ভবশঙ্করী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মহারাণী ভবশঙ্করী
ভুরিশ্রেষ্ঠের মহারাণী
পূর্বসূরিমহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি
উত্তরসূরিপ্রতাপনারায়ণ
জন্মভবশঙ্করী চৌধুরী
পেঁড়ো,হাওড়া
spouseমহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি
পিতাদীননাথ চৌধুরী

মহারাণী ভবশঙ্করী(১৬ শতক) ছিলেন একজন বাঙালি বীর রমণী ও তদানীন্তন ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের রানী। ভূরিশ্রেষ্ঠ ছিল অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া ও হুগলি জেলার অন্তর্গত একটি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রাজ্য। তিনি উড়িষ্যা সালতানাত এর আফগান সুলতানদের আক্রমণ প্রতিহত করে বাংলাকে রক্ষা করেন ।

প্রাথমিক জীবন[সম্পাদনা]

ভবশঙ্করী ছিলেন এক গ্রাম্য ব্রাহ্মণ জমিদার দীননাথ চৌধুরীর কন্যা।[১]ছোটবেলা থেকে অসিখেলা, ঘোড়ায় চড়া, তীরন্দাজিতে পারদর্শিনী ছিলেন।[২]

দীননাথ ছিলেন একজন লম্বা এবং সুগঠিত সৈনিক।যিনি ছিলেন যুদ্ধের কলাতে পারদর্শী। তিনি নিজেই এক হাজারেরও বেশি সৈন্যের একটি সৈন্যদলকে নেতৃত্ব দিতেন। তিনি বিশাল জমির মালিক ছিলেন এবং তাঁর প্রজাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। দীননাথকে ভুরিশ্রেষ্ঠের সম্মানিত আভিজাতদের মধ্যে বিবেচনা করা হত। ভবশঙ্করী দীননাথের দুই সন্তানের মধ্যে প্রথম ।তিনি পেঁড়োতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[৩] তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন তার ছোট ভাইয়ের জন্ম দেওয়ার সময় তার মা মারা যান।

যখন তার ভাই পালিত মা দ্বারা লালিত-পালিত হচ্ছিল।তখন তিনি তার বাল্যত্ব তার বাবার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। শৈশবকাল থেকেই তাঁর পিতা তাকে ঘোড়ায় চড়তে, তরোয়াল চালাতে এবং তীরন্দাজিতে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছিলেন। তিনি সামরিক পোশাক পরে বাবার সাথে ঘোড়ার পিঠে চড়েছিলেন। তিনি বেড়ে উঠলেন ভুরিশ্রেষ্ঠের এক সাহসী তরুণী সৈনিক হয়ে। তারপরে তিনি যুদ্ধ, কূটনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন।


বিবাহ[সম্পাদনা]

ভবশঙ্করী একা বর্শা দিয়ে হত্যা করছেন মোষদেরকে।


যৌবনে ভবশঙ্করী দামোদর ও রণের সংলগ্ন বনে শিকার করতে যেতেন। একবার হরিণ শিকার করার সময় বন্য মোষের দল তাকে আক্রমণ করেছিল। তিনি একাই তাদের হত্যা করেছিলেন। সেই সময় ভুরিশ্রেষ্ঠের মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি দামোদরের পাশের একটি নৌকায় দিয়ে কাস্তাসনগড়ের দিকে যাচ্ছিলেন।তখন বর্শা দিয়ে বুনো মহিষ হত্যা করার সময় তাকে দেখে মুগ্ধ হন। রুদ্রনারায়ণ এবং ভবশঙ্করীর মধ্যে রাজকীয় বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন রাজ পুরোহিত হরিদেব ভট্টাচার্য।



রাজবল্লভী দেবী মুর্তি,রাজবল্লভী কালীমন্দির, রাজবলহাট

ভবশঙ্করী প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তরোয়ালযুদ্ধে তাকে যে পরাজিত করবে তাকে তিনি বিয়ে করবেন।[৪]কিন্তু রাজার পক্ষে কোনও সাধারণের সাথে দ্বন্দ্ব তরোয়াল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সম্ভব না হওয়ায় তাকে তার সংকল্প পরিবর্তন করতে হয়েছিল। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, ভুরুশ্রেষ্ঠ রক্ষাকারী দেবী রাজবল্লভীর সামনে রাজাকে এক কোপে এক জোড়া জল মহিষ এবং একটি ভেড়া বলি দিতে হবে। রাজবলহাট নামক পুরাতন রাজধানীটির নামকরণ করা হয়েছিল হিন্দু দেবী রাজবল্লভীর নামে।


