প্রজ্বলন বিন্দু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অগ্নিশিখাযুক্ত ককটেল এর প্রজ্বলন বিন্দুর মান কক্ষের স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে কম।

প্রজ্বলন বিন্দু (ইংরেজি: Flash point) হলো সেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, যাতে উদ্বায়ী পদার্থের বাষ্প প্রজ্বলিত হবে, যদি কোন উৎস থেকে এটিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

প্রজ্বলন বিন্দুকে কখনো কখনো স্বতঃপ্রজ্বলন তাপমাত্রার (Auto ignition temperature) সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়, যা প্রকৃত পক্ষে হলো সেই তাপমাত্রা যেটিতে বাষ্প কোন উৎস থেকে এতে আগুন প্রাপ্তি ছাড়াই একা প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। অগ্নি বিন্দু (Fire point) হল সেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যেখানে বাষ্প প্রজ্বলিত হতে থাকে উৎস থেকে এটিতে আগুন প্রাপ্তির পর থেকে এবং আগুনের উৎস এর থেকে সরিয়ে ফেলার পরেও। অগ্নি বিন্দুর মান প্রজ্বলন বিন্দুর মানের চেয়ে বেশি হয়, কারণ প্রজ্বলন বিন্দুর ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যভাবে আশা করা হয় বাষ্পে দেয়া আগুন থেমে যাবে যখন আগুনের উৎসটি সরিয়ে ফেলা হবে।[১] প্রজ্বলন বিন্দু কিংবা অগ্নি বিন্দু কোনোটাই সরাসরি নির্ভর করে না উৎসের আগুনের তাপমাত্রার উপর, কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে উৎসের আগুনের তাপমাত্রা হয় প্রজ্বলন বিন্দু বা অগ্নি বিন্দুর তুলনায় অনেক বেশি হয়ে থাকে।

তরল[সম্পাদনা]

প্রজ্বলন বিন্দু হল একটি বর্ণনামূলক ধর্ম যা ব্যবহার করা হয় প্রজ্বলনক্ষম তরল, যেমন: পেট্রল, ও দাহ্য তরল, যেমন: ডিজেল এর মধ্যে পার্থক্য করতে ।

এটি আরও ব্যবহার করা হয় তরলের অগ্নি দূর্ঘটনার প্রবণতার বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশে। স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহারের উপর নির্ভর করে, তরল যেগুলোর প্রজ্বলন বিন্দু ৩৭.৮ থেকে ৬০.৫ °সে (১০০.০ থেকে ১৪০.৯ °ফা) এর কম হয়ে থাকে সেগুলোকে প্রজ্বলনক্ষম তরল বলা হয়। আর যে তরলগুলোর প্রজ্বলন বিন্দু এই তাপমাত্রার উপরে সেগুলোকে দাহ্য তরল বলে।[২]

পদ্ধতি[সম্পাদনা]

প্রতিটি তরলের একটি সুনির্দিষ্ট বাষ্প চাপ থাকে, যেটা হল ঐ তরলের তাপমাত্রার একটি প্রতিক্রিয়া এবং এটি বয়েলের সুত্র মেনে চলে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে, বাষ্প চাপ বাড়তে থাকে। যখন বাষ্প চাপ বৃদ্ধি পায়, বাতাসে প্রজ্বলনশীল বা দাহ্য তরল পদার্থের বাষ্পের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। ফলাফলস্বরুপ, তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে বাতাসে প্রজ্বলনশীল তরল বাষ্প ঘনত্বের পরিমান। একটি নির্দিষ্ট ঘনত্বের প্রজ্বলনশীল বা দাহ্য তরল পদার্থের বাষ্প হলেই বাতাসে প্রজ্বলতা হওয়া সম্ভব, এটা হল প্রজ্বলতার নিম্ন সীমা, এবং এই ঘনত্ব প্রতিটি প্রজ্বলনশীল বা দাহ্য তরল পদার্থের জন্য আলাদা এবং সুনির্দিষ্ট। প্রজ্বলন বিন্দু হল সেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যে সময় যথেষ্ট পরিমাণ প্রজ্বলনশীল বাষ্প উপস্থিত থাকবে যাতে উৎস থেকে আগুন দেয়ার পর সেটিতে আগুন জ্বলতে থাকবে।

