অরন্ধন
অরন্ধন কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল, যে দিন রন্ধন নিষিদ্ধ। তবে 'অরন্ধন' বা 'রান্নাপুজো' হিন্দুদের এক ঐতিহ্যবাহী পার্বণ বা উৎসব। এটি মূলত পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে পালিত হয়। পূজার আগের দিন রাত্রিতে রান্না করে সেই বাসি খাবার আচারবশত পরেরদিন খাওয়ার রীতি হল 'অরন্ধন'।
উৎসব পালনের দিন ও প্রকারভেদ[সম্পাদনা]
পশ্চিমবঙ্গে বছরে দু'বার 'অরন্ধন' উৎসব পালিত হয়। একবার মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী তথা সরস্বতী পূজার পরের দিন শীতলষষ্ঠীতে। এটিকে কোথাও কোথাও শিলনোড়া পূজার দিনও বলা হয়ে থাকে। আরেকটি, ভাদ্র সংক্রান্তিতে মনসা পূজার দিন।[১] মনসা পূজার অবিচ্ছেদ্য অংশই হল - 'অরন্ধন' উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের স্থানভেদে বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসব্যাপী যে কোন শনিবার বা মঙ্গলবারে এবং নাগপঞ্চমী হতে প্রতি পঞ্চমী তিথিতে মনসাদেবীর পূজা আরম্ভ হয় এবং ভাদ্র সংক্রান্তিতে মনসাদেবী ও অষ্টনাগপূজা সমাপন ও ভাসান হয়। [২] সেই উপলক্ষে আচারবশত সংক্রান্তিতে পালিত হয় 'অরন্ধন'। এই অরন্ধনটিকে ভাদ্রে রেঁধে আশ্বিনে খাওয়ার উৎসব-ও বলা হয়ে থাকে। ভাদ্র সংক্রান্তির আগের দিন রান্না করে, সংক্রান্তিতে মা মনসাকে উৎসর্গ করে তবে খাওয়া হয়। প্রাচীন রীতি অনুসারে, আগে তিথি অনুযায়ী, আশ্বিন মাস পড়লে তবেই সেই বাসি খাবার মুখে তুলতেন গৃহস্থেরা।[৩] যেহেতু ভাদ্র মাসের বিভিন্ন দিনে বা তিথিতে পূজার ব্যবস্থা আছে, সেই মত পূজার ব্যবস্থা অনুযায়ী অরন্ধন কোথাও ইচ্ছারান্না, কোথাও বা ধরাটে রান্না বা আটাশে রান্না হিসাবেও পালিত হয়। বিশ্বকর্মা পূজার দিন পালিত হলে সেই অরন্ধনটিকে ‘বুড়োরান্না’ বলা হয়ে থাকে।
পূজার ব্যবস্থা ও উপকরণ[সম্পাদনা]
পাকশাল বা হেঁশেলের উনানের গর্তই হল মা মনসার প্রতীক। হিন্দু গৃহিনীরা পরিবারের কল্যাণার্থে ও সর্পভয় হতে পরিত্রাণ পেতে পাকশালের একস্থানে শালুক ও ফণিমনসা গাছের ডাল দিয়ে মনসার ঘট স্থাপন করেন। আবার গোত্র ও অঞ্চল ভেদে মনসা পূজার প্রতিমাতেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কেউ মনসা দেবীর প্রতিমা বানিয়ে, আবার কেউ কেউ পঞ্চ সর্পের ফণাযুক্ত প্রতিমার পূজা করেন। [৪]পূজার আগের দিন রান্নাকরা খাবারের বিভিন্ন পদের কিছু অংশ সাজিয়ে উৎসর্গ করেন দেবীকে। তবে মরসুমের সেরা সব্জি ও মাছ আরাধ্য দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করাই এই উৎসবের প্রধান রীতি। বাসি খাবারের মধ্যে পান্তা ভাত উল্লেখযোগ্য। যারা নিরামিষাসী তাদের বাড়িতে নিরামিষ রান্নাপূজা হয়। তবে বেশিরভাগ গৃহেই আমিষ রান্নার প্রচলন। আমিষের মধ্যে মরসুমের ইলিশ-চিংড়ি মাছ অন্যতম। এছাড়াও আরও ভিন্ন ধরনের মাছ থাকে তালিকায়। নিরামিষ পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- আলু, ছাঁচি কুমড়ো, কলা, পটল, নারকেল, বেগুন, কুমড়ো, কচুর শাক, নারকেল প্রভৃতির রকমারি ভাজা, ছোলা-নারকেল দিয়ে কচু শাক সহ একাধিক শাক, মুগ ও খেসারির ডাল, চালতা-গুড় দিয়ে চাটনি, তালের বড়া, মালপোয়া ইত্যাদি। আমিষ রান্নায় মাছ থাকলেও পেঁয়াজ-রসুন কোন পদে ব্যবহৃত হয়না। অরন্ধনের সব রান্নাই করা হয় অল্প জলে, যাতে গরমে নষ্ট না হয়ে যায়। অরন্ধনের জন্য রান্নার সময় উনানের আঁচ সাধারণত একটানা জ্বলাই রীতি বা নিয়ম। [৫] বাংলার ধর্মপরায়ণ রমণীকুল পূজা বারব্রত উপলক্ষে উপোসী থেকে পূজাসমাপনান্তে দেবীর ব্রতকথা পাঠ বা শ্রবণ করে থাকেন।
বর্তমানকালে গুরুত্ব[সম্পাদনা]
বর্তমানে অরন্ধন উৎসবের স্বাভাবিক মেজাজ ও রীতিনীতি অনেকটা শিথিল হয়েছে আধুনিককালের কর্ম ব্যস্ততার কারণে। তবে গ্রামাঞ্চল বা শহরতলিতে এখনও এই পার্বণ বা উৎসব ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়। তবে অরন্ধন বা রান্নাপূজা মূলত পশ্চিমবাংলার আদি বাসিন্দারাই পালন করেন। এটি পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি হিন্দুদের রীতি নয়।
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- ↑ "ভাদ্রে রেঁধে আশ্বিনে খাওয়া! জানুন রান্না পুজোর সব খুটিনাটি"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৭।
- ↑ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা, ভাদ্র মাসের উৎসব
- ↑ "ভাদ্রে রেঁধে আশ্বিনে খাওয়ার উৎসব 'অরন্ধন', রইল তথ্য"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৭।
- ↑ "রান্না পুজো বা অরন্ধন ব্রতের ইতিহাস জানেন কি?"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৮।
- ↑ "নারকেল দিয়ে চালকুমড়ো, ইলিশ কচুশাক-সহ পান্তা, চালতার টক, অরন্ধনের নিমন্ত্রণ আজও আসে"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৭।