বিষয়বস্তুতে চলুন

আমির মিনাই

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মুঘল যুগ পরবর্তী উর্দু কবি
আমির মিনাই
জন্ম১৮২৮
লখনৌ,
মৃত্যু১৯ অক্টোবর, ১৯০০
হায়দরাবাদ, ব্রিটিশ ভারত
ছদ্মনামআমির
পেশাকবি
সময়কালমুঘল পরবর্তী যুগ
ধরনগজল, নজম্, নাত, হামদ
বিষয়প্রেম, দর্শন, আধ্যাত্মবাদ

আমির মিনাই (উর্দু: امیر مینا ئی‎‎; জন্ম: ১৯২৮ - মৃত্যু: ১৯ অক্টোবর, ১৯০০) বিখ্যাত উর্দু কবি ছিলেন। ১৮২৮ সালে লখনৌতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯০০ সালে হায়দরাবাদে মৃত্যুবরণ করেন। তার পুরো নাম আমির আহমদ মিনাই। তিনি আমির ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন। তিনি একটি কবিতায় নামের এ দ্বৈত ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন:
نام كا نام، تخلص كا تخلص ہے امير
ايک يہ وصف خداداد مرے نام ميں ہے

নাম কা নাম, তাখাল্লুস কা তাখাল্লুস হ্যায় আমির
এক ইয়ে ওয়াসাফ খোদাদাদ মেরে নাম মেঁ হ্যায়

সাধারণ মানুষ ও অভিজাত শ্রেণি সকলের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এবং তার সমকালীন গালিব ও দাগ দেহলভির মতই সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন।[][] উর্দু সাহিত্যের বড় লেখক মোহাম্মদ ইকবালও তার একজন বড় ভক্ত ছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবন

[সম্পাদনা]

আমির মিনাই ১৮২৮ সালে লখনউয়ের প্রখ্যাত ধার্মিক পণ্ডিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৌলভি করম মুহাম্মদ মিনাই লখনৌ এর সুপরিচিত ধর্মীয় পণ্ডিত ছিলেন। তার পরিবার লখনউয়ের বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত মখদুম শাহ মিনা'র উত্তরসুরি। এ সুফি সাধকের মাজার এখনো অসংখ্য মানুষের তীর্থ। মিনাই পরিবার শাহ মিনা'র এ মাজারকে ঘিরেই শতবর্ষ ধরে বসবাস করত। এজন্য এ এলাকাটি ‍‍"মিনা বাজার" বা "মহল্লা-ই-মিনাইয়ান" (মিনাইদের বাসস্থান)নামে পরিচিত। আমির লখনউয়ের ফিরিঙ্গি মহলে শিক্ষা লাভ করেন এবং ইসলামী আইনশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। তিনি আওয়াধ এর রাজকীয় কোর্টে যোগদান করেন এবং অতি উচ্চ পদে আসীন হন। পরবর্তীতে ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশদের লখনউ আক্রমণ এবং এর পরে ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার পারিবারিক বসতবাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ সময় আমির তার পরিবারের সাথে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। প্রথমে নিকটবর্তী কাকরি শহরে কবি মহসিন কাকরভি'র কাছে আশ্রয় লাভ করেন, পরে শেষপর্যন্ত রামপুর প্রদেশে বসবাস শুরু করেন। এখানে তিনি নওয়াব ইউসুফ আলী খানের বিরাট আনুকুল্য লাভ করেন। এখানে আমির বিচারকার্যে উচ্চপদ লাভ করেন এবং পরে রামপুরের চমৎকার বিশাল লাইব্রেরির প্রধান নিযুক্ত হন এবং বিখ্যাত উর্দু কবি গালিবের স্থলাভিষিক্ত হয়ে শাসকের রাষ্ট্রীয় কাব্য শিক্ষক (উস্তাদ) হন। আমির এখানে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বসবাস করেন। এরপর তিনি তার প্রিয় উর্দু অভিধান "আমির-উল-লুঘাত" এর বাকি খণ্ডগুলো প্রকাশ করার জন্য আর্থিক সহায়তা লাভের আশায় দাক্ষিণাত্যের হায়দরাবাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হায়দ্রাবাদে যাওয়ার ১ মাসের মাথায় ১৯ অক্টোবর, ১৯০০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এখানেই তিনি সমাহিত হন।