রাজ্যশাসন[সম্পাদনা]

বিয়ের পরে তিনি গড় ভবানীপুর দুর্গের ঠিক বাইরে দামোদরের নতুন নির্মিত প্রাসাদে চলে আসেন। রাজার সহকর্মী হিসেবে তিনি তার রাজকীয় কর্তব্য়ে রাজাকে সহায়তা করতে শুরু করেছিলেন। তিনি রাজ্যের সামরিক প্রশাসনের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তিনি নিয়মিত প্রশিক্ষণার্থী সৈনিকদের পরিদর্শন করতেন এবং সামরিক অবকাঠামোগত উন্নতি ও আধুনিকীকরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি সবাইকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে উৎসাহিত করতে শুরু করেছিলেন।ধীরে ধীরে তিনি সামরিক প্রশিক্ষণকে ভুরিশ্রেষ্ঠে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। তিনিই প্রথম ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে মহিলাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন।সেই সঙ্গে তিনি নিয়ম করেন যে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের একজনকে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিতে হবে।যাতে আপদকালীন পরিস্থিতিতে সেনার দরকার পড়লে যুদ্ধ যোগ দিতে পারে। রানী ভবশঙ্করীর প্রশাসনিক দক্ষতায় ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য হাওড়া ও হুগলী ছাড়িয়ে পূর্ব বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিন মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অংশে বিস্তার লাভ করে।

সেই সঙ্গে তিনি নৌবাহিনীর দিকেও নজর দেন।রানী ভবশঙ্করীর তত্ত্বাবধানে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের নিজস্ব নৌবাহিনী গঠন করেন, যা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল।সেইসময় গৌড়ের শাসক ছিলেন পাঠান বংশীয় সুলেমান কররানী। তার লুটেরা বাহিনী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অতর্কিত হামলা করে লুঠ-পাট চালাতো। তাই এদের শায়েস্তা করতে রাণী ভবশঙ্করীর পরামর্শে উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেব এর সঙ্গে জোট করেন রাজা রুদ্রনারায়ণ । রাণী ভুরিশ্রেষ্ঠের সীমানা বরাবর নতুন গ্যারিসন দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন এবং বিদ্যমান মন্দিরগুলি সংস্কার করেছিলেন।

ভুরিশ্রেষ্ঠ ভরদ্বাজ রাজবংশের কুলদেবতা ছিলেন রাজবল্লভী দেবী। যিনি চণ্ডীর এক রুপ এবং তাঁর মূর্তিটি অষ্টধাতু দ্বারা তৈরি হয়েছিল। ভাবশঙ্করী তাঁর উপাসনা করতেন । একবার বর চেয়েছিলেন যে কোনও যুদ্ধে কোনও মানুষ তাকে পরাস্ত করতে পারবে না।এজন্য তিনি দেবীকে খুশি করতে উপোষ করেন। দুই দিন উপোষ থাকার পরে অবশেষে তৃতীয় দিনে দেবী তার প্রার্থনা শোনেন এবং তার ইচ্ছা পূরণ হল।দেবী তাকে তার নিজের শক্তি দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন এবং তাকে একটি তরোয়াল দিয়েছিলেন যা গড় ভবানীপুরে রাজপ্রাসাদের নিকট হ্রদের নীচে পড়ে ছিল। ভক্তিতে ভরা ভবশঙ্করী হ্রদে স্নান করার সময় তরোয়াল গ্রহণ করলেন। ভবশঙ্করির পূজিত কুলদেবী চণ্ডী এখন পুরো হাওড়া জেলার পৃষ্ঠপোষক দেবী হিসেবে আমতায় মেলাই চণ্ডী, মকরদাহায় মা মকরচণ্ডী, দমজুরের নিকটবর্তী জয়চণ্ডী তলার মা জয়া চণ্ডী এবং হাওড়ার বেটাইয়ে (বেটার) এর বেতাই চণ্ডী ইত্যাদি নামে পূজিত।

