অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আলাস্কার নওইতনা নদীর এই ছবিতে দুটি হ্রদ দেখানো হয়েছে - ছবির নীচে সংক্ষিপ্ত একটি এবং মাঝের ডানদিকে আরও দীর্ঘ, বাঁকা অপর একটি। এ ছাড়াও, তৃতীয় অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদটি কীভাবে তৈরি হচ্ছে, সেটিও পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। নদী পাড়ের কেন্দ্রে থাকা সবচেয়ে বেশি সর্পিল অংশটি খুব সংকীর্ণ – নদীর প্রস্থের চেয়ে অনেক সংকীর্ণ। ঘটনাক্রমে, দুপাশের দুটি অংশই ভেঙে গিয়ে একটি নতুন সোজাসুজি পথ তৈরি করে নেয়। তারপরে নদীর একটি নতুন তীরে জমা শুরু হয়, আর বাঁকা অংশটি রুদ্ধ করে ফেলায় আর একটি অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ গড়ে ওঠে।

অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ একটি ইউ-আকারের (U) হ্রদ। এটি তৈরি হয় যখন কোনও নদীর বিস্তৃত জলধারা আঁকাবাঁকা পথ-এ অগ্রসর হওয়ার পথে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেটে গিয়ে একটি স্থির জলধারা গঠন করে। দক্ষিণ টেক্সাস-এ রিও গ্র্যান্ডে ছেড়ে আসা অশ্বখুরাকৃতি হ্রদগুলিকে রিসাকা বলা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় অশ্বখুরাকৃতি হ্রদগুলিকে বিল্লাবং বলা হয়। ভারতেও এ জাতীয় হ্রদ পাওয়া যায়। মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হ'ক বা না হ'ক, কোনও নদী বা প্রবাহের একটি ইউ-আকারের বাঁককে বোঝাতে ব্যবহৃত হতে পারে "অশ্বখুর" শব্দটি। [১][২] চলিত বাংলায় একে বাওড় বলা হয়। বাংলাদেশের খুলনা বিভাগে সবথেকে বেশি বাওড় দেখা যায়। যার অধিকাংশই ভৈরব, কুমার এবং কপোতাক্ষ নদ হতে উৎপত্তি হয়েছে।

ক্যাসিনি রাডার চিত্র থেকে সরস্বতী ফ্লুমেনের প্রস্তাবিত অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ।

শনির চাঁদ টাইটান-এ ওন্টারিও ল্যাকাস-এর কাছে সরস্বতী ফ্লুমেন-এও একটি সম্ভাব্য অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ রয়েছে।[৩]

ভূতত্ত্ব[সম্পাদনা]

নদীতীরের ভাঙনের ফলে যখন নদীতে ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়, তখন অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ তৈরি হয়। দীর্ঘ সময় পরে, সেখানে গতিপথটি খুব বাঁকানো হয়ে যায় এবং অবশেষে তার ঘাড়টি সঙ্কুচিত হয়ে যায়। বন্যার সময় নদীটি সেই ঘাড়ের মধ্যে দিয়ে কেটে চলে যায়। ফলে একটি অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ গঠিত হয়।

উত্তর-পূর্ব চীন-এর সোনগুয়া নদীর পূর্ববর্তী কোর্সের ঘূর্ণি এবং বক্ররেখা সহজেই এই উপগ্রহের ফটোতে দেখা যায়

কোনও নদী যখন নীচু সমভূমিতে এসে পৌঁছায়, প্রায়ই তার সমাপ্তি ঘটে সমুদ্র বা হ্রদ-এ। যাওয়ার এই চূড়ান্ত পথে প্রশস্ত হয়ে নদী বাঁক-এর জন্ম হয়। নদীর বাঁকের সান্নিধ্যে, উত্তল তীরে (ছোট ব্যাসার্ধের তীর) পলি জমতে থাকে। এর বিপরীতে, পার্শ্বীয় ক্ষয় এবং আভ্যন্তরীণ কাটাকাটি - এই উভয় প্রক্রিয়াতে সৃষ্টি হয় কাটা তীর বা অবতল তীর (বৃহত্তর ব্যাসার্ধের তীর)। উত্তল তীরে অবিচ্ছিন্নভাবে জমে থাকা এবং সর্পিল গতির নদীর অবতল কূলের ক্ষয়ের কারণে দুটি অবতল তীর নিকটতর হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে খুব সুস্পষ্ট বাঁক গোচরে আসে। দুটি প্রতিবেশি অবতল তীরের মাঝের জমির সরু অংশটি অবশেষে কাটা পড়ে। এই কাটা পড়াটি ঘটে, হয় দুটি অবতল তীরের পার্শ্বীয় ক্ষয় দ্বারা, আর না হয় একটি জোরালো বন্যা দ্বারা। এটি যখন ঘটে তখন নদীর একটি নতুন সোজা ধারা বা খালের বিকাশ হয় এবং বাঁকটি পরিত্যক্ত হয়। একে বলা হয় কাটঅফ আকার। সঞ্চয় যখন অবশেষে কাটঅফ আকারকে নদীর ধারা থেকে রুদ্ধ করে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তখন তৈরি হয় অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ। এই প্রক্রিয়াটি কয়েক বছর থেকে কয়েক দশক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ঘটতে পারে এবং কখনও কখনও পুরোপুরি থেমে যেতেও পারে।

