সূরা লাহাব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আল লাহাব
سورة المسد
শ্রেণীমাক্কী সূরা
নামের অর্থঅগ্নিশিখা
পরিসংখ্যান
সূরার ক্রম১১১
আয়াতের সংখ্যা
পারার ক্রম৩০
রুকুর সংখ্যা
← পূর্ববর্তী সূরাসূরা নাসর
পরবর্তী সূরা →সূরা ইখলাস
আরবি পাঠ্য · বাংলা অনুবাদ

সূরা আল লাহাব (আরবি: سورة اﻟﻠﻬﺐ) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের ১১১ তম সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ৫ এবং সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।

আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল ওয্‌যা। সে ছিল আবদুল মোত্তালিবের অন্যতম সন্তান। গৌরবর্ণের কারণে তার ডাক নাম হয়ে যায় আবু লাহাব। কোরআন পাক তার আসল নাম বর্জন করেছে। কারণ সেটা মুশরিকসুলভ। এছাড়া "আবু লাহাব" ডাক নামের মধ্যে জাহান্নামের সাথে বেশ মিলও রয়েছে। সে রসূলুল্লাহ্‌ - এর কট্টর শত্রু ও ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল এবং রসূলুল্লাহ্‌ -কে কষ্ট দেয়ার প্রয়াস পেত। তিনি যখন মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দিতেন, তখন সে সাথে সাথে যেয়ে তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করত।

নাযিল হওয়ার সময় ও স্থান[সম্পাদনা]

এটি মাক্কী সূরা, বুখারী ও মুসলিম এর বর্ণনানুসারে, রসুল (সঃ) এর উপরে যখন অবতীর্ণ হয় "আর আপনি আপনার নিকটজনদেরকে ভীতি প্রদর্শন করুন" তখন তিনি (সঃ) সাফা পর্বতের চূড়ায় তার আত্মীয় স্বজনদেরকে সমবেত করে তাদেরকে আল্লাহ্‌র ভয় প্রদর্শন করেন। প্রতিউত্তরে আবু লাহাব কটাক্ষ করলে সূরাটির সুত্রপাত হিসাবে প্রথম তিন আয়াত অবতীর্ণ হয়।

শানে নুযূল[সম্পাদনা]

আল্লাহ্‌ একটি আয়াত অবতীর্ণ করলে রসূলুল্লাহ্‌ সাফা পর্বতে আরোহণ করে কোরাইশ গোত্রের উদ্দেশে "আবদে মানাফ" ও "আবদুল মোত্তালিব" ইত্যাদি নাম সহকারে ডাক দিলেন। এভাবে ডাক দেয়া তখন আরবে বিপদাশংকার লক্ষণ রূপে বিবেচিত হত। ডাক শুনে কোরাইশ গোত্র পর্বতের পাদদেশে একত্রিত হল। রসূলুল্লাহ্‌ বললেনঃ "যদি আমি বলি যে, একটি শত্রুদল ক্রমশঃই এগিয়ে আসছে এবং সকাল বিকাল যে কোন সময় তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তবে তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে কি?" সবাই একবাক্যে বলে উঠলঃ "হাঁ, অবশ্যই বিশ্বাস করব।" অতঃপর তিনি বললেনঃ "আমি (শিরক ও কুফরের কারণে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্ধারিত) এক ভীষণ আযাব সর্ম্পকে তোমাদেরকে সতর্ক করছি।" একথা শুনে আবু লাহাব বললঃ "ধ্বংস হও তুমি, এজন্যেই কি আমাদেরকে একত্রিত করেছ?" অতঃপর সে রসূলুল্লাহ্‌ -কে পাথর মারতে উদ্যত হল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা লাহাব অবতীর্ণ হয়।[১]

আয়াতসমূহ[সম্পাদনা]

আরবী:

بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ


تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ ١
مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ ٢
سَيَصْلَى نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ ٣
وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ ٤
فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ ٥

বাংলা উচ্চারণ:

  1. তাব্বাত ইয়াদ~আবি লাহাবিও ওয়া তাব্ব।
  2. মা~আগনা-'আনহু মা-লুহু ওয়ামা-কাসাব্।
  3. সাইয়াছলা-না-রান যা-তা লাহাবিও।
  4. ওয়ামরাআতুহু; হাম্মা-লাতাল হাত্বাব।
  5. ফী জ্বীদিহা-হ্বাবলুম মিম মাসাদ্।

বাংলা অনুবাদঃ

  1. ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।
  2. তার ধন-সম্পদ আর সে যা অর্জন করেছে তা তার কোন কাজে আসল না।
  3. অচিরেই সে শিখা বিশিষ্ট জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে,
  4. আর তার স্ত্রীও- যে কাঠবহনকারিণী (যে কাঁটার সাহায্যে নবী-কে কষ্ট দিত এবং একজনের কথা অন্যজনকে ব’লে পারস্পরিক বিবাদের আগুন জ্বালাত)।
  5. আর (দুনিয়াতে তার বহনকৃত কাঠ-খড়ির পরিবর্তে জাহান্নামে) তার গলায় শক্ত পাকানো রশি বাঁধা থাকবে।

