মিঠাপানির হাইড্রা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

মিঠাপানির হাইড্রা
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস সম্পাদনা করুন
জগৎ/রাজ্য: অ্যানিম্যালিয়া (Animalia)
পর্ব: নিডারিয়া (Cnidaria)
শ্রেণি: Hydrozoa
বর্গ: Anthoathecata
পরিবার: Hydridae
গণ: Hydra
পালাস, ১৭৬৬[১]
প্রজাতি: H. vulgaris
দ্বিপদী নাম
Hydra vulgaris

পালাস, ১৭৬৬[১]
প্রতিশব্দ
  • Hydra attenuata
  • Hydra magnipapillata [২]

হাইড্রা ভালগ্যারিস (Hydra vulgaris) বা মিঠাপানির হাইড্রা একটি মিঠাপানির পলিপ জাতীয়[৩], ক্ষুদ্রাকৃতির হাইড্রোয়েড যার দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ৩০ মিলিমিটার এবং প্রস্থ প্রায় ১ মিলিমিটার।[৪] এই প্রজাতির হাইড্রা সাধারণত স্রোতহীন মিঠাপানিতে বাস করে।[৫] অন্যান্য হাইড্রার প্রজাতির মতই মিঠাপানির হাইড্রা কর্ষিকা ব্যবহার করে খাদ্যগ্রহণ করে। কর্ষিকার সাহায্যে ডিগবাজি দিয়ে অথবা সংকোচন প্রসারণের মাধ্যমে অবস্থান পরিবর্তন করে। মিঠাপানির হাইড্রা একটি আদর্শ জীব, এর পুনরুজ্জীবন ক্ষমতা আছে। পুনরুজ্জীবন ছাড়াও প্রজাতিটি যৌন জনন ও অংকুরোদগমের মাধ্যমে প্রজনন করে থাকে। ১৭৬৬ সালে জীববিজ্ঞানী পিটার সিমোন পালাস এই প্রজাতিটির দ্বিপদ নামসহ বর্ণনা করেন। প্রজাতিটি বাংলাদেশের বিভিন্ন জলাশয়ে বহু পরিমাণে দেখা যায়।[৬]

বর্ণনা[সম্পাদনা]

৬ কর্ষিকা সহ একটি মিঠাপানির হাইড্রা

মিঠাপানির হাইড্রা'র দেহ অরীয় প্রতিসম, নলাকার।[৫] এদের মুখের ঠিক বাহিরে চক্রাকারে সাধারণত চার থেকে বারোটি কর্ষিকা থাকে। এরা মাংসাশী; কর্ষিকা প্রসারণ এবং কর্ষিকায় খাদ্য আটকের মধ্যমে খাবার গ্রহণ করে থাকে। কর্ষিকায় খাবার আটকে গেলে তা মুখের কাছে নিয়ে আসে, গলধারণ ও হজম করে। যে খাদ্য বা খাদ্যকণা হজম করতে পারেনা, তা বের করে দেয়। হাইড্রা তাদের খাদ্যগ্রহণ, অপাচ্য বর্জ্যত্যাগ একই মুখগহবরের মাধ্যমে করে থাকে।[৪][৭]

অন্যান্য হাইড্রা'র মত মিঠাপানির হাইড্রা কোন বস্তুকে তাদের চাকতির ন্যায় প্যাডের মত 'পদতল' দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকে। অবস্থান পরিবর্তনের জন্য হাইড্রা, এটির আঁকড়ে থাকা বস্তু হতে প্যাড গুলি আলগা করে এবং পানির প্রবাহে নিজেকে ছেড়ে দেয়। মিঠাপানির হাইড্রা বাঁকা হয়ে কর্ষিকা দিয়ে পৃষ্ঠতল ধরে এবং 'পা' সদৃশ্য প্যাড গুলি আলগা করে ডিগবাজি দিয়েও অবস্থান পরিবর্তন করে।[৪] এছাড়াও হাইড্রা, দেহ সংকোচন প্রসারণের মাধ্যমে চলাচল করতে পারে।[৬][৭]