পরিমাপ[সম্পাদনা]

দুটি মৌলিক পদ্ধতি আছে প্রজ্বলন বিন্দু পরিমাপের: খোলা কাপ পদ্ধতি এবং বদ্ধ কাপ পদ্ধতি।[৩] খোলা কাপ ডিভাইসে, নমুনাটি খোলা কাপে রেখে উত্তপ্ত করা হয় এবং কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর, একটি অগ্নিশিখা তরলের পৃষ্ঠের উপর ধরা হয়। পরিমাপকৃত প্রজ্বলন বিন্দুর মানে ভিন্নতা হতে পারে, প্রকৃত পক্ষে তরলের পৃষ্ঠের কত উপরে অগ্নিশিখা ধরা হয়েছে তার উপর এটি নির্ভর করে এবং পর্যাপ্ত উচ্চতায় পরিমাপকৃত প্রজ্বলন বিন্দুর তাপমাত্রা অগ্নি বিন্দুর সঙ্গে মিলে যাবে। এ পদ্ধতির সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হল ক্লিভল্যান্ড খোলা কাপ (সিওসি) পদ্ধতি।[৪]

দুই ধরনের বদ্ধ কাপ পদ্ধতি রয়েছে: "অসমতা", যেমন পেনস্কাই-মার্টেনস পদ্ধতি, যেখানে তরলের উপরের বাষ্পের তাপমাত্রা তরলের সাথে সাম্যাবস্থায় থাকে না এবং "সমতাপূর্ণ", যেমন ক্ষুদ্র স্কেল পদ্ধতি (যা সাধারণত সেটাফ্লাস নামে পরিচিত), যেখানে ধরা হয় বাষ্পের তাপমাত্রা তরলের সাথে সাম্যাবস্থায় থাকে। এই উভয় প্রকারের ক্ষেত্রে কাপটির ঢাকনা বদ্ধ থাকে, যার মাধ্যমে আগুনের উৎস এতে আগুন দেয়া যায়। বন্ধ কাপ পরীক্ষণ পদ্ধতিতে সাধারণত খোলা কাপ পদ্ধতির তুলনায় প্রজ্বলন বিন্দুর অনেক নিম্ন মান অর্জন করা যায় (সাধারণত ৫-১০ ° সে অথবা ৯-১৮ ° ফা: নিম্ন পর্যন্ত) এবং বাষ্প চাপ কোন তাপমাত্রায় প্রজ্বলতার নিম্ন সীমায় পৌছায় তা নির্ণয়ে এটি পারতপক্ষে ভাল মান দেয়।

প্রজ্বলন বিন্দু আসলে একটি গবেষণামূলক পরিমাপ এটি কোনো মৌলিক বাহ্যিক পরিমাপ নয়। পরিমাপকৃত মান পরিমাপ যন্ত্রের উপর নির্ভর করে এবং পরীক্ষণের প্রোটোকল পরিবর্তনের সাথে সাথে এর পরিবর্তন ঘটে, তাপমাত্রা পরিবর্তনের হারের (স্বয়ংক্রিয় পরীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা) সাথে এর পরিবর্তন ঘটে, নমুনাটি সাম্যাবস্থায় আসার সময়ের উপর নির্ভর করে, নমুনার পরিমাণের উপর এবং নমুনাটি নাড়ানো হয়েছিল কিনা তার উপরও নির্ভর করে।