বিষয়বস্তুর বিবরণ[সম্পাদনা]

প্রথমোক্ত আয়াতত্রয়ের মর্মার্থ হচ্ছে, আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক। ধ্বংস নেমে আসুক তার নিজের উপরেও। তার অর্থবিত্ত ও উপার্জন তার কোনো উপকারে আসেনি। আসবেও না। দোজখের লেলিহান অগ্নিকুণ্ডে তার প্রবেশের ক্ষণ অত্যাসন্ন।
এখানে তাব্‌বাত অর্থ ধ্বংস হোক। এর ধাতুমূল তাবাব যার অর্থ, এমনই এক গহবর, যা সমূহ বিপদ ডেকে আনে। ইয়াদা আবী লাহাব অর্থ আবু লাহাবের দুই হস্ত। অর্থাৎ আবু লাহাব স্বয়ং। কোনো কোনো বিদ্বান বলেছেন, আবু লাহাব রসুল স: কে আঘাত করার জন্য হাতে পাথর তুলে নিয়েছিলো। তাই এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়েছে তার হস্তদ্বয়ের কথা। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এখানে হস্তদ্বয় অর্থ ইহজগত ও পরজগত। অর্থাৎ তার ইহকাল-পরকাল দুই কালই ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত। অথবা এখানে হস্তদ্বয় কথাটির দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে তার বিত্ত ও প্রভুত্বকে। সুরা: আল-মাসাদ (লাহাব)


আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল উযযা। তাকে আবু লাহাব বলে ডাকার কারণ, তার গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল সাদা লালে মেশানো। লাহাব বলা হয় আগুনের শিখাকে। কাজেই আবু লাহাবের মানে হচ্ছে আগুনবরণ মুখ। এখানে তার আসল নামের পরিবর্তে ডাক নামে উল্লেখ করার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর একটি কারণ হচ্ছে এই যে, মূল নামের পরিবর্তে ডাক নামেই সে বেশী পরিচিত ছিল। দ্বিতীয় কারণ, তার আবদুল উযযা (অর্থাৎ উযযার দাস) নামটি ছিল একটি মুশরিকী নাম। কুরআনে তাকে এ নামে উল্লেখ করা পছন্দ করা হয়নি। তৃতীয় কারণ, এ সূরায় তার যে পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে তার এ ডাক নামই বেশী সম্পর্কিত। تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ ---এর অর্থ কোন কোন তাফসীরকার করেছেন, “ভেঙে যাক আবু লাহাবের হাত” এবং وَتَبٌ শব্দের মানে করেছেন, “সে ধ্বংস হয়ে যাক” অথবা “সে ধ্বংস হয়ে গেছে।” কিন্তু আসলে এটা তার প্রতি কোন ধিক্কার নয়। বরং এটা একটা ভবিষ্যদ্বাণী। এখানে ভবিষ্যতে যে ঘটনাটি ঘটবে তাকে অতীতকালের অর্থ প্রকাশক শব্দের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে। এর মানে, তার হওয়াটা যেন এত বেশী নিশ্চিত যেমন তা হয়ে গেছে। আর আসলে শেষ পর্যন্ত তাই হলো যা এ সূরায় কয়েক বছর আগে বর্ণনা করা হয়েছিল। হাত ভেঙে যাওয়ার মানে শরীরের একটি অংগ যে হাত সেটি ভেঙে যাওয়া নয়। বরং কোন ব্যক্তি যে উদ্দেশ্য সম্পন্ন করার জন্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তাতে পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে যাওয়াই এখানে বুঝানো হয়েছে। আর আবু লাহাব রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করা জন্য যথার্থই নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। কিন্তু এ সূরাটি নাযিল হবার মাত্র সাত আট বছর পরেই বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এ যুদ্ধে কুরাইশদের অধিকাংশ বড় বড় সরদার নিহত হয়। তারা সবাই ইসলাম বিরোধিতা ও ইসলামের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে আবু লাহাবের সহযোগী ছিল। এ পরাজয়ের খবর মক্কায় পৌঁছার পর সে এত বেশী মর্মাহত হয় যে, এরপর সে সাত দিনের বেশী জীবিত থাকতে পারেনি। তারপর তার মৃত্যুও ছিল বড়ই ভয়াবহ ও শিক্ষাপ্রদ। তার শরীরে সাংঘাতিক ধরনের ফুসকুড়ি (Malignant pustule) দেখা দেয়। রোগ সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। মরার পরও তিন দিন পর্যন্ত তার ধারে কাছে কেউ ঘেঁষেনি। ফলে তার লাশে পচন ধরে। চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। শেষে লোকেরা তার ছেলেদেরকে ধিক্কার দিতে থাকে। একটি বর্ণনা অনুসারে তখন তারা মজুরীর বিনিময়ে তার লাশ দাফন করার জন্য কয়েকজন হাবশীকে নিয়োগ করে এবং তারা তার লাশ দাফন করে। অন্য এক বর্ণনা অনুসারে, তারা গর্ত খুঁড়ে লম্বা লাঠি দিয়ে তার লাশ তার মধ্যে ফেলে দেয় এবং ওপর থেকে তার ওপর মাটি চাপা দেয়। যে দ্বীনের অগ্রগতির পথরোধ করার জন্য সে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল তার সন্তানদের সেই দ্বীন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তার আরো বেশী ও পূর্ণ পরাজয় সম্পন্ন হয়। সর্বপ্রথম তার মেয়ে দাররা হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনায় চলে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। আর মক্কা বিজয়ের পর তার দুই ছেলে উতবা ও মু’আত্তাব হযরত আব্বাসের (রা.) মধ্যস্থতায় রসূলুল্লাহর (সা.) সামনে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁর হাতে বাইআত করেন।