আমির মিনাইয়ের পাঁচজন পুত্র (মুহাম্মদ আহমদ মিনাই, খুরশেদ আহমদ মিনাই, লতীফ আহমদ মিনাই, মুমতাজ আহমদ মিনাই এবং মাসুদ আহমদ মিনাই) ও তিনজন কন্যা (মাসুম-উন-নিসা, এহতেশাম-উন-নিসা এবং ফাতিমা) ছিল।

কর্মজীবন

[সম্পাদনা]

আমির মিনাই ছিলেন উর্দুফার্সি ভাষার কবি। তিনি ছিলেন একাধারে অভিধান লেখক, সুফি, পণ্ডিত, সম্পাদক, গদ্য লেখক, অনুবাদক এবং ভাষা বিষয়ে সমঝদার একজন ব্যক্তি। তিনি যুক্তিবিদ্যা, আইন, গণিত, ভূগোল, চিকিৎসাশাস্ত্র, ইতিহাস, ধর্ম, সঙ্গীত এবং দর্শন অধ্যয়ন করেন। তিনি উর্দু ও ফার্সি ভাষায় ৫০টির মত বই রচনা করেন যার অধিকাংশই অপ্রকাশিত থেকে যায়।

কাব্যসাহিত্যে আমির সুপরিচিত ছিলেন তার গজল এবং নাত এর জন্য। নাত হলো হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে প্রশংসা করে রচিত কবিতা।[][] আমির নাতকে উর্দু কাব্যসাহিত্যে অন্যান্য কবিদের মধ্যেও জনপ্রিয় করে তোলেন। তখনকার সময়ের রেওয়াজ অনুযায়ী সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত একজন কবিকে নিজের গুরু নির্বাচন করে আমির তার কবি জীবন শুরু করেন। আমিরের গুরু ছিলেন লখনৌ এর প্রথম সারির কবি মুজাফফর আলী আসীর যিনি নিজে আবার উর্দু কাব্যের বড় ব্যক্তিত্ব শেখ গুলাম হামাদানি মুসাফি এর ছাত্র ছিলেন। সেই হিসাবে আমির সবসময় নিজেকে মুসাফি ঘরানার কবি হিসাবে বিবেচনা করতেন।

আমির তার সময়ের প্রধান প্রধান কবি লেখকদের সাথে বন্ধুতা তৈরি করেন। গালিব যদিও আমিরের চেয়ে কুড়ি বছরের বড় ছিলেন, তবু আমির তাকেও বন্ধুদের মধ্যে গণ্য করতেন। এর কারণ হয়তো তারা দুজনেই রামপুর রাজ দরবারের সাথে যুক্ত ছিলেন। আমিরের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা ছিল সে সময়ের বড় কবি দাঘ দেহলভীর সাথে। আমির নিজেও সে সময়ের বেশ কয়েকজন কবির গুরু ছিলেন। যার মধ্যে রিয়াজ খাইরাবাদি, জলিল মানাকপুরী, দিল শাহজাহানপুরী এবং মুজতার খাইরাবাদি আছেন। আমির মিনাই দুটি গজলের সংগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথমটি "মিরআতুল গায়েব" এবং দ্বিতীয়টি সনমখানা-ই-ইশক। তিনি "খায়াবান-ই-আফ্রীনিশ এবং "মাহামিদ-ই-খাতামুন-নবীউন" নামে গদ্য ও পদ্য প্রকাশ করেন। খুব অল্প কয়েকজন উর্দু কবিই আমির মিনাইয়ের মত এত বেশি জনপ্রিয় হতে পেরেছেন।