একটি তরলের প্রজ্বলন বিন্দু নির্ধারণের পদ্ধতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পেনস্কাই-মার্টেনস বদ্ধ কাপ পদ্ধতিটি এএসটিএম ডি৯৩, ইপি৩৪, আইএসও ২৭১৯, ডিআইএন ৫১৭৫৪, জেআইএস কে২২৬৫ এবং এএফনোর এম০৭-০১৯ এ বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। প্রজ্বলন বিন্দু নির্ধারণের ক্ষুদ্র স্কেল বদ্ধ কাপ পদ্ধতিটি এএসটিএম ডি৩৮২৮ এবং ডি৩২৭৭, ইএন আইএসও ৩৬৭৯ এবং ৩৬৮০ এবং আইপি ৫২৩ এবং ৫২৪ এ বিস্তারিত বিবরন রয়েছে।

সিইএন / টিআর ১৫১৩৮ প্রজ্বলন বিন্দু পরীক্ষণের গাইড লাইন প্রদান করে এবং আইএসও টিআর ২৯৬৬২ প্রজ্বলন বিন্দু পরীক্ষার গাইডেন্স, তথা প্রজ্বলন বিন্দু পরীক্ষার মূল দিকগুলোর আলোচনা করে।

উদাহরণ[সম্পাদনা]

জ্বালানি প্রজ্বলন বিন্দু স্বতঃপ্রজ্বলন তাপমাত্রা
ইথানল (৭০%) ১৬.৬ °সে (৬১.৯ °ফা)[৫] ৩৬৩ °সে (৬৮৫ °ফা)
গ্যাসলিন
(পেট্রল)
−৪৩ °সে (−৪৫ °ফা)[৬] ২৮০ °সে (৫৩৬ °ফা)[৭]
ডিজেল (২-ডি) >৫২ °সে (১২৬ °ফা) ২৫৬ °সে (৪৯৩ °ফা)
জেট ফুয়েল (এ/এ-১) >৩৮ °সে (১০০ °ফা) ২১০ °সে (৪১০ °ফা)
কেরোসিন >৩৮–৭২ °সে (১০০–১৬২ °ফা) ২২০ °সে (৪২৮ °ফা)
ভেজিটেবল অয়েল (ক্যানোলা) ৩২৭ °সে (৬২১ °ফা) ৪২৪ °সে (৭৯৫ °ফা)[৮]
বায়োডিজেল >১৩০ °সে (২৬৬ °ফা)

গ্যাসোলিন (পেট্রোল) জ্বালানিটি ব্যবহার করা হয় একটি স্ফুলিঙ্গ-ইগনিশন ইঞ্জিনে। এই জ্বালানিটিকে বায়ুর সঙ্গে মিশ্রণ করা হয় এর প্রজ্বলতার সীমার মধ্যে রেখে এবং সংকোচনের মাধ্যমে এটির উত্তাপ বাড়ানো হয় এবং বয়েলের সূত্র অনুসরন করে এই তাপমাত্রা এর প্রজ্বলন বিন্দুর উপরে থাকে, তারপর স্পার্ক প্লাগ দ্বারা এটিকে প্রজ্বলন করা হয়। জ্বালানিকে প্রজ্বলিত করার জন্য, এর নিম্ন প্রজ্বলন বিন্দু থাকা প্রয়োজন, কিন্তু কম্বাশন চেম্বারের থাকা পূর্বের উত্তাপের ফলে সৃষ্ট হওয়া প্রিইগনিশন রোধে, জ্বালানির একটি উচ্চ স্বতঃপ্রজ্বলন তাপমাত্রা থাকতে হবে।