অবতল তীরের কাছে ক্ষয়জাত উপাদান সংগ্রহ এবং উত্তল তীরে সেগুলি বয়ে নিয়ে যাওয়া হ'ল, নদী-বাঁকের আশেপাশে, নদী-তল জুড়ে গৌণ প্রবাহ-এর কাজ। উত্তল তীরে পলি, বালি এবং নুড়ি জমার প্রক্রিয়াটি পয়েন্ট বার-এ স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে।[৪]

প্লাবনভূমিতে কম সর্পিলতা-বিশিষ্ট নদীর তুলনায় বেশি সর্পিল নদীতে দীর্ঘতর অশ্বখুরাকৃতি হ্রদের প্রাধান্য দেখা যায়। এর কারণ হলো উচ্চ সর্পিলতার নদীগুলিতে বৃহত্তর বাঁক রয়েছে এবং দীর্ঘতর হ্রদ গঠনের আরও বেশি সুযোগ রয়েছে। নিম্ন সর্পিলতার নদীগুলিতে তাদের বাঁকগুলি সংক্ষিপ্ত দূরত্বের কারণে, কম কাটঅফ হয়। তাই তাদের বৈশিষ্ট্য হ'ল সংক্ষিপ্ত অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ গঠন করা।[৫]

একটি বৃত্তাকার বাটি ব্যবহার করে গৌণ প্রবাহের প্রভাব দেখানো যেতে পারে। আংশিকভাবে বাটিটি জল দিয়ে পূরণ করুন এবং তাতে বালির কণা বা চাল ছড়িয়ে দিন। একটি হাতা বা চামচ দিয়ে জলটি বৃত্তাকার গতিতে গুলোতে থাকুন। এই প্রক্রিয়াটি পয়েন্ট বার গঠন-এর মতো, যার অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ গঠনে অবদান রয়েছে। বাটিতে জলের প্রাথমিক প্রবাহটি হলো বৃত্তাকার এবং বাটির পাশের সমকেন্দ্রিকটি হলো স্ট্রিমলাইন। যাইহোক, বাটির সীমানা স্তরটির গৌণ প্রবাহ হলো বাটির মেঝে জুড়ে কেন্দ্রের ভেতরের দিকে। প্রাথমিক প্রবাহটির ঘন কণাগুলিকে বাটির পরিধি বরাবর ছুঁড়ে দেওয়ার প্রবণতা থাকে, কিন্তু তার পরিবর্তে গৌণ প্রবাহটি কণাকে কেন্দ্রের দিকে ঝেড়ে ফেলে।[৬]

বাঁকযুক্ত নদীতে, বাঁকের ভেতরের অংশের চাইতে বাঁকের বাইরের অংশের জলতল সামান্য উঁচুতে থাকে। ফলে, নদীর খাড়াই বরাবর বাঁকের কাছে, বাইরের দিকে জলের চাপ, ভেতরের চেয়ে বেশি হয়। বাঁকের অবতল পাড় বরাবর একটি আনত চাপ, অভিকেন্দ্রিক বল প্রয়োগ করে এবং তার কারণেই এক এক গুচ্ছ জল, বাঁকা পথে চালিত হয়।

নদীর তল বরাবর প্রবাহিত সীমানা স্তরটি পার্শ্বস্থ নতি চাপের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ দ্রুত অগ্রসর হয় না। এর গতিবেগটি আংশিক থাকে নদীর ভাসমান স্রোতের দিকে এবং আংশিক থাকে নদীর উত্তল তীরের দিকে।[৪][৭] নদীর তল বরাবর প্রবাহিত হওয়ার সাথে সাথে, এটি উত্তল তীরের দিকে আলগা উপাদানগুলি দিয়ে স্ফীত করে তোলে। সীমানা স্তরটির এই প্রবাহ, নদীর প্রাথমিক প্রবাহের গতির অভিমুখের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে পৃথক এবং এটি নদীর গৌণ প্রবাহ-এর অংশ।