আদর্শ জীব[সম্পাদনা]

অন্যান্য অনেক হাইড্রা'র প্রজাতির মত, দেহের হারানো বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনরায় সৃষ্টি বা পুনরুজ্জীবিত হওয়ার ক্ষমতা আছে।[৬] এই প্রজাতিটির যত্ন নেয়া সহজ, বাঁচিয়ে রাখার জন্য অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে হয়না এবং তুলোনামূলক দ্রুত পুনর্জনন করার বৈশিষ্ট্য থাকায় মিঠাপানির হাইড্রাকে আদর্শ জীব হিসেবে গণ্য করা হয়। জানা যায় যে, মিঠাপানির হাইড্রা বার্ধক্যে উপনীত হয়না। এরা তাদের অকেজো বা ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গে কর্ষিকার মধ্যে থাকা স্টেম কোষগুলোর দ্রুত পুনঃপুনঃ বিভাজনের মাধ্যমে সেই অঙ্গটি সৃষ্টি করে নেয়;[৮] যা এই প্রজাতিটিকে জৈবিকভাবে অমর হিসেবে অভিযোজিত করেছে,[৯] যদিও হাইড্রা'র অমরত্ব নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে।[১০]

প্রজনন[সম্পাদনা]

১৮৭৯ সালের মাসিক জনপ্রিয় বিজ্ঞান পত্রিকায় হাইড্রার পর্যালোচনা, 'b' চিত্রে দুইটি শুক্রাশয় ও একটি ডিম্বাশয় সহ হাইড্রাকে দেখানো হয়েছে।

মিঠাপানির হাইড্রা প্রজনন প্রক্রিয়া সাধারণত ঋতু, পানির তাপমাত্রায় ও পানিতে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রার উপর নির্ভর করে; যৌন প্রজননঅযৌন জনন- দুই উপায়ে প্রজনন করতে পারে।[৬][১১] অযৌন উপায়ে প্রজনন হয় মুকুলোদগম ও পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে।[৭][১১]

হাইড্রার যৌন প্রজনন সাধারণত অন্যান্য উপায়ের চেয়ে কম হয়। সাধারণত গ্রীষ্ম ও শরত ঋতুতে মিঠাপানির হাইড্রাকে যৌন জনন করতে দেখা যায়।[৭] এক্ষেত্রে একই হাইড্রার দেহে দেহকাণ্ডের উপরে মোচাকৃতির শুক্রাশয় এবং দেহকাণ্ডের নিচের দিকে দুটি গোলাকৃতির ডিম্বাশয় তৈরী হয়। শুক্রাশয় হতে নির্গত শুক্রানু, ডিম্বাশয়ের ডিম্বকোষে প্রবেশ করার পর গঠিত জাইগোটের চারপাশে একটি শক্ত আবরণ তৈরী হয়, যা নতুন হাইড্রা জন্ম দেয়ার জন্য অনুকূল পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করে।[১১]

মিঠাপানির হাইড্রা অনুকূ্ল পরিবেশে অংকুরোদগমের মাধ্যমে প্রজনন করে। অংকুরোদগমের জন্য পানির তাপমাত্রা ও খাদ্যের পর্যাপ্ততা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। অংকুরোদগম পদ্ধতিতে প্রজননের ক্ষেত্রে সাধারণত দুই থেকে চারদিন সময় লাগে।[৭] মিঠাপানির হাইড্রা এই পদ্ধতিতে সচরাচর প্রজনন করে, কারণ এভাবে সহজে অন্যান্য পদ্ধতিতে জননের চেয়ে বেশি হাইড্রা জন্ম দেয়া যায়। এক্ষেত্রে পূর্ণ সক্ষম হাইড্রার দেহ হতে নতুন হাইড্রার অঙ্কুর সৃষ্টি হয়, একসময় অঙ্কুরটি বড় হয়ে জননকারী হাইড্রা হতে আলাদা হয়ে যায়।[৭]