ডিজেল জ্বালানির প্রজ্বলন বিন্দু পরিবর্তিত হতে পারে ৫২ থেকে ৯৬° সে: (১২৬ ° থেকে ২০৫ ° ফারেনহাইট) পর্যন্ত। ডিজেল কমপ্রেশন-ইগনিশন ইঞ্জিনে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত। বাতাসকে সংকোচিত করা হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত জ্বালানিটি স্বতঃপ্রজ্বলন তাপমাত্রার উপরে উত্তপ্ত হয়, এরপরে এটিকে উচ্চ চাপ প্রয়োগ করে স্প্রে করে ইনজেক্ট করা হয়, এ সময় বায়ু-জ্বালানির মিশ্রণটিকে প্রজ্বলতার সীমার মধ্যে রাখা হয়। একটি ডিজেল-জ্বালানি চালিত ইঞ্জিনে, কোন অগ্নি উৎস (যেমন পেট্রল ইঞ্জিনের স্পার্ক প্লাগ) থাকে না। ফলাফলস্বরূপ, ডিজেল জ্বালানির অবশ্যই একটি উচ্চ প্রজ্বলন বিন্দু এবং একটি নিম্ন স্বতঃপ্রজ্বলন তাপমাত্রা থাকতে হয়।

জেট ফুয়েলের প্রজ্বলন বিন্দুও পরিবর্তিত হতে পারে জ্বালানির উপাদানের তারতম্যের কারণে। জেট এ ও জেট এ-১ উভয়েরই প্রজ্বলন বিন্দু পরিবর্তন হয়ে থাকে ৩৮ থেকে ৬৬ °সে (১০০ থেকে ১৫১ °ফা) এর মধ্যে, যার মান কেরোসিনের মানের কাছাকাছি। এছাড়াও জেট বি এবং জেপি-৪ উভয়েরই প্রজ্বলন বিন্দু হয়ে থাকে -২৩ থেকে -১ °সে (-৯ থেকে ৩০ °ফা) এর মধ্যে।

স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন[সম্পাদনা]

সয়ংক্রিয় পেনস্কাই-মারটেন্স বদ্ধ কাপ টেস্টার এতে অন্তর্নিহিত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে। 

পদার্থের প্রজ্বলন বিন্দু নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষণের স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতির সংজ্ঞায়ন এবং বর্ণনা করা হয়েছে ১৯৩৮ সালে প্রকাশনা সংস্থা টি.এল.অ্যানিসেলি কর্তৃক প্রকাশিত সাউথ শিল্ড খ্যাতি প্রাপ্ত "সি ট্রান্সপোর্ট অফ পেট্রোলিয়াম" (ক্যাপ্টেন. পি জেন্সেন) বইয়ে। পরীক্ষণ পদ্ধতিতে সংজ্ঞায়িত রয়েছে কি কি যন্ত্রপাতি প্রয়োজন পরিমাপের জন্য, মুখ্য টেস্ট প্যারামিটার সমূহ, অপারেটরদের অথবা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির চালানোর অনুসরণীয় পদ্ধতি, এবং পরীক্ষা পদ্ধতি সূক্ষ্মতার বিষয়গুলো। একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কমিটি ও প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষণ পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ ও রচনা করে থাকে। তিনটি প্রধান প্রতিষ্ঠান হল সিইএন / আইএসও যৌথভাবে প্রজ্বলন বিন্দুর উপর কাজের গ্রুপ (জেডাব্লুউজি-এফপি), এএসটিএম ডি০২.৮বি ফ্ল্যামাবিলিটি সেকশন এবং এনার্জি ইন্সটিটিউটের টিএমএস এসসি-বি -৪ ফ্ল্যামাবিলিটি প্যানেল।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Sea Transport of Petroleum, Jansen and Hayes, Ainsley, South Shields 1938
  2. NFPA 30: Flammable and Combustible Liquids Code, 2012 Edition ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে Retrieved January 4, 2014.
  3. Jansen and Hyams.pp62
  4. "Standard Test Method for Flash and Fire Points by Cleveland Open Cup Tester", ASTM.org
  5. "Ethanol MSDS" (পিডিএফ)। জুন ১৭, ২০১৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ৪, ২০১৪ 
  6. "Flash Point — Fuels"। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ৪, ২০১৪ 
  7. "Fuels and Chemicals — Autoignition Temperatures"। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ৪, ২০১৪ 
  8. Buda-Ortins, Krystyna। "Auto-Ignition of Cooking Oils" (পিডিএফ)