দোলন
চন্দ্র জ্যোতির্বিদ্যায় দোলন হল পৃথিবীস্থ পর্যবেক্ষকদের দ্বারা অনুভূত চাঁদের দোলায়িত নড়াচড়া যা তাদের পটভূমির পরিবর্তনের কারণে ঘ'টে থাকে । এটি কোনো পর্যবেক্ষককে বিভিন্ন সময়ে চন্দ্রপৃষ্ঠের সামান্য ভিন্ন ভিন্ন গোলার্ধ দেখার অবকাশ দেয় । দূরত্বের পরিবর্তনের কারণে চাঁদের আপাত আকারের পরিবর্তনের কারণ এবং প্রভাব উভয় ক্ষেত্রেই এটি একই রকম । এটি নিম্নবর্ণিত তিনটি প্রক্রিয়ায় ঘটে, যার মধ্যে দুটি পৃথিবী প্রয়োগিত মহাকর্ষীয় প্রবাহ-বলের মাধ্যমে তুলনামূলক ক্ষীণ ভৌত দোলন ঘটায় । এই ধরনের সত্যিকারের দোলনসমূহ আবদ্ধ ঘূর্ণনযুক্ত অন্যান্য চাঁদের জন্যও পরিচিত ।
একটি ট্রোজান গ্রহাণুর গতিবিধির সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রপঞ্চকে বলা হয় ট্রোজান দোলন ; এবং ট্রোজান দোলন বিন্দু মানে ল্যাগ্রাঞ্জীয় বিন্দু ।
চান্দ্র দোলন
[সম্পাদনা]মহাকর্ষীয় প্রবাহাবদ্ধতার কারণে চাঁদ নিজের একটি গোলার্ধকে পৃথিবীর দিকে মুখ করে রাখে। তাই, ৭ অক্টোবর, ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত অন্বেষকযান লুনা ৩ চাঁদে না পৌঁছানো পর্যন্ত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা আরও চন্দ্র অন্বেষণ না হওয়া পর্যন্ত চাঁদের দূরপৃষ্ঠের প্রথম দর্শন সম্ভব হয় নি। এই সাধারণ চিত্রটি কেবল প্রায়-সত্য কেননা সময়ের সাথে সাথে, চন্দ্রপৃষ্ঠের অর্ধেকের একটু বেশি (মোট প্রায় ৫৯%) দোলনের কারণে পৃথিবী থেকে দেখা যায়।[১]
চান্দ্র দোলন পরিপ্রেক্ষিতের তিনটি পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত হয়: অ-বৃত্তাকার ও আনত কক্ষপথ, পৃথিবীর সসীম আকার এবং মহাকাশে চাঁদের অভিযোজন। এর মধ্যে প্রথমটিকে বলা হয় চাক্ষুষ দোলন, দ্বিতীয়টিকে লম্বন দোলন এবং তৃতীয়টিকে ভৌত দোলন। অবদানানুযায়ী এদের প্রতিটিকে দুটি ভাগ করা যায়।
চান্দ্র দোলন নিম্নোক্ত চার প্রকারের :
- চাক্ষুষ দোলন, দ্রাঘিমাংশীয় ও অক্ষাংশীয় দোলনের সম্মিলিত দোলন চন্দ্রের প্রদক্ষিণকালে উপ-পৃথিবী বিন্দুর নড়াচড়া ও চাঁদের সাময়িকভাবে দৃশ্যমান অংশগুলির মধ্যে একটি দোদুল্যমান দৃশ্য তৈরি করে। এটিকে, চাঁদের উপবৃত্তাকার প্রদক্ষিণকালে, চাঁদ এবং পৃথিবীর মধ্যকার দূরত্বের পরিবর্তনের কারণে চাঁদের আপাত আকারের পরিবর্তনের সাথে বা চাঁদের আনত অক্ষের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে অবস্থানগত কোণের পরিবর্তনের সাথে, কিংবা চাঁদের প্রদক্ষিণকালে পৃথিবীর আনত অক্ষের আপেক্ষিক অবস্থানের কারণে চাঁদের পর্যবেক্ষিত দোলন গতির সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।[২]
- দ্রাঘিমাংশীয় দোলন ঘটে পৃথিবীর চারপাশে চাঁদের কক্ষীয় উৎকেন্দ্রিকতার কারণে ; চাঁদের ঘূর্ণন কখনও বাড়ে ও কখনও কখনও তার কক্ষপথের অবস্থান থেকে পিছিয়ে যায়। ১৬৪৮ সালে জোহানেস হেভেলিয়াস দ্রাঘিমাংশে চন্দ্রের দোলন আবিষ্কার করেন।[৩] এটি প্রশস্ততায় ৭°৫৪′ পর্যন্ত হতে পারে।[৪] দ্রাঘিমাংশীয় দোলন পৃথিবীর একজন পর্যবেক্ষককে চাঁদের প্রদক্ষিণকালে বিভিন্ন ধাপে যথাক্রমে চাঁদের পশ্চিম এবং পূর্ব দিকের আরও কিছুটা দেখার অবকাশ দেয়।[২]