প্রজননের তৃতীয় পদ্ধতিটি জননের চেয়ে বেশি টিকে থাকার পদ্ধতি হিসেবে গণ্য। যখন কোন হাইড্রাকে খন্ডিত করা হয়, প্রতি খন্ড হতে, প্রতি খন্ডের তুলোনামূলক আকৃতির আরেকটি নতুন হাইড্রার পুনরুজ্জীবন ঘটে। এই বৈশিষ্ট্য তারামাছেও বিদ্যমান।[১১]

নামকরণের ইতিহাস[সম্পাদনা]

১৭৫৫ সালে প্রকৃতিবিদ অগাস্ট জোহান রোসেল ভন রোসেলহফ মিঠাপানির চারটি পলিপের বর্ণনা দেন, এই পলিপ প্রজাতি গুলির মধ্যে একটি কমলা-হলুদ বর্ণের লম্বা কর্ষিকাযুক্ত, দ্বিতীয়টি বাদামী বর্ণের, তৃতীয়টি সবুজ বর্ণের এবং চতুর্থটি ফ্যাকাশে অপেক্ষাকৃত ছোট কর্ষিকাযুক্ত। ১৭৬৬ সালে পিটার সিমোন পালাস, রোসেলহফের উল্লিখিত অনুজীব গুলিকে যথাক্রমে Hydra vulgaris (মিঠাপানির হাইড্রা), Hydra oligactis (বাদামী হাইড্রা), Hydra viridissima (সবুজ হাইড্রা)ও Hydra attenuata (ফ্যাকাশে হাইড্রা) দ্বিপদীনামসহ বর্ণনা করেন। এই নামগুলি এখনও স্বীকৃত। ১৭৬৭ সালে উদ্ভিদ ও প্রানীদের দ্বিপদ নামকরণ সংকলন সিস্টেমা ন্যাচারাই-এর দ্বাদশ সংস্করণে ক্যারোলাস লিনিয়াস এই প্রজাতিগুলিকে যথাক্রমে Hydra grisea , Hydra fusca ,Hydra viridisHydra pallens নামে প্রকাশ করেছিলেন। বিভিন্ন জীব বর্ণনাকারী পরবর্তীতে হাইড্রার অন্যান্য প্রজাতির বর্ণনা দিতে পালাস ও লিনিয়াসের প্রদত্ত নামগুলির অসঙ্গত ব্যবহার করেছিলেন। ফলে বিংশ শতাব্দীতে এসে এই চার প্রজাতির হাইড্রার দ্বিপদ নাম নির্ধারণে ব্যাপক অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। মিঠাপানির পলিপদের জৈবিকাচার স্পষ্টকরণে বেশ কয়েকটি চেষ্টার পর, বিদ্যমান জ্ঞানের আলোকে,প্রাণীবিদ পল শুলজ ১৯১৭ সালে তার একটি পদ্ধতিগত পর্যালোচনার সংক্ষিপ্তসারে Hydra vulgaris নামটি একই দেহে পুরুষ ও স্ত্রী যৌন বৈশিষ্ট্যের একটি বিরল প্রজাতিকে দিয়েছিলেন। তবে মিঠাপানির হাইড্রা ও ফ্যাকাশে হাইড্রা'র জন্য পালাসের দেয়া বৈজ্ঞানিক বা দ্বিপদ নাম স্পষ্ট করেননি। পরবর্তীতে তিনি তার আরেকটি পর্যালোচনায় এই প্রজাতি দুইটিকে একই প্রজাতির দুইটি উপ-প্রজাতি হিসেবে পালাসের নামকরণ অনুসারে Hydra vulgaris vulgaris এবং Hydra vulgaris attenuata হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। একারণে পুরনো গবেষণা সাময়িকীতে Hydra vulgaris-কে কখনো কখনো Hydra vulgaris attenuata অথবা শুধু Hydra attenuata নামে বর্ণনা করা হয়েছে। অবশেষে ১৯৮৯ সালে ডক্টর রিচার্ড ডি ক্যাম্পবেল পালাস বর্ণিত মিঠাপানির হাইড্রার প্রজাতির বর্ণনা স্পষ্ট ও সঠিক প্রমাণ করেছিলেন।[১২]

