চোদ্দশাক

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
চোদ্দশাক
চোদ্দশাক
ধরনভাজা
উৎপত্তিস্থলবাংলাদেশ, ভারত
অঞ্চল বা রাজ্যদক্ষিণ এশিয়া
পরিবেশনগরম
প্রধান উপকরণওল, কেও,বেতো,কালকাসুন্দা,নিম,সরষে,শালিঞ্চা,
জয়ন্তী,গুলঞ্চ,পলতা,ঘেঁটু,হিঞ্চে,শুষুনী,শেলু

চোদ্দশাক একরকমের সহযোগী-পরিবেশন পদ। প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে কালীপূজা বা দীপাবলি অর্থাৎ দিওয়ালির একদিন আগে আশ্বিন মাসের চতুর্দশী তিথিতে ভেষজগুণ সম্পন্ন বিশেষ চোদ্দ রকমের শাক খাওয়ার রেওয়াজ আছে। [১][২] বর্তমানে বিশেষ চোদ্দ রকমের শাক সুলভ না হওয়ায় যে কোনো চোদ্দ রকমের শাক খাওয়া হয়।[৩]

ঐতিহ্য[সম্পাদনা]

পঞ্জিকা মতে আশ্বিন মাসের চতুর্দশী তিথিতে কালীপূজা বা দীপাবলি অর্থাৎ দিওয়ালির একদিন আগে চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে চৌদ্দ পুরুষের আত্মাকে তুষ্ট করে অশুভ শক্তিকে দূর করার প্রথা পালন করা হয় বলে এই দিনটাকে ভূত চতুর্দশীও বলে। এক সঙ্গে অনেকগুলি প্রদীপ জ্বালিয়ে ক্ষতিকারক কীটের হাত থেকে হৈমন্তিক ফসল রক্ষা করার তাগিদে কৃষিজীবী বঙ্গবাসীকে এই উপাচার পালন করতে হত ।

কালীপুজোর সঙ্গে চোদ্দো শাকের সম্পর্ক নিয়ে কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এই প্রথার সঙ্গে শস্যদায়িনী দেবী ভাবনার যোগাযোগ রয়েছে। ভেষজবিজ্ঞানীদের মতে ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসাবে এই শাকগুলি খাওয়া হত।

বাংলার ঋতু প্রকোপ অন্য প্রদেশের থেকে বেশি হওয়ার জন্য আশ্বিনকার্ত্তিক মাস দুটিকে যমদংস্টা কাল বলা হত। তখনকার দিনে বাংলার নব্য-স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন (১৬ শতাব্দী) তার অষ্টবিংশতি তত্ত্বের অন্যতম গ্রন্থ “কৃত্যতত্ত্বে” এই সময়কাল উল্লেখ করেছেন “নিৰ্ণয়া-মৃতের” (একটি প্রাচীন স্মৃতির গ্রন্থ) অভিমত অনুসরণ করে-

"ওলং কেমুকবাস্তূকং, সার্ষপং নিম্বং জয়াং।
শালিঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলুকং গুড়ূচীন্তথা।
ভণ্টাকীং সুনিষন্নকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ,
প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্ত্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।"

[৪]

আয়ুর্বেদ[সম্পাদনা]

আয়ুর্বেদ মতে প্রাচীন বাংলায় চোদ্দো শাকগুলি ছিল পালং শাক, লাল শাক, সুষণি শাক, পাট শাক, ধনে শাক, পুঁই শাক, কুমড়ো শাক, গিমে শাক, মূলো শাক, কলমি শাক, সরষে শাক, নোটে শাক, মেথি শাক, লাউ শাক অথবা হিঞ্চে শাক।

বর্তমানে প্রাপ্ত চোদ্দ শাকের প্রাপ্তিস্থল, রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতি,রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতা নিম্নরূপ ঃ

প্রচলিত নাম ও বৈজ্ঞানিক নাম প্রাপ্তিস্থল রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতি ভোজ্য অংশ রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতা চিত্র
ওল

Amorphophallus campanulatus

বেটুমিলিক অ্যাসিড এবং স্টেরলিক যৌগ কচিপাতা এবং ডগা অর্শ, রক্ত আমাশা, বাত, চর্মরোগ, গ্যাস-অম্বল নাশক
কেও

Costus speciosus

ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা পাতা কৃমিনাশক, হজমকারক, ক্ষুধাবর্ধক
বেতো

Chenopodium album

সাধারণত আগাছার মতো জন্মায় প্রচুর পরিমাণে জৈব অ্যাসিড পাতা এবং কচি ডগা কৃমিনাশক, কোষ্ঠবদ্ধতা ও অম্বল প্রতিরোধক
কালকাসুন্দা

Senna sophera

গ্রামাঞ্চলে রাস্তার ধারে পাতা অ্যান্টি-অ্যালার্জিক, কোষ্ঠবদ্ধতা, অর্শ, ফিসচুলা, হুপিং কাশি, দাদ ইত্যাদির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়
নিম

Azadirachta indica

উষ্ণ আবহাওয়া সম্পন্ন অঞ্চল কচিপাতা কুষ্ঠ, যে কোন চর্মরোগ, জণ্ডিস, বহুমূত্র, একজিমার ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়

