জাস্টিন মার্টারের প্রথম কৈফিয়ত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

প্রথম কৈফিয়ত বা ফার্স্ট অ্যাপোলজি (First Apology) হচ্ছে জাস্টিন মার্টারের (১০০-১৬৫ খ্রিস্টাব্দ) লেখা খ্রিস্টীয় কৈফিয়তমূলক রচনা বা খ্রিস্টীয় অ্যাপোলজেটিক্স যা তিনি রোমান সম্রাট অ্যান্টনিয়াস পায়াসের (৮৬-১৬১ খ্রিস্টাব্দ) উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে তিনি কেবল খ্রিস্টান হবার জন্য একজন ব্যক্তিকে নির্যাতন করার বিরুদ্ধে যুক্তি দেন এবং সমসাময়িক খ্রিস্টীয় দর্শন, ধর্মীয় অনুশীলন ও আচারের ব্যাখ্যা দেন। তার প্রথম কৈফিয়ত ও দ্বিতীয় কৈফিয়ত - এই দুটি গ্রন্থকে খ্রিস্টীয় কৈফিয়তের সর্বপ্রথম উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়, এবং অনেক পণ্ডিত এই কাজকে একটি সাধারণ রোমান প্রশাসনিক কৈফিয়তের বাইরে কৈফিয়তের এক নতুন ধারার সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন।[১]

জাস্টিন মার্টারের জীবন এবং পটভূমি[সম্পাদনা]

জাস্টিন মার্টার তদকালীন রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত জুডিয়ার গ্রিক-ভাষী শহর ফ্লেভিয়া নিয়াপলিসে (আধুনিক নাবলুস) জন্মগ্রহণ করেন। [১] তিনি তার ডায়ালগ উইথ ট্রাইফো গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন যে কীভাবে তিনি পূর্বের স্টোইকবাদ, পেরিপেটেটিকবাদ এবং পিথাগোরীয়বাদ সম্প্রদায় হয়ে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হলেন। তিনি সেই গ্রন্থে সংলাপের আকারে উল্লেখ করেন, "তার মধ্যে ঈশ্বরের দূতদের ভালোবাসা এবং খ্রিস্টের বন্ধুরা ভর করেছে।" দর্শনের সাথে খ্রিস্টধর্মের সমীকরণ জাস্টিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এখানে খ্রিস্টধর্মকে রক্ষা করার জন্য দার্শনিক পদের দ্বারা কৈফিয়তের গুরুত্বকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

মিশরের প্রিফেক্ট ফেলিক্সের নথি অনুসারে প্রথম কৈফিয়ত গ্রন্থের সময়কাল নির্ণয় করা হয়েছে ১৫৫-১৫৭ খ্রিস্টাব্দ। রবার্ট গ্রান্ট দাবি করেছেন যে এই কৈফিয়তটি মার্টারডম অফ পলিকার্প গ্রন্থের প্রতিক্রিয়ায় রচিত হয়, যা এই কৈফিয়তটি রচনার সময়েই সংঘটিত হয়েছিল। এই সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করে যে কেন এই কৈফিয়তটি বিশেষ করে আগুনে পোড়ানোর মাধ্যমে শাস্তির দিকে মনোনিবেশ করেছিল, যা পলিকার্পকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার সূত্রকে নির্দেশ করে। এও সাধারণত মনে করা হয় যে, দ্বিতীয় কৈফিয়ত মূলত বৃহত্তর প্রথম কৈফিয়ের অংশ ছিল, যদিও এই বিষয়টি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

প্রথম কৈফিয়তের মূলভাব[সম্পাদনা]

খ্রিস্টানদের প্রতি সমালোচনাকে নির্দেশ[সম্পাদনা]

প্রথম কৈফিয়তের প্রথম অধ্যায়গুলিতে জাস্টিন সমসাময়িক খ্রিস্টানদের প্রতি মূল সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করেছেন; যথা, নাস্তিক্যবাদ, অনৈতিকতা এবং সাম্রাজ্যের প্রতি অবিশ্বস্ততা। তিনি প্রথমে যুক্তি দিয়েছিলেন যে খ্রিস্টধর্মের "নাম" নিজেই শাস্তি বা তাড়না দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কারণ নয় এবং তিনি সাম্রাজ্যকে এর পরিবর্তে কেবল দুষ্ট কাজের জন্য শাস্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে তিনি লেখেন, "কারণ নাম থেকে অনুমোদন বা শাস্তি কোনকিছুই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা যদি না তার সাথে কোন ভাল বা মন্দ কর্ম জড়িত থাকে।" তারপরে তিনি অভিযোগগুলিকে আরও সরাসরি সম্বোধন করেন, যার মধ্যে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে তারা রোমান দেবতাদের প্রতি “নাস্তিক” তবে “সত্যিকারের ঈশ্বরের” প্রতি নয়। তিনি স্বীকার করেন যে কিছু খ্রিস্টান অনৈতিক কাজ করেছে, কিন্তু তিনি কর্মকর্তাদেরকে এই ব্যক্তিদেরকে খ্রিস্টান নয় বরং অপরাধী হিসাবে শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানান। এই দাবির সাথে জাস্টিন খ্রিস্টান নামটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা সম্পাদিত দুষ্ট আচরণ থেকে আলাদা করার জন্য তার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন এবং বলেন অপরাধীরা খ্রিস্টধর্মের নামকে কলুষিত করছে এবং এরা সত্য "খ্রিস্টান" নয়। অবশেষে, তিনি খ্রিস্টানদের যে সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করার জন্য অভিযোগ করা হয় তা নিয়ে আলোচনা করেন, তিনি বলেন কীভাবে খ্রিস্টানরা কোন রাজ্যের নাগরিক হতে চায়, কিন্তু সেই রাজ্য মানুষের নয় বরং ঈশ্বরেরই।