ভৌগোলক বিস্তৃতি[সম্পাদনা]

মিঠাপানির হাইড্রা সাধারণত ৭° হতে ২৯° ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় অ্যান্টার্ক্টিকা মহাদেশ বাদে[১৩] বিশ্বজুড়ে মিঠাপানির যেকোন জলাশয়ে দেখা যায়।[১৪] এটি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে প্রাপ্ত হাইড্রার প্রজাতি।[৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Schuchert, P. (২০১১)। P. Schuchert, সম্পাদক। "Hydra vulgaris Pallas, 1766"World Hydrozoa databaseWorld Register of Marine Species। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-১২-১৮ 
  2. Hydra vulgaris ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ অক্টোবর ২০২১ তারিখে, NCBI.
  3. Paola Pierobon, Angela Tino, Rosario Minei, Giuseppe Marino. Different roles of GABA and glycine in the modulation of chemosensory responses in Hydra vulgaris (Cnidaria, Hydrozoa), Coelenterate Biology 2003. Springer Netherlands. DOI: 10.1007/978-1-4020-2762-8_7.
  4. Hydra ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৩-১২-২৫ তারিখে, Northern State University.
  5. "হাইড্রা"অনুশীলন। ২০২২-০৩-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০১ 
  6. "হাইড্রাঃ পর্ব-১ (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য ও বহিঃত্বক)"বিডিফিশ বাংলা। ২০২০-১১-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০১ 
  7. "Hydra and Hydrozoa"cronodon.com। ২০২০-১১-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০১ 
  8. "অমর জীব হাইড্রা"দৈনিক যায়যায়দিন। ২০১৯-১০-২৬। ২০২০-১১-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০১ 
  9. Martinez, D.E. (মে ১৯৯৮), "Mortality patterns suggest lack of senescence in hydra." (পিডিএফ), Experimental Gerontology, 33 (3): 217–225, ডিওআই:10.1016/S0531-5565(97)00113-7, পিএমআইডি 9615920, সাইট সিয়ারX 10.1.1.500.9508অবাধে প্রবেশযোগ্য, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০২০ 
  10. Estep, P. W. (সেপ্টেম্বর ২০১০)। "Declining asexual reproduction is suggestive of senescence in hydra: comment on Martinez, D., "Mortality patterns suggest lack of senescence in hydra.""। Experimental Gerontology45 (9): 645–6। ডিওআই:10.1016/j.exger.2010.03.017পিএমআইডি 20398746 
  11. Working with Hydra ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ নভেম্বর ২০২০ তারিখে, Ward's Science 2002.
  12. Campbell, Richard D. (১৯৮৯)। "Taxonomy of the European Hydra (Cnidaria: Hydrozoa): a re-examination of its history with emphasis on the species H. vulgaris Pallas, H. attenuata Pallas and H. circumcincta Schulze"। Zoological Journal of the Linnean Society . tape 95 , no. 33: ২১৯-২৪৪। 
  13. James H. , D. Christopher Rogers (Eds.):, Thorp; Rogers (Eds.):, D. Christopher (২০১৪)। Thorp and Covich's Freshwater Invertebrates: Ecology and General Biology. Volume 1 of Thorp and Covich's Freshwater Invertebrates। Elsevier। পৃষ্ঠা ১৬২। আইএসবিএন 9780123850270 
  14. Thomas Holstein, Peter Emschermann: Cnidaria,, Kamptozoa . In: J. Schwoerbel, P. Zwick (ed.): (১৯৯৫)। Freshwater fauna of Central Europe . tape 1/2 + 3 .স্টুটগার্টনিউ ইয়র্ক: Gustav Fischer Verlag, Jena,। পৃষ্ঠা ৮২–৮৮। আইএসবিএন 3437306251