসক আল মানসুরের সাথে আব্দুল্লাহ আল মাহাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। তিনি আবদুল্লাহকে বন্দী করেন এবং তার ছেলেদের বন্দী করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাইলে তিনি অস্বীকার করেন। তাকে বিদ্রোহের সহযোগী বলে অভিযুক্ত করে তিন বছর কারাদণ্ড প্রদান করেন। [১১] কিছু সূত্র উল্লেখ করেছে যে, আবদুল্লাহকে আল-মনসুরের আদেশে ৭৬২ সালে কুফার নিকটে আল-হাশিমিয়া কারাগারে হত্যা করা হয়েছিল। [১২][১৩] ইবনে জাওযী দাবি করেন যে, তার মৃত্যু ঈদুল আযহার দিনে হয়েছিল। [১৪] আল কাদিসিয়া শহরে তার মাজার রয়েছে। তার মাজার আল-শিনাফিয়াহ শহর থেকে ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং নাজাফ শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। [১৫] মিশরের কায়রোতে আবদুল্লাহ আল-মাহদের একটি মাজারও রয়েছে।
সন্তান
[সম্পাদনা]আবদুল্লাহ আল মাহাদের পুত্ররা তৎকালীন শাসক বিরোধী বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বিখ্যাত। তাদের মধ্যে মুহাম্মদ মদিনায় আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাকে তার অনেক অনুসারীদের সাথে হত্যা করা হয়েছিল। [১৬]অপর পুত্র ইব্রাহীম, যিনি তার ভাইকে হত্যার পর বসরায় বিদ্রোহ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাকে অনেক যায়দী ও মুতাযিলা সম্প্রদায়ের লোকেরা সমর্থন করেছিলেন।[১৭]কিন্তু তার বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল এবং ইব্রাহিম ও তার সমর্থকদের ভেতরে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। ইতিহাসে যা বাখামরা শাহাদাত নামে পরিচিত। আব্দুল্লাহ আল মাহাদের অন্য ছেলেরা, যথা: ইদ্রিস, ইয়াহিয়া এবং সুলায়মানও বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন। ইদ্রিস যুদ্ধে বেঁচে যান এবং পালিয়ে মরক্কো যান। সেখানে তিনি একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইয়াহিয়া পারস্য তথা ইরানে চলে যান এবং দায়লামে বসবাস শুরু করেন।[১৮]সেখানে গিয়েও তিনি আব্বাসীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নতুন বিদ্রোহের জন্য লোকদের উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু খলিফা হারুন-উর-রশিদের আদেশে তিনি বন্দী হন। বন্দী অবস্থায় ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় ৮০৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। কিছু সূত্র অনুযায়ী তাকে জীবিত কবর দেওয়া হয়।অপর পুত্র ইব্রাহীম, যিনি তার ভাইয়ের হত্যার পর বসরায় বিদ্রোহ করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তাকে অনেক যায়দী ও মুতাযিলা সম্প্রদায়ের লোকেরা সমর্থন করেছিলেন।[১৯]
আব্দুল্লাহ আল মাহাদের বিপ্লব
[সম্পাদনা]কিছু সূত্র অনুসারে, আবদুল্লাহ আল মাহাদ উমাইয়াদের বিরুদ্ধে জায়েদের বিদ্রোহের সাথে একমত ছিলেন না, কুফায় তার বিপ্লবের আগে জায়েদকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, তিনি কুফাবাসীদের প্রতিশ্রুতিতে প্রতারিত হবেন না। জায়েদের মৃত্যুর পর, তিনি বল প্রয়োগ করে উমাইয়া শাসন উৎখাতের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাই তিনি তার ছেলেদের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করেন।[২০]