তিনি তারকেশ্বরের নিকটে ছৌনাপুরে দুর্গের সীমানা শৈলের বাইরে একটি মন্দির তৈরি করেছিলেন। মন্দিরটি একটি সুড়ঙ্গ দ্বারা সংলগ্ন দুর্গে সংযুক্ত ছিল। তিনি যখন দুর্গে প্রশাসনিক পরিদর্শন করেছিলেন তখন পালানোর পথ ছাড়াও এটি তার অস্থায়ী বাসভবন হিসেবে কাজ করেছিল। তিনি বাঁশুরি গ্রামে একটি ভবানী মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। এই সময়কালে ভুরিশ্রেষ্ঠ কৃষিক্ষেত্রে এবং বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। তাঁত শিল্প এবং ধাতব কাজের মতো দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটে। তিনি আমতাতে দেবী চণ্ডীর মন্দিরও তৈরি করেছিলেন।যা এখন পুরো হাওড়া জেলার পৃষ্ঠপোষক দেবী ।

শীঘ্রই ভবশঙ্করী রাজপুত্র প্রতাপনারায়ণের জন্ম দেন। রাজা রুদ্রনারায়ণ এই খুশিতে বিদ্বানদের রুপো, পোশাক এবং খাবারের জন্য জমি ও স্বর্ণ দান করেছিলেন। রুদ্রনারায়ণ পরলোকগমন করেন যখন প্রতাপনারায়ণের মাত্র পাঁচ বছর। ভবশঙ্করী সতীদাহে সতী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে রাজকীয় পুরোহিত তাকে তা থেকে বিরত হতে রাজি করেছিলেন।রাজ পুরোহিত রাণী ভবশঙ্করীকে রাজ্যের শাসনভার ততদিন নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান ,যতদিন না পর্যন্ত রাজকুমার প্রতাপনারায়ণ প্রাপ্তবয়স্ক না হয়ে ওঠেন। তিনি তিন মাসের জন্য এক ব্রহ্মচারিনী জীবন যাপনের জন্য রাজ্যের বিষয় থেকে বিরতি নিয়েছিলেন।

রাজা রুদ্রনারায়নের মৃত্যুর পর রাজ্যের শাসনভার আসে তার ওপর। তিনি দক্ষতার সাথে রাজ্যশাসন পরিচালনা করেন। এইসময় ভুরশুটের অধিবাসী পাঠান সর্দার ওসমান খাঁ মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়। ওসমান যুদ্ধের জন্যে রানীর সাহায্য চায় কিন্তু ভবশঙ্করী রাজী না হলে সে ভুরশুট রাজ্য আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। পাণ্ডুয়ার কাছে গড় ভবানীপুর ছিল ভুরশুটের রাজধানী। সেখান থেকে ১৪ মাইল দূরে বাসডিঙা গড়ের কালীমন্দিরে ভবশঙ্করী পূজা দিতে গেলে ওসমান দলবল নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায় রাণীর ওপর। সামান্য যে ক’জন দেহরক্ষী ছিল, তাদেরকে নিয়েই পাঠানদের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। তার বীরত্ব ও রনকৌশলের কাছে পরাজিত এবং নিহত হয় ওসমান। এই সংবাদ পেয়ে কিছুদিন পরে মোগল সম্রাট আকবর, রানী ভবশঙ্করীকে রায়বাঘিনী উপাধিতে ভূষিত করেন।[২]

কাস্তাসনগড়ের যুদ্ধ[সম্পাদনা]

গৌড় ও পান্ডুয়ার পাঠান নবাবদের শাসনকালে ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্য বেশিরভাগ নিরপেক্ষ ছিল। তবে কররানীদের সেনাপতি কালাপাহাড়ের কারণে রুদ্রনারায়ণ সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। মুঘলদের কাছে পরাজিত হওয়ার পরে বাংলার পাঠানরা ওড়িশায় আশ্রয় নিয়েছিল। ওড়িশায় তাদের ঘাঁটি থেকে ওসমান খানের নেতৃত্বে পাঠানরা আবারও বাংলা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিল।[৫]

রাণী ভবশঙ্করী রাজ্যের বিষয়ে দায়িত্ব রাজস্ব মন্ত্রী দুর্লভ দত্ত এবং সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক চতুর্ভুজ চক্রবর্তীকে দিয়েছিলেন। রাজকুমার প্রতাপনারায়ণের সাথে তিনি কাস্তাসনগড়ের শিব মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং তাঁর বিশ্বস্ত মহিলা দেহরক্ষীদের তার সাথে ছিলেন। তবে তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় যুদ্ধের পোশাক পরে থাকতেন এবং তরোয়াল ও আগ্নেয়াস্ত্রটি সঙ্গে রাখতেন। মন্দিরে প্রতিদিন প্রভুর উপাসনা করা হত।ব্রাহ্মণ, সন্ন্যাসী এবং ভিক্ষুকদের খাওয়ানো হচ্ছিল এবং প্রতি সন্ধ্যায় শিব কীর্তন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। ভবশঙ্করী প্রতি রাতে শিব সাধনে নিজেকে জড়িত রাখতেন। যখন তিনি কেবল মন্দিরের ভিতরে একা ধ্যান করতেন তখন বাইরে কেবল কয়েকজন দেহরক্ষী থাকত।

