পাখি বিলুপ্তি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিলুপ্তপ্রায় ডোডো পাখি

প্রায় ১১,১৫৪টি পরিচিত পাখিপ্রজাতির মধ্যে ১৫৯ (১.৪%) বিলুপ্ত, ২২৬ (২%) ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিপন্ন, ৪৬১ (৪.১%) বিপন্ন, ৮০০ (৭.২%) ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১০১৮ (৯.১%) হুমকির নিকটবর্তী[১] এবিষয়ে অধ্যয়নরত বিজ্ঞানীদের মধ্যে একটি সাধারণ ঐকমত্য রয়েছে যে পরিবেশের উপর যদি মানুষের চলমান প্রভাব অব্যাহত থাকে, তবে মোট পাখিপ্রজাতির এক-তৃতীয়াংশ এবং পাখির মোট জনসংখ্যার আরো বড় একটি অংশ এই শতাব্দীর শেষের দিকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

১৫০০ সাল থেকে ১৫০ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।[২] ঐতিহাসিকভাবে দ্বীপগুলোতে, বিশেষত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেশিরভাগ পাখির বিলুপ্তি ঘটেছে। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফিজি এবং পাপুয়া নিউগিনির মতো দেশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়নি এবং প্রচুর সংখ্যক বলে মনে হয়, তবে এটি পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় খুব কম সংখ্যায় বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর আমেরিকার উড থ্রাশ পাখির সংখ্যা গত ৫০ বছরে ৫০% হ্রাস পেয়েছে। আমেরিকান বার্ড কনজারভেটরি অনুসারে, পশ্চিম গোলার্ধে পাখির ১২% প্রজাতি এমন হারে হ্রাস পাচ্ছে যে পরের শতাব্দীর মধ্যে এগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।[৩]

পাখি বিলুপ্তির কারণ[সম্পাদনা]

মানুষের কার্যকলাপ বিশ্বজুড়ে পাখি বিলুপ্তির সবচেয়ে বড় কারণ। পাখি বিলুপ্তির শীর্ষ মানবসংশ্লিষ্ট কারণগুলো হল: বর্ধিত জনসংখ্যা, পাখির আবাসস্থল ধ্বংস (বাসস্থান, বৃক্ষনিধন, প্রাণী এবং একক ফসলের কৃষিক্ষেত্র এবং আক্রমণাত্মক উদ্ভিদ রোপণের মাধ্যমে), পাখি পাচার, ডিম সংগ্রহ, দূষণ (সার ব্যবহার স্থানীয় উদ্ভিদ এবং প্রাণীবৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, কীটনাশক, আগাছানাশক সরাসরি এদের পাশাপাশি পাখির খাদ্য উৎস হিসেবে পরিচিত উদ্ভিদ এবং প্রাণীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যা খাদ্যশৃঙ্খলের আর নিচে প্রভাব রাখে) এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।[৪] ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে মানুষ এমনসব স্থানে আবাস গড়ে তুলছে যা একসময় বনাঞ্চল ছিল। এটি বিলুপ্তির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।[৫]

প্রাকৃতিক[সম্পাদনা]

জলবায়ু পরিবর্তন যেহেতু বিভিন্ন কারণে ঘটে, তাই পাখি বিলুপ্তির ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেক। তাপমাত্রা এবং জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের কারণে জীববৈচিত্র্যময় পৃথিবী এই অনুঘটকগুলোর সাথে একই সাথে অগ্রসর হতে পারে না।[৫] মারাত্মক আবহাওয়া ও দীর্ঘকালীন মৌসুমের সাথে সাথে আশেপাশের আবহাওয়ার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পাখিদের পক্ষে টিকে থাকা খুবই কঠিন হয়। হাওয়াই রাজ্যে হাওয়াইয়ান বনে পাখির সংখ্যা হ্রাসের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী এবং এর ফলে এভিয়ান ম্যালেরিয়া (প্লাজমোডিয়াম রিলিকাম) বৃদ্ধি পেয়েছে। যেহেতু ম্যালেরিয়ার গতিশীলতা পার্শ্ববর্তী এলাকার তাপমাত্রা ও অন্যান্য অনুঘটক দ্বারা প্রভাবিত হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাসের কারণে এভিয়ান ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। [৬]

সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থানের ফলে সৃষ্ট বন্যা দ্বীপগুলোতে পাখি এবং অন্যান্য স্থানীয় জন্তসমুহকে হত্যা করে এগুলোকে বিলুপ্ত করতে পারে।

রোগ[সম্পাদনা]

প্রতিটি প্রজাতির পাখির রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে।[৫] পরিবর্তিত জলবায়ু এবং বায়ুমণ্ডলের সাথে সাথে অনেক প্রজাতি রোগের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। এই পাখি প্রজাতিগুলো রোগের প্রতি আরো সংবেদনশীল হয়ে উঠছে, যার ফলে বিলুপ্তির সম্ভাব্যতা বাড়ে। পাখিদের সবচেয়ে সাধারণ রোগটি হলো সালমোনেলোসিস, যা ল্যাটিন সালমোনেলা থেকে উদ্ভূত। সংক্রামিত পাখিগুলো তাদের মলত্যাগের মাদ্ধমে ব্যাকটেরিয়া ছড়ায় এবং ঐ ব্যাকটেরিয়ার দূষণে দূষিত খাবার খেলে অন্যান্য পাখি এই রোগে আক্রান্ত হয়।[৭]

উল্লেখযোগ্য উদাহরণ[সম্পাদনা]

ডোডো[সম্পাদনা]

সম্ভবত বহুল পরিচিত একটি বিলুপ্ত প্রজাতির পাখি হলো ডোডো[১] উড়তে অক্ষম এই পাখিটি কেবলমাত্র ভারত মহাসাগরের মরিশাস দ্বীপে বাস করত। দ্বীপের প্রচুর পরিমাণে খাদ্য এবং কোনো শিকারি না থাকায় তাদের বংশধরেরা বিবর্তিত হয়েছে এবং আকারে আরো বড় হতে শুরু করে, তাদের চঞ্চু বড় এবং ডানা আরো ছোট হয়। চলাচলের সীমিত পরিসীমা, উড়তে অক্ষমতা এবং মানুষের সংস্পর্শের অভাব ও ভয় এদের দ্রুত বিলুপ্তিতে অবদান রেখেছিল। সপ্তদশ শতকের মানুষ এর নির্ভীকতা এবং উড়ার অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে নাবিকদের খাদ্য উৎস হিসাবে এদের শয়ে শয়ে হত্যা করে।[৮] শ্রেণিবিন্যাসকারক কর্তৃক সম্পূর্ণ বর্ণনা করার আগেই সম্ভবত ডোডো বিলুপ্ত হয়ে যায়।[৯] এর আকস্মিক বিলুপ্তি স্থানীয় দ্বীপ প্রজাতির সংবেদনশীলতা তুলে ধরে এবং নৃবিজ্ঞানে বিলুপ্তির প্রাথমিক প্রজাতি হিসাবে ডোডো উপস্থাপিত হয়।

বড় অক[সম্পাদনা]

বড় অক (এটির নামকরণ করা হয়েছে উত্তরের ডোডো বা উত্তরের পেঙ্গুইন) ছিল উড়তে অক্ষম একটি সামুদ্রিক পাখি যা উত্তর আটলান্টিক সমুদ্র এবং দ্বীপে বাস করতো। এর পরিসর একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। তবে, ১৮০০ এর দশকের মধ্যে এর পরিসর খুব কমে যায়, কেবলমাত্র উত্তর আটলান্টিকের কিছু পাথুরে দ্বীপে এদের প্রজনন হতো।[১০] এর মূল্যবান চামড়ার জন্য এটি শিকারিদের লক্ষ্যবস্ততে পরিণত হয়েছিল। পাথুরে দ্বীপগুলোতে এরা বড় সংখ্যায় প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় বাসা বাঁধলে শিকারিরা এর সুবিধা গ্রহণ করে।[১১] প্রজনন ঋতু বাদে অন্য সময় শিকার করা অনেক বেশি কঠিন ছিল, কারণ পাখিরা কম সংখ্যায় থাকত এবং বেশিরভাগ সময় তারা হিমশীতল জলে কাটাত যেখানে তারা দ্রুত সাঁতার কাটতে পারতো। প্রজাতির সর্বশেষ জীবিত প্রাণীটিকে ১৮৪৪ সালে দেখা যায় যখন একটি প্রজননকারী জুটি পাওয়া গিয়েছিল এবং শিকারিরা চামড়া বিক্রি করার আশায় এদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।[১২]