লোগোস হিসাবে যীশু খ্রিস্ট[সম্পাদনা]

যুক্তিবাদী দর্শন হিসাবে খ্রিস্টধর্মকে রক্ষা করার জন্য জাস্টিন তার প্রথম কৈফিয়তে অনেক কিছুই লেখেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে একজন খ্রিস্টান কীভাবে তার অনুসারীদের জন্য নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে পারে, এবং খ্রিস্টান শিক্ষাগুলির সাথে পৌত্তলিক পুরাণসমূহের কত নিবিড় সমান্তরালতা রয়েছে, যার কারণে পৌত্তলিকদের দ্বারা সমসাময়িককালে খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন করাকে তিনি অযৌক্তিক দাবি করেন।

জাস্টিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সারগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে লোগোস এর বিবরণ। লোগোস হচ্ছে যুক্তি এবং জ্ঞানের শৃঙ্খলার একটি দার্শনিক ধারণা। প্রথম কৈফিয়ত জুড়ে, জাস্টিন যুক্তি দিয়েছিলেন যে যীশু খ্রীষ্ট হ'ল লোগোসের অবতার, যা তাকে এই প্রমাণের দিকে নিয়ে যায় যে, যে ব্যক্তিই কখনও যুক্তি দিয়ে কথা বলেছেন, এমনকি তারা যদি খ্রিস্টের পূর্বেও বাস করে থাকেন, তারাও খ্রিস্টের আকারে লোগোসের সাথে সংযুক্ত ছিলেন, আর তাই তারা এইভাবে খ্রিস্টানই ছিলেন।[২]

এই সারটি জাস্টিনের খ্রিস্টধর্মের প্রতিরক্ষা বোঝার পক্ষে সর্বাত্মক, এবং খ্রিস্টান কৈফিয়ত রচনায় একটি যুগান্তকারী বক্তব্য ছিল। "লোগোস" শব্দটির ব্যবহারটি ইঙ্গিত দেয় যে জাস্টিন সম্ভবত পূর্ববর্তী দার্শনিক শিক্ষাগুলির দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন,[৩][৪] তবে জাস্টিন যুক্তি দেখান যে এই শিক্ষাগুলি কেবলমাত্র আংশিক সত্যকেই উপস্থাপন করে কারণ তারা সামগ্রিক লোগোসের কেবলমাত্র একটি অংশের সাথে যুক্ত ছিল। জাস্টিনের জন্য, খ্রিস্টধর্ম সম্পূর্ণ সত্যের (লোগোস) প্রতিনিধিত্ব করে, যার অর্থ খ্রিস্টধর্ম কেবল একটি অর্থবোধক দর্শনই নয়, এটি জ্ঞান এবং যুক্তির সর্বোচ্চ স্তর অর্জনের জন্য পূর্বের চিন্তাগুলোকে পরিপূর্ণ ও সংশোধন করে।

চার্চের প্রাথমিক অনুশীলন[সম্পাদনা]