এর মধ্যে চতুর্ভুজ চক্রবর্তী পাঠান সেনাপতি ওসমান খানের সাথে একটি গোপন চুক্তি সম্পাদন করেন। যা অনুযায়ী তিনি তার বাহিনী সহ মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠান বাহিনীতে যোগ দিতেন এবং পাঠানদের দ্বারা ভুরিশ্রেষ্ঠ বিজয়ের পরে তিনি ভুরিশ্রেষ্ঠের নতুন শাসক হয়ে উঠবেন। তার থেকে গোপন তথ্য নিয়ে পাঠান বাহিনী ভবশঙ্করী ও তার পুত্রকে জীবিত ধরার জন্য যাত্রা শুরু করে। ওসমান খান তার বারোজন প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ এবং সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈন্য সহ হিন্দু সন্ন্যাসীদের ছদ্মবেশে ভুরিশ্রেষ্ঠ অঞ্চলে প্রবেশ করেছিলেন। আরও ২০০ জন পাঠান সেনা ছদ্মবেশে তাদের অনুসরণ করে। ওসমানের অগ্রসর বাহিনী আমতার দিকে লক্ষ্য করা গিয়েছিল এবং এই খবর রাণীর কাছে পৌঁছে। তিনি নিকটবর্তী চৌকি থেকে ২০০ রক্ষী বাহিনীকে ডেকে পাঠালেন। রাতের বেলা তিনি নিজের সাঁজোয়া পোশাকের উপর দিয়ে শ্বেতপট্ট পরে উপাসনায় নিজেকে নিযুক্ত করলেন। তার মহিলা দেহরক্ষীরা মন্দিরের বাইরে পাহারাদার ছিলেন এবং সৈন্যরা জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ে।

তখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল যখন পাঠান সৈন্যদের একজন নিরাপত্তা লঙ্ঘন করে মন্দির চত্বরে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। মহিলা দেহরক্ষীরা কার্যত লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে এবং তরোয়ালযুদ্ধ হয়। শীঘ্রই রাজকর্মীরা লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল। পাঠানরা মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়েছিল এবং পালানোর চেষ্টা করতে করতে রাজকর্মীরা তাদের তাড়া করে হত্যা করে। পাঠান ভাড়াটে দ্বিতীয় সৈন্যদলটি নিকটবর্তী জঙ্গলে শৈব আখড়ার যোদ্ধা সন্ন্যাসীদের দ্বারা মারা যায়। ওসমান পালিয়ে যায়।

রাজশক্তি এবং বাঁশুরির যুদ্ধ[সম্পাদনা]

রাণী ভবশঙ্করী পরের দিন ভোরে রাজধানীতে ফিরে আসেন এবং রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কঠোর প্রমাণের অভাবে তিনি চতুর্ভূজ চক্রবর্তীকে শাস্তি দিতে পারেননি।কিন্তু সুরক্ষায় অবহেলার অজুহাতে তিনি তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেন ও অপদস্থ করেন। পেঁড়ো দুর্গের সেনাপতি রাজা ভূপতি কৃষ্ণ রায় সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। এ ছাড়া সংখ্যার পাশাপাশি অবকাঠামোগত ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজেই তাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

সেই সময় তিনি ঘন ঘন ছাউনি বা সেনানিবাসের নামে ছাউনপুর দুর্গ পরিদর্শন করতেন। তাঁর সফরকালে তিনি কমপক্ষে একবার নিকটবর্তী বাঁশুরি গ্রামের ভবানী মন্দিরে যেতেন। তান্ত্রিক আচার অনুসারে তাঁর সরকারী রাজ্যাভিষেকও মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়। তন্ত্রের বিশিষ্ট সাধক গোলোক চট্টোপাধ্যায় রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন।