হজরত ইবনে মাসউদ বলেছেন, রসুল স: যখন তার স্বজনদেরকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন, তখন আবু লাহাব বললো, ভাতিজা! তুমি আমাকে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছো। কিন্তু আমি তো শাস্তির পরোয়াই করি না। প্রয়োজন হলে আমি আমার সন্তান-সন্ততি-ধন-সম্পদ সবকিছুর বিনিময়ে তোমার কথিত শাস্তি থেকে পরিত্রাণ লাভ করবো। তখন পরবর্তী আয়াত অবতীর্ণ হয়।
মা আগনা আ’নহু মালুহূ ওয়ামা কাসাব অর্থ তার ধন সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোনো কাজে আসেনি। অর্থাৎ তার সঞ্চিত বিপুল বিত্ত-বৈভব ও উপার্জিত সম্পদ তাকে আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। অথবা তার পুঞ্জীভূত ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন কি তাকে আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারবে? পারবে না। "ওয়ামা কাসাব" অর্থ তার উপার্জন। অথবা তার সন্তান-সন্ততি। মাতা মহোদয়া আয়েশা সিদ্দীকা বর্ণনা করেছেন, রসুল স: বলেছেন, নিজস্ব উপার্জনজাত আহার্য সর্বোত্তম ও পবিত্রতম। তোমাদের সন্তান-সন্ততিও তোমাদের উপার্জন। বোখারী, তিরমিজি।
সা ইয়াস্‌লা নারান জাতা লাহাব অর্থ অচিরে সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে। "জাতা লাহাব" অর্থ লেলিহান অগ্নি। অর্থাৎ সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যখন আবু লাহাব দগ্ধীভূত হতে থাকবে দোজখের লেলিহান আগুনে। পরের আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে এবং তার স্ত্রীও, যে ইন্ধন বহন করে (এখানে ওয়াম্‌রাআতুহু অর্থ তার স্ত্রীও অর্থাৎ আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলকেও ভোগ করতে হবে একই পরিণতি এবং হাম্‌মালাতাল হাত্বব অর্থ যে ইন্ধন বহন করে) আরবী ভাষায় পরনিন্দুককে বলা হয় কাষ্ঠ, বা ইন্ধন বহনকারিণী। অর্থাৎ পর নিন্দাকারিণী। ইবনে ইসহাক হামাদান খান্দানের জনৈক ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, রসুল স. এর গমনাগমনের পথে আবু লাহাবের স্ত্রী কাঁটা পুঁতে রাখতো। সেদিকে ইঙ্গিত করেই অবতীর্ণ হয় এই আয়াত।
ফী জ্বীদিহা হাবলুম্‌ মিম্‌ মাসাদ্‌ অর্থ তার গলদেশে পাকানো রজ্জু। জ্বীদ অর্থ গলদেশ, গলা। আর মাসাদ অর্থ লৌহশৃঙ্খল, ওই লৌহশৃঙ্খল তার (পিঠের উপর দিয়ে) গলায় আটকিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।এখানে মূলত আবু লাহাব একটি রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।কালের বিবর্তনে হাজার ও আবু লাহাবের চরিত্রের লোক আসবে এই ধ্বংস তার জন্য ও হবে। কোরআন হল চিরন্তন এক পালনীয় গ্রন্থ। এটি যে শুধু অতীতের কেচ্ছা কাহিনি ব্যাখ্যা করবে তা নয়। কোরআন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা বর্তমান জীবনেও প্রয়োগ করা আবশ্যক। এখন কার সময়ে যে ব্যক্তি ইসলামের মৌলিক রাহা(শরীয়ত, তরীকত,মারেফাত,হাকীকত) কে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ প্রাপ্ত মানুষের বিরুদ্ধাচারণ করে ও পরনিন্দা করে সেই ব্যক্তি কে অনুসরণ না করাই সূরা লাহাবের বাস্তব পাঠ।।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন (১১ খন্ডের সংহ্মিপ্ত ব্যাখ্যা)।

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]