আমির-উল-লুঘাত নামে বহুখণ্ডের বিস্তারিত উর্দু অভিধান প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ছিলেন আমির মিনাই। তার দলে সেই সময়ের বিখ্যাত উর্দু কবি ও লেখকগণ যেমন রিয়াজ খাইরাবাদি, জলিল মানাকপুরি, ওয়াসিম খাইরাবাদি এবং মুমতাজ আলি আহ ছিলেন। এ প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রামপুরের নবাব এবং উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার আলফ্রেড লায়াল। কিন্তু নবাবের মৃত্যু এবং গভর্নর লায়ালের অন্যত্র বদলির কারণে প্রকল্পের কাজ হোচট খায়। আমির মিনাই পরবর্তী বিশ বছর প্রকল্পের জন্য নতুন পৃষ্ঠপোষকের খোঁজে ছিলেন। তিনি পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করতে পারলেও কেবল দুটি ভলিউম "আলিফ মামদুদা" ( آ ) এবং "আলিফ" ( ا ) যথাক্রমে ১৮৯১ ও ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয়। "বে" (ب) বর্ণের তৃতীয় ভলিউমের পাণ্ডুলিপি পরিবারের হেফাজতে রয়ে যায় যা অতি সম্প্রতি আমির মিনাইএর পৌত্র ইসরাইল আহমেদ মিনাই এর প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয়। এটার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত উর্দু ভাষাবিদ ও অভিধানবিশারদ ড. রউফ পারেখ। অবশিষ্ট ভলিউমগুলি হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং সেগুলোর সংখ্যাও অজানা। ইসমাইল মিনাই আরও পুনর্মুদ্রণ করেন আমির মিনাই এর দিওয়ান, মিরআতুল গায়েব, সনমখানা-ই-ইশক এবং সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত দুটি বই একখণ্ডে। এ দুটি বইয়ের প্রথমটি হল শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর প্রাথমিক জীবন নিয়ে, এটির নাম খায়াবান-ই-আফরীনিশ এবং অপরটি হল আমিরের রচিত নাতের সংগ্রহ "মাহামিদ-ই-খাতাম-উন-নাবিইন"। ১৯৬৩ সালে লখনৌ থেকে প্রকাশিত আবু মুহাম্মদ সাহার এর লেখা মুতালা-ই-আমির আমির মিনাই এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।[]

জনপ্রিয় কর্মসমূহ

[সম্পাদনা]

বিখ্যাত গজল 'সারাকতি যায়ে হ্যায় রুখসে নাকাব আহিস্তা আহিস্তা . . .' ঋষি কাপুর এবং টিনা মুনিম অভিনীত ছবিতে আমির মিনাইয়ের গজল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও এটা নিশ্চিত নয় যে এটি তার রচনা। আরেকটি বিখ্যাত গজল 'হালাত মাইকাদে কে কারভাত বাদল রাহে হ্যায়' তার লেখা মনে করা হলেও সম্ভবত এটিও তার লেখা নয়। আমির মিনাই এর রচিত গজলের মধ্যে সুপরিচিত হচ্ছে 'জব সে বুলবুল তু নে দো তিনকে লিয়ে'। গজলটি গেয়েছেন গুলাম আলী, এম কালিম এবং অন্যান্যরা। উস্তাদ বরকত আলি খান আমির মিনাই এর আরেকটি গজল 'নাভাক-ই নাজ সে মুশকিল হ্যায় বাঁচানা দিল কা' গেয়েছেন।

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]
  • সুবাহ-ই-আজল
  • শাম-ই-আওয়াধ

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. The Encyclopaedia of Indian Literature (Vol.One) by Amresh Datta.p.151. http://books.google.co.in/books?isbn=8126018038
  2. Sahabaz, Syed Ali। "The famous Urdu and Persian poet of India, Amir Ahmad Meenai"। www.imamreza.net/eng/imamreza। ২২ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ আগস্ট ২০১৩ 
  3. Eulogies on Prophet Muhammad: Selections from Armoghan-e-Naat, compiled and edited by Shafiq Barelvi,published by Royal Book Company in 1987
  4. A history of Urdu literature by Ram Babu Saksena published by Ram Narain lal, Allahabad, in 1940 ps.139&182
  5. The Encyclopaedia of Indian Literature (Vol.One) by Amresh Datta.p.152. http://books.google.co.in/books?isbn=8126018038