এরই মধ্যে পাঠানরা পুনরায় দলবদ্ধ হয়ে আবারো চতুর্ভুজকে হাত করে। পরবর্তীকালে রাণীর বিরুদ্ধে সরাসরি পাঠান বাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করলেও সে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিল। ওসমান খান ও চতুর্ভুজ তাঁর রাজ্যাভিষেকের রাতে রাণী ভবশঙ্করীকে ধরার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। যখন তিনি তাঁর কয়েকজন মহিলা দেহরক্ষী তাঁর দ্বারা রক্ষিত থাকবেন তখন তাকে ধরার পরিকল্পনা করা হয়। তদনুসারে ওসমান পাঁচ শতাধিক পাঠান সেনার একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ভুরিশ্রেষ্ঠ অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। সারা রাত ভ্রমণ করার পরে তারা আক্রমণের দিন সকাল সকাল খানাকুলের কাছে একটি জঙ্গলে শিবির স্থাপন করেছিল।

পাঠান সেনাবাহিনী জঙ্গলে এক শিকারী কালু চন্ডালকে পেয়েছিল। যিনি খানাকুলের কাছে সেনাকে খবর দিয়েছিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তৎক্ষণাত গড় ভবানীপুরে সংবাদ নিয়ে একটি দন্ডনায়ককে প্রেরণ করলেন। সেই সময় রাজা ভূপতি কৃষ্ণ রায় দূরে পেঁড়ো দুর্গে ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত সেনাপতি চতুর্ভূজ এই ঘটনাকে মিথ্যা শঙ্কা হিসাবে উড়িয়ে দিয়েছিল। চতুর্ভুজের কথা না শুনে দণ্ডনায়ক সংবাদটি পেন্দোয় প্রেরণ করলেন। বিকেলে চতুর্ভুজ তার বাহিনী নিয়ে খানাকুলের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যায় সে ওসমান খানের কাছে একটি বার্তা প্রেরণ করে তাকে রাত শেষের দিকে আক্রমণ চালানোর পরামর্শ দিয়েছিল। চতুর্ভুজের সমর্থনে উৎসাহিত পাঠানরা বসুড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল পুরসুরার কাছে দামোদর পেরিয়ে।

রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে রাণী রাজা ভূপতি কৃষ্ণ রায়ের একটি বার্তা পেয়েছিলেন।যাতে তাকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল। তিনি তৎক্ষণাত ছাউনপুর , বাঁশডিঙ্গাগড় , নস্করডাঙ্গা এবং মহিলা সৈন্যদল থেকে সৈন্য নিযুক্ত করেন। যুদ্ধের জন্য ১০০-এর একটি হাতি ব্রিগেড, ৫০০ এর অশ্বারোহী এবং ৫০০ পদাতিক সৈন্য প্রস্তুত ছিল। রাজ পরামর্শদাতা হরিদেব ভট্টাচার্য স্থানীয় বাগদি ও চন্ডাল জনগোষ্ঠীর অনিয়মিত যোদ্ধাদের ব্যবস্থা করেছিলেন। অন্যদিকে রাজা ভূপতি কৃষ্ণ রায় পেন্দো এবং দোগাছিয়া থেকে সেনাবাহিনীকে চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর সৈন্যদল মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

পাঠান বাহিনী এগিয়ে আসতেই তারা তিনদিকে পরিখা দিয়ে ঘেরা একটি যুদ্ধের মাঠে ঢুকে পড়ে। পাঠান বাহিনী প্রথমে ভুরিশ্রেষ্ঠ সেনাকে চতুর্ভূজের বাহিনী বলে ভেবেছিল। ফলে বিভ্রান্তিতে তারা প্রাথমিক প্রান্তটি হারাতে বসে। ওসমান যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা করে তবে তা নিরর্থক ছিল।রাণী ভবশঙ্করী নিজেই একটি হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর হাতে তোপ রুদ্রজ্ঞানীশক্তি ছিল।যার সাহায্যে তিনি এক বিশাল সংখ্যক পাঠান সেনার মৃত্যু ঘটান।কৌশলগত সুবিধার সাথে ভুরিশ্রেষ্ঠ সৈন্যদের উচ্চতর যুদ্ধ দক্ষতা তাদের বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়। আহত ও পরাজিত ওসমান খান যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যায়। অনেক কষ্টের পরে সে ফকিরের ছদ্মবেশে ওড়িশায় পৌছায়।

মোগলদের সাথে সম্পর্ক[সম্পাদনা]