আবু আল-ফারাজ আল-ইসফাহানির বর্ণনা অনুসারে, বনু হাশিমের কেউ কেউ তার সাথে একমত হননি এবং তাকে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের পরামর্শ ছিলো উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করার। তারা আরও বলেছিলেন যে, আব্দুল্লাহর পুত্র মেহেদিকে তিনি যদি ইমাম মেহেদি হিসেবে উল্লেখ করলেও তারা তার সাথে থাকবেন না। কারণ প্রকৃত সময় তখনও আসেনি। সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম আবদুল্লাহকে বলেছিলেন খিলাফত আল-সাফ্ফাহ এবং তার ভাইদের হবে; আব্দুল্লাহ এবং তার পুত্রদের এতে অংশ থাকবে না। আবু আল-ফারাজ আল-ইসফাহানি বর্ণনা করেছেন, ইমাম আবদুল্লাহকে তার দুই পুত্র মুহাম্মদ ও ইব্রাহিমকে হত্যা করতে বলেছিলেন।[২১]
কিছু পন্ডিত বিশ্বাস করেন যে, আব্দুল্লাহ তার পুত্রকে প্রতিশ্রুত মাহদী নামকরণ করেছিলেন। এই দাবী হাসান ইবনে আলীর বংশধর এবং হুসাইন ইবনে আলীর বংশধরদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করেছিল।[২২]
দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের খিলাফতকালে আবদুল্লাহ আল-মাহাদকে তার পুত্র মুহাম্মদের গোপন বিদ্রোহী আস্তানা প্রকাশ না করার জন্য বন্দী করা হয়েছিল। এরপর তিন বছর কারাগারে ছিলেন তিনি। আল-মনসুর ৭৫৭ সালে হজ্বের মৌসুমে তার কারাকক্ষে দেখা করেন এবং তাকে তার স্বাধীনতার বিনিময়ে পুত্রের লুকানো আস্তানা প্রকাশ করতে বলেন, কিন্তু তিনি আরও একবার খলিফাকে প্রত্যাখ্যান করেন।[২৩]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Al-Baladhuri, Ansab Al-Ashraf, vol. 2, page. 198.
- ↑ Abu al-Faraj al-Isfahani, Fighter of the Talibis, p.168
- ↑ Al-Amiri, Bahjat al-Mahafil, vol.2, p. 8
- ↑ Al-Atardi, Musnad al-Imam al-Sadiq, vol.22, p.630.
- ↑ Al-Mufid, Al-Irshad, Part 2, p. 140
- ↑ Abu al-Faraj al-Isfahani, Fighter of the Talibis, p.167
- ↑ Abu al-Faraj al-Isfahani, Fighter of the Talibis, p.170
- ↑ Al-Kulayni, Al-Kafi, Part 1, p. 349
- ↑ Al-Khoei, Lexicon of Rijal Al-Hadith, vol. 11, p. 173
- ↑ Ibn al-Jawzi, al-Muntazam, vol 8, p. 90
- ↑ Al-Shami, Al-Durr Al-Nazim, p. 520
- ↑ Abu al-Faraj al-Isfahani, Fighter of the Talibis, p. 171
- ↑ Ibn al-Atheer, Al-Kamil in History, vol. 5, pp. 526-527.
- ↑ Sibt ibn al-Jawzi, Tadhkirat al-Khawas, p. 207
- ↑ "محافظ النجف الاشرف يزور مرقد (عبد الله ابو نجم) (رض) ويتابع مع سدنته مشاريع الاعمار والتاهيل"। ৪ অক্টোবর ২০০৮।
- ↑ Al-Tabari, History of the Prophets and Kings, vol. 7, p. 590
- ↑ Al-Sabri, History of Islamic Difference, Part 2, p. 72
- ↑ Abu al-Faraj al-Isfahani, Fighter of the Talibis, pp. 390-433.
- ↑ Al-Sabri, History of Islamic Difference, Part 2, p. 72
- ↑ Al-Sabri, History of Islamic Fiqh, Part 2, p. 70.
- ↑ Abu al-Faraj al-Isfahani, Fighter of the Talibis, pp. 185-186
- ↑ Jaafarian, Intellectual and Political Life of Shiite Imams, p. 371
- ↑ Ibn al-Jawzi, al-Muntazim, part 8, pg. 90