প্রথম কৈফিয়ত সমসাময়িক খ্রিস্টান অনুশীলন সম্পর্কিত সর্বাধিক বিস্তারিত বিবরণগুলোর মধ্যে একটি। যারা অভিসিঞ্চিত হয় "তাদেরকে আমরা সেখানে নিয়ে আসি যেখানে জল আছে," সেখানে "তাদের পুনর্জন্ম হয় যেমনটা আমাদের হয়েছিল"।[৫] অভিসিঞ্চন বা বাপ্টিজম নিয়ে আলোচনার পরে, জাস্টিন তার ট্রান্সাবস্ট্যানশিয়েশন শিক্ষার মাধ্যমে ইউক্যারিস্ট অনুশীলনের বর্ণনা দিয়েছিলেন, "এখানে আমাদের শেখানো হয় যে এই খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পার্থনাসূচকভাবে যিশুকে ধন্যাবাদ দেয়া হয়,যেখান থেকে আমাদের রক্ত ও মাংস রূপান্তরের মাধ্যমে প্রতিপালিত হয়, সেই রক্ত ও মাংসের দ্বারাই যিশু অবতারপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।"[৬] লুথার 'পবিত্র পিতাদের' তার 'চার্চের ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা' রচনায় চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।[৭] পরিশেষে, তিনি সাপ্তাহিক রবিবারের সভাগুলি সম্পর্কে তথ্য দেন, যেখানে ইহুদি নবীদের সম্পর্কিত পাঠ, ধর্মপ্রচারক বা অ্যাপস্টলদের স্মৃতিচারণ, প্রার্থনা এবং ভোজনের আয়োজন থাকে।[৮]

ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক তাৎপর্য[সম্পাদনা]

জাস্টিনের কৈফিয়ত কী পরিমাণে পূর্ব এবং ভবিষ্যতের কৈফিয়ত থেকে পৃথক হয়েছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট জাস্টিন পণ্ডিত পল পারভিস উল্লেখ করেছেন যে প্রথম কৈফিয়ত তার আগের যে কোনও কৈফিয়তের থেকে আলাদা নয়। এটি নিজেকে আইনি পিটিশন হিসাবে উপস্থাপন করে, যা একটি প্রমাণ রোমান প্রশাসনিক জঁরা যেখানে কোন অভিযুক্ত তার উপর আরোপকে পরিবর্তিত করতে চান (এই ক্ষেত্রে, খ্রিস্টানদেরকে খ্রিস্টান হবার জন্য নয় বরং খারাপ কাজের ভিত্তিতে অভিযুক্ত করার জন্য বলা হচ্ছে)। কিন্তু রচনাটিতে খ্রিস্টান অনুশীলন এবং বিশ্বাসের বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে পারভিস যুক্তি দিয়েছিলেন যে "এখানে জাস্টিন যা করেছেন তা হল স্বাভাবিক রোমান প্রশাসনিক কার্যবিধিকে হাইজ্যাক করে তা দিয়ে গসপেলের বাণী প্রচারের একটি বাহনে রূপান্তর"।[১] এডিনবার্গের সারা পারভিস আরও যুক্তি দেখিয়েছেন যে কৈফিয়তকে "খ্রিস্টধর্মের স্বপক্ষে কোন অস্পষ্ট রচনা হিসেবে" মনে না করে একে একটি আলাদা প্রকরণ হিসেবে ভাবা উচিত যা জাস্টিন মার্টার উদ্ভাবন করেছিলেন, এবং টারটুলিয়ানের মত পরবর্তীকালের লেখকেরা পরিমার্জন করেছিলেন।[৯]

সামগ্রিকভাবে সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে খ্রিস্টান অনুশীলনের ব্যাখ্যার গুরুত্বও পণ্ডিতরা লক্ষ করেন। রবার্ট গ্রান্ট উল্লেখ করেছেন যে, জাস্টিন প্রাথমিক চার্চ অনুশীলনের পিছনে ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তি সম্পর্কে খুব বেশি বিস্তারিত বিবরণ দান করেন নি। বরং তার উদ্দেশ্য ছিল "খ্রিস্টীয় জীবনের প্রকৃত প্রকৃতিঃ তুলে ধরা এবং পৌত্তলিক সমালোচকদের নিন্দিত দাবিগুলোকে খণ্ডন করা।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Parvis, Paul (২০০৮)। "Justin Martyr": 53–61। ডিওআই:10.1177/0014524608097821 
  2. 1 Apology, Ch. 46[অ-প্রাথমিক উৎস প্রয়োজন]
  3. Price, R.M. (১৯৮৮)। "'Hellenization' and Logos Doctrine in Justin Martyr": 18–23। জেস্টোর 1584467ডিওআই:10.1163/157007288X00291 
  4. Droge, Arthur J. (১৯৮৭)। "Justin Martyr and the Restoration of Philosophy": 303–19। জেস্টোর 3166060ডিওআই:10.2307/3166060 
  5. 1 Apology, Ch. 61[অ-প্রাথমিক উৎস প্রয়োজন]
  6. 1 Apology, Ch. 66[অ-প্রাথমিক উৎস প্রয়োজন]
  7. A Prelude by Martin Luther on the Babylonian Captivity of the Church, 2:26 & 2:27
  8. 1 Apology, Ch. 67[অ-প্রাথমিক উৎস প্রয়োজন]
  9. Parvis, Sara; Foster, Paul (২০০৭)। Justin Martyr and his Worlds। Fortress Press। পৃষ্ঠা 115–28। আইএসবিএন 978-0-8006-6212-7 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]