মোগল সম্রাট আকবর সর্বদা বাংলায় পাঠানদের পুনরুত্থানের বিষয়ে সতর্ক ছিলেন। তিনি ভুরিশ্রেষ্ঠের সাথে জোটকে শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে মানসিংহকে ভুরিশ্রেষ্ঠের দরবারে প্রেরণ করেছিলেন। মানসিংহ মুঘল সিল নিয়ে গড় ভবানীপুরে পৌঁছেছিলেন। একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে, ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্য এবং মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে জোটের সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে ভুরিশ্রেষ্ঠের সার্বভৌমত্বকে মোঘল সাম্রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই চুক্তির পর মানসিংহ মোঘল সম্রাট আকবরের দেয়া সোনার তলোয়ার রাণীকে উপহার দেন।আকবরকে রাণীর পক্ষ থেকে সোনার মুদ্রা, একটি ছাগল এবং একটি কম্বল প্রেরণ করা হয়েছিল। মহারাণী ভবশঙ্করীকে রায়বাঘিনী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল । মুঘলরা কখনও তাঁর রাজ্যে কখনও হস্তক্ষেপ করেনি।

পরবর্তী জীবন[সম্পাদনা]

রাজপুত্র এবং উত্তরাধিকারী প্রতাপনারায়ণের বিয়ের দু'বছর পরে রাণী সিংহাসন রাজপুত্রকে ছেড়ে দেন। তিনি অবশ্য তার উত্তরাধিকারী ছেলের তত্ত্বাবধায়ক ও পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। কয়েক বছর পরে যখন প্রতাপনারায়ণ একজন শাসক হিসেবে তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে শুরু করলেন তখন তিনি তাঁর অন্যান্য সমস্ত রাজকীয় কর্তব্য তাঁর হাতে তুলে দিয়ে আধ্যাত্মিক জীবন গ্রহণ করলেন। তিনি কাশীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন এবং তাঁর বাকী জীবন সেখানেই কাটিয়েছেন।

সংস্কৃতি[সম্পাদনা]

মহারাণী ভবশঙ্করী তাঁর রায়বাঘিনী উপাধিতে বিখ্যাত হয়েছিলেন।এর দ্বারা যিনি সাহসী বা কখনও কখনও বিদ্রোহী মহিলাকে বোঝাতো ।পরে এটি বাঙালি প্রবাদের অংশ হয়ে ওঠে। তাঁর বীরত্বের গল্প লোককাহিনীর একটি অংশে পরিণত হয়েছিল।তিনি গীতসংহিতা এবং গ্রামের কবিদের দ্বারা অমর হয়ে র‍য়েছেন।হাওড়ার পেঁড়োতে রণ নদীর তীরে পাঠানদের সাথে রাণীর যুদ্ধের গল্প আজও শোনা যায়।[৬] ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর স্মরণে বার্ষিক রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করী স্মৃতি মেলার উদ্বোধন করেছিল।[৭]তার স্মৃতিতে প্রতি বছর হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর এ রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করী মেলা হয়।[৮] গড়ভবানীপুরে তাঁর নামে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে।[৯] [১০][১১]নাট্যকার দীনেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত তার জীবন নিয়ে ঐতিহাসিক নাটক রাণী ভবশঙ্করী রচনা করেছেন।[১২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Bhurishrestha Rajkahini
  2. প্রথম খন্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (২০০২)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৩৭৪। 
  3. "Log into Facebook"Facebook (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৫ 
  4. Kundu, Ashok Kumar (১ অক্টোবর ২০০৯)। "রাজবল্লভপুরের জলঘড়ি"। Kolkata: Anandabazar Patrika। ২২ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০১০ 
  5. Land and Local Kingship in Eighteenth-Century Bengal By John R. McLane
  6. সংবাদদাতা, Author: নিজস্ব (২০২০-১০-২১)। "হাওড়া জেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দুর্গোৎসব, জানুন বিস্তারিত ইতিহাস"Uluberia Sambad (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৫ 
  7. "আনন্দবাজার পত্রিকা - দক্ষিণবঙ্গ"archives.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৩ 
  8. আবসার, নুরুল। "সংস্কৃতি চর্চা বাড়ছে, অভাব হলের"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৫ 
  9. আবসার, নুরুল। "পর্যটনের উদ্যোগ হাওড়ায়"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৫ 
  10. "সেজে উঠছে"bartamanpatrika.com। সংগ্রহের তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ 
  11. ইসলাম, মনিরুল। "ইতিহাসের গড় ভবানীপুরে পর্যটনকেন্দ্রের উদ্যোগ"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৫ 
  12. "রানী ভবশঙ্করী তিন অঙ্কের ঐতিহাসিক নাটক"। Rabindra Bharati University। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মে ২০১৭ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]