সরিষা

Brassica campestris

একবর্ষজীবি রবি শস্য হিসেবে শীতকালে সরিষার চাষ হয় বিটা ক্যারোটিন পাতা মানব দেহের চামড়া, যকৃত এবং চোখের পক্ষে এই শাক অত্যন্ত উপকারি

শালিঞ্চা বা শাঞ্চে

Alternanthera sessilis

সাধারণত আগাছার মতো জন্মায়, চাষও করা হয় ফাইটোস্পেরল পাতা এবং কচি ডগা সাধারণতঃ ক্ষুধাবর্ধক হিসাবে পরিচিত; এদের ব্যবহারে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়
জয়ন্তী

Sesbania sesban

পাতা উদরাময়, বহুমূত্র, শ্বেতী , জ্বর এবং কৃমি নাশকের কাজ করে;

সদ্য প্রসূতিদের জন্য এই শাক উপকারী

গুলঞ্চ
Tinospora cordifolia
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ, এতে গ্লাইকোসাইড, প্রোটিন, উপক্ষার থাকে পাতা এই শাক সেবনে বাত, রক্তচাপ, একজিমা ও জন্ডিস নির্মূল হয়। তাছাড়া গুলঞ্চ শাক পরিপাকেও সাহায্য করে
পটুক পত্র বা পলতা

Trichosanthes dioica

এর মধ্যে বিভিন্ন অত্যাবশ্যক ফ্যাটি অ্যাসিড, জৈব আসিড এবং খনিজ লবণ প্রচুর পরিমাণে থাকে। পাতা এবং ডগা এই শাক যে কোন শ্বাসের রোগে কার্যকরী। এরা রক্তবর্ধক এবং লিভার ও চামড়ার রোগ সরাতে এদের প্রভূতভাবে ব্যবহার করা হয়।
ভন্টাকি (ঘেঁটু) বা ভাঁট
Clerodendrum infortunatum
প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে পাতা ফ্ল্যাভোনয়েড থাকার জন্য এটি ক্যানসার দমনে সহায়ক। এছাড়াও কৃমি, কোলেস্টেরল, ব্লাড সুগার ও উদরাময় প্রভৃতি রোগ নিরাময়ে এই শাক সাহায্য করে।
হিলমোচিকা বা হিঞ্চে
Enhydra fluctuans
ফাইটোস্টেরল সহ বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক পদার্থ পাতা এবং কচি ডগা এই শাক ভক্ষণে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ে। শুধুমাত্র পিত্তনাশক হিসাবেই নয়, রক্তশোধক হিসাবে, ক্ষুধাবর্ধক এবং জ্বর নির্মূলকারী হিসাবে এর ব্যবহার অপরিসীম
সুনিষন্নক বা শুষুনী বা শুষনি
Marsilea quadrifolia
পাতা শুষনি শাক স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এরা নিদ্রাকারক, মেধা এবং স্মৃতিবর্ধক। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ এবং মানসিক অস্থিরতা কমানোর জন্য এই শাক ব্যবহৃত হয়।
শেলু বা শুলকা
Cordia dichotoma
টাবপিনয়েড নামক রাসায়নিক উপাদান এই সুগন্ধি শাকের পাতা খাওয়া হয় এদের ব্যবহারে হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকে। মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ বাড়াতে এবং ছোটদের পেটের রোগ সারাতে এই শাক অত্যন্ত উপকারি।

প্রস্তুত প্রণালী[সম্পাদনা]

চোদ্দ শাক রান্নার কোনও নির্দিষ্ট প্রস্তুত প্রণালী নেই। একেক জায়গায় একেক রকম ভাবে এই শাক রান্না করা হয়। আমিষ অথবা নিরামিষ যেকোনো ভাবেই এই শাক খাওয়ার রেওয়াজ আছে। এক্ষেত্রে কোথাও কালজিরে-কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, কোথাও রসুন-শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, আবার কোথাও শুধু পাঁচফোড়ন দিয়েও চোদ্দ শাক ভাজা খাওয়া হয়।

কোথাও কোথাও এই শাক শুধুই ভাজা খাওয়া হয়, অনেকক্ষেত্রে আলু বা বেগুন দিয়েও এই শাক ভেজে খাওয়ার প্রচলন আছে।[৫]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস (৯ নভেম্বর ২০১৫)। "রোগের দাওয়াই ছিল চোদ্দো শাক"। সংগ্রহের তারিখ ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ 
  2. "আজ ভূতুড়ে দিন, বিশ্বে কোথায় কীভাবে নেমে আসেন তেনারা?"আনন্দবাজার পত্রিকা। এবিপি গ্রুপ। ৩১ অক্টোবর ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ 
  3. নাথ, ডঃ সঞ্জীব (২০০৭)। "চোদ্দশাক খাওয়া"। চক্রবর্তী, ডঃ বরুণকুমার। বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ। কলকাতা: অপর্ণা বুক ডিস্ট্রবিউটার্স (প্রকাশন বিভাগ)। পৃষ্ঠা ১৬৮। আইএসবিএন 81-86036-13-X 
  4. ভট্ট্রাচার্য, আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালি। চিরঞ্জীব বনৌষধি। আনন্দ পাবলিশারস প্রাইভেট। পৃষ্ঠা ১। 
  5. "ভূতচতুর্দশীর রেসিপি: চোদ্দ শাক ভাজা"http://zeenews.india.com। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬  |ওয়েবসাইট= এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)