অভিবাসী কবুতর[সম্পাদনা]

সমসাময়িক বিলুপ্ত আরো একটি পাখি প্রজাতি হলো উত্তর আমেরিকার অভিবাসী কবুতর। একসময় এটি বড় সংখ্যায় ঝাঁক আকারে বাস করতো। উত্তর আমেরিকাতে উপনিবেশকারী ইউরোপীয়দের আগমনের আগে অভিবাসী কবুতর মহাদেশের সমস্ত পাখির ৪০% ছিল বলে মনে করা হয়। সিনসিনাটি চিড়িয়াখানায় প্রজাতির সর্বশেষ বেঁচে থাকা সদস্য মার্থার মৃত্যুর সাথে সাথে ১৯১৪ সালে একে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তবে মার্থার মৃত্যুর ২০ বছর আগে বনাঞ্চলে এটিকে আর দেখা যায়নি।[১৩] এই প্রজাতি বিলুপ্তির মূল কারণগুলো হলো আবাস ধ্বংস এবং শিকার। আবাসস্থল ধ্বংসের ঘটনাটি চেস্টনট ব্লাইটের সাথেও সম্পর্কিত ছিল, যা উত্তর আমেরিকায় আমেরিকান চেস্টনট গাছের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছিল। [১৪] অভিবাসী কবুতর সম্প্রতি বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি পাখি প্রজাতির মধ্যে একটি যাকে 'বিলুপ্তি' থেকে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছিল।[১৫] জেনেটিক কৌশল ব্যবহার করে এই প্রজাতির কিছু অবশিষ্ট টিস্যু থেকে প্রজাতির পুরো জিনোম তালিকা তৈরি করে একে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে পাখি শারীরবৃত্তীয় দিক থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর চেয়ে জটিল, যা একে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় অসুবিধা তৈরি করে।

অঞ্চল অনুসারে[সম্পাদনা]

অস্ট্রেলিয়া[সম্পাদনা]