দক্ষিণ-পশ্চিম ওয়েলস-এর গাওয়ার উপদ্বীপ-এ উপকূলীয় সমতলে অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে
আরকানসাস-এর হিউজেস-এর কাছে একটি হর্সশু বা অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ। সীমান্তের স্ফীত অংশগুলি নদী গতিপথ পরিবর্তনে প্রতিফলিত হয়। যখন নদীর গতিপথ সরিয়ে আগের চ্যানেলটি কেটে ফেলা হয়, তখন সীমানাটি অপরিবর্তিতই থাকে।

যখন তরল কোনও বাঁকানো পথ অনুসরণ করে, যেমন একটি বৃত্তাকার বাটির চারপাশে, বা কোনও নদীর বাঁকে অথবা ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়-এ, তখন সেই প্রবাহটিকে ঘূর্ণি প্রবাহ হিসাবে বর্ণনা করা হয়। ব্যাসার্ধটি যেখানে সবচেয়ে কম, সেখানে সবচেয়ে দ্রুত ঘূর্ণির গতি হয় এবং ধীর গতি হয়, যেখানে ব্যাসার্ধ সবচেয়ে বড়। অর্থাৎ, ব্যাসার্ধ বেশি হলে, উচ্চতর তরল-চাপ ও ধীর গতির ঘূর্ণি হয় এবং ব্যাসার্ধ ছোট হ'লে, চাপ হয় নিম্নতর ও গতি হয় দ্রুত। এ সমস্তই বার্নোলির নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

উল্লেখযোগ্য উদাহরণ

অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ, নদীর কানেক্টিকাট তীরে, থমাস কোল

কৃত্রিম অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ[সম্পাদনা]

নৌচলাচল উন্নতি করতে বা বন্যা নিরসনের জন্য যখন কোনও নদী নালা কৃত্রিমভাবে সোজা করা হয় তখন অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ গঠিত হতে পারে। উল্লেখযোগ্যভাবে এমন ঘটেছিল উনিশ শতকে জার্মানির উচ্চ রাইন-এ।[৮]

সম্পূর্ণ কৃত্রিম জলপথে অশ্বখুরাকৃতি হ্রদের একটি উদাহরণ হ'ল ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড খাল। যখন এটি নির্মিত হয়, তখন মূলত জমির প্রাপ্তি অনুসারে খুব আঁকাবাঁকা পথ অনুসরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু ১৮২৯ এবং ১৮৩৪ এর মধ্যে খালের উত্তর অংশটি সোজা করায় দৈর্ঘ্য প্রায় ৯১ থেকে ৭৭.৫ মাইল (১৪৬ থেকে ১২৫ কিমি) হ্রাস পেয়ে ছিল। ফলে নতুন কোর্স থেকে বিচ্ছিন্ন বেশ কয়েকটি অশ্বখুরাকৃতি আকারের ভাগ তৈরি হয়েছিল।[৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Oxbow"Oxford English Dictionary। ২০০৭-০৯-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১০-২৭ 
  2. "Oxbow"Merriam–Webster। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১০-২৭ 
  3. Dhingra, Rajani D.; Barnes, Jason W.; Yanites, Brian J.; Kirk, Randolph L. (২০১৮-০১-০১)। "Large catchment area recharges Titan's Ontario Lacus"। Icarus (ইংরেজি ভাষায়)। 299: 331–338। আইএসএসএন 0019-1035ডিওআই:10.1016/j.icarus.2017.08.009 
  4. Hickin, Edward J (২০০২)। "Meandering Channels"। Middleton, Gerard V.। Encyclopedia of Sediments and Sedimentary Rocks। New York: Springer। পৃষ্ঠা 432। আইএসবিএন 1-4020-0872-4 
  5. Constantine, J. A.; Dunne, T. (২০০৮)। "Meander cutoff and the controls on the production of oxbow lakes"Geology36 (1): 23–26। ডিওআই:10.1130/G24130A.1 
  6. Bowker, Kent A. (১৯৮৮)। "Albert Einstein and Meandering Rivers"Earth Science History1 (1)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৭-০১ 
  7. Chant, R. J. (২০০২)। "Secondary circulation in a region of flow curvature: Relationship with tidal forcing and river discharge"। Journal of Geophysical Research107 (C9): 14–1–14–11। ডিওআই:10.1029/2001JC001082 
  8. Zinke, Alexander (ডিসেম্বর ১৭, ২০০০)। "The New Management of Rivers and Wetlands in Central Europe"। Zinke Environmental Consulting। জানুয়ারি ৭, ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১০-২৭ 
  9. Boughey, Joseph (১৯৯৪)। Hadfield's British CanalsSutton Publishingআইএসবিএন 0-7509-1840-3