- অক্ষাংশীয় দোলন ঘটে চাঁদের ঘূর্ণন অক্ষ এবং পৃথিবীর চারপাশে এটির স্বাভাবিক কক্ষপথীয় সমতলের মধ্যকার সামান্য আনতি (প্রায় ৬.৭°) থেকে। এটির উৎস সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর আবর্তন থেকে যেভাবে ঋতুসমূহ উদ্ভব হয় তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। গ্যালিলিও গ্যালিলিকে কখনও কখনও ১৬৩২ সালে অক্ষাংশে চান্দ্র দোলন আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়, [৩] যদিও টমাস হ্যারিয়ট বা উইলিয়াম গিলবার্ট তার আগেই এটি করে থাকতে পারেন।[৫] ক্যাসিনির নীতি লক্ষণীয়। এটি প্রশস্ততায় ৬°৫০′ অবধি পৌঁছাতে পারে।[৪] ৬.৭º নির্ভর করে কক্ষপথের ৫.১৫º আনতি ও ১.৫৪º ঋণাত্মক বিষুবীয় আনতির ওপর। অক্ষাংশীয় দোলন পৃথিবীর একজন পর্যবেক্ষককে চাঁদের কক্ষপথের বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদের উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু ছাড়িয়ে দেখার অবকাশ দেয়।[২]
- লম্বন দোলন পৃথিবীর যেখান থেকে চাঁদকে দেখা যায় সেখানকার দ্রাঘিমাংশ এবং অক্ষাংশ উভয়ের উপর নির্ভর করে।
- আহ্নিক দোলন হল পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে ঘটা ছোট দৈনিক দোলন যা একজন পর্যবেক্ষককে পৃথিবী ও চাঁদের কেন্দ্রদ্বয়কে যুক্তকারী সরল রেখার একপাশ থেকে অন্য আরেক পাশে নিয়ে যায়, এবং পর্যবেক্ষককে প্রথমে চাঁদের একপাশের ও পরে আরেক পাশের চতুর্দিক দেখার অবকাশ দেয় — যেহেতু পর্যবেক্ষক পৃথিবীর কেন্দ্রে নয় পৃষ্ঠে থাকে। এটি বিস্তারে ১° পর্যন্ত হয়।[৪]
- ভৌত দোলন হল অভিন্ন ঘূর্ণন এবং অক্ষীয় অগ্রগতি সম্পর্কিত মহাকাশে পারিপার্শ্বিকায়নের দোলন। ৩টি অক্ষের সবগুলিতেই ভৌত দোলন আছে। এদের আকার প্রায় ১০০ আর্ক সেকেন্ড। পৃথিবী থেকে এর পরিমাণ ১ সেকেন্ডের কম দেখা যায়। চাঁদের কক্ষপথ এবং আকৃতি দেখে জোরপূর্বক ভৌত দোলনের পূর্বাভাস দেওয়া যেতে পারে। মুক্ত ভৌত দোলনের সময়কালও ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে, তবে তাদের বিস্তার এবং পর্যায়গুলি ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ World Book at NASA।
- ↑ ক খ গ SVS, NASA's (২০২১-০৮-১৮)। "SVS: Moon Phase and Libration, 2020"। Home - NASA Scientific Visualization Studio। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-০১।
- ↑ ক খ Highlights of Astronomy: As Presented at the XXIst General Assembly of the IAU, 1991। Springer Science & Business Media। ২০১৩। পৃষ্ঠা 521। আইএসবিএন 978-9401128285।
- ↑ ক খ গ Ratkowski, Rob; Foster, Jim (মে ৩১, ২০১৪)। "Libration of the Moon"। Earth Science Picture of the Day।
- ↑ Stephen Pumfrey: Harriot’s Maps of the Moon: New Interpretations. Notes Rec. R. Soc. 63, 2009, doi:10.1098/rsnr.2008.0062.