২০২০ সালের জুনে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার রয়্যাল সোসাইটি ৯৫ টি অস্ট্রেলিয়ান পাখির জীবাশ্মের তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার কাটি থান্দা-লেক আইয়ার এবং লেক ফ্রেম অঞ্চলের তিনটি বিশাল প্রজাতির ফ্ল্যামিংগো অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা প্রায় ২৫ মিলিয়ন বছর ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছিল এবং ১৪০,০০০ বছর আগে খরার কারণেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এছাড়াও প্রায় 2 মিটার (৬ ফুট ৭ ইঞ্চি) লম্বা পেঙ্গুইন, যা প্রায় ৩০ মিলিয়ন থেকে ৬০ মিলিয়ন বছর আগে বসবাস করতো এবং অলিগোসিনে মারা গিয়েছিল। গবেষক ট্রেভর ওয়ার্থি বলেন অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় এক হাজার প্রজাতির পাখির বিবর্তন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।[১৬][১৭][১৮]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. IUCN 2020.। "The IUCN Red List of Threatened Species"IUCN Red List of Threatened Species। Version 2020-21। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-২৮ 
  2. Loehle, Craig; Eschenbach, Willis (২০১২-০১-০১)। "Historical bird and terrestrial mammal extinction rates and causes" (ইংরেজি ভাষায়): 84–91। আইএসএসএন 1472-4642ডিওআই:10.1111/j.1472-4642.2011.00856.x 
  3. "Extinction" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ মে ২০২১ তারিখে, American Bird Conservatory, Accessed July 4, 2019.
  4. Diamond, J. M.; Ashmole, N. P. (১৯৮৯-১১-০৬)। "The Present, Past and Future of Human-Caused Extinctions [and Discussion]" (ইংরেজি ভাষায়): 469–477। আইএসএসএন 0962-8436ডিওআই:10.1098/rstb.1989.0100অবাধে প্রবেশযোগ্যপিএমআইডি 2574887 
  5. "Extinction - Causes"people.uwec.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৫-১৭ 
  6. Wei, Liao; Atkinson, Carter T. (২০১৭)। "Mitigating Future Avian Malaria Threats to Hawaiian Forest Birds from Climate Change": e0168880। ডিওআই:10.1371/journal.pone.0168880পিএমআইডি 28060848পিএমসি 5218566অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  7. "Common Bird Parasites & Diseases"Mass Audubon। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৫-১৭ 
  8. Turvey, Samuel T.; Cheke, Anthony S. (জুন ২০০৮)। "Dead as a dodo: the fortuitous rise to fame of an extinction icon" (ইংরেজি ভাষায়): 149–163। আইএসএসএন 0891-2963ডিওআই:10.1080/08912960802376199 
  9. Janoo, Anwar (১৯৯৬)। "On a hitherto undescribed Dodo cranium, Raphus cucullatus L.(Aves, Columbiformes), with a brief taxonomical overview of this extinct flightless Mascarene Island bird": 57–77। 
  10. Bengtson, Sven-Axel (১৯৮৪-০১-০১)। "Breeding Ecology and Extinction of the Great Auk (Pinguinus impennis): Anecdotal Evidence and Conjectures": 1–12। আইএসএসএন 0004-8038ডিওআই:10.1093/auk/101.1.1 
  11. Serjeantson, Dale (জানুয়ারি ২০০১)। "The great auk and the gannet: a prehistoric perspective on the extinction of the great auk": 43–55। আইএসএসএন 1047-482Xডিওআই:10.1002/oa.545 
  12. Jeremy., Gaskell (২০০৮)। Who killed the great auk?। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-856478-2ওসিএলসি 862148067 
  13. Herman, William C. (জানুয়ারি ১৯৪৮)। "The Last Passenger Pigeon": 77–80। আইএসএসএন 0004-8038জেস্টোর 4080229ডিওআই:10.2307/4080229 
  14. Johnson, Kevin P.; Clayton, Dale H. (অক্টোবর ২০১০)। "The flight of the Passenger Pigeon: Phylogenetics and biogeographic history of an extinct species": 455–458। আইএসএসএন 1055-7903ডিওআই:10.1016/j.ympev.2010.05.010পিএমআইডি 20478386 
  15. Elzinga, David C.; Boggess, Erin (২০২০-১০-২৯)। "An agent‐based model determining a successful reintroduction of the extinct passenger pigeon"। আইএসএসএন 0890-8575ডিওআই:10.1111/nrm.12292অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  16. Corvo, Shannon (১ জুলাই ২০২০)। "Outback flamingos, giant penguins on new list of extinct Australian birds"ABC News। Australian Broadcasting Corporation। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুলাই ২০২০ 
  17. Flinders University (২৬ জুন ২০২০)। "No leg to stand on for Australia's flamingos"Phys.org। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুলাই ২০২০ 
  18. Worthy, Trevor H.; Nguyen, Jacqueline M. T. (২ জানুয়ারি ২০২০)। "An annotated checklist of the fossil birds of Australia"। Informa UK Limited: 66–108। আইএসএসএন 0372-1426ডিওআই:10.1080/03721426.2020.1756560অবাধে প্রবেশযোগ্য। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুলাই ২০২০ – Taylor & Francis online-এর মাধ্যমে।