সিংহ সার্থ আজু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নেপালের একটি সচিত্র পাণ্ডুলিপিতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে সিংহ সার্থ এবং অন্যান্য বণিকদের দানবীদের থেকে পলায়নের দৃশ্য
ইয়ারলুং শাংপো নদীতে অগ্রভাগে বাঁকানো অশ্বমুখ বিশিষ্ট খেয়া নৌকা, ১৯৩৮

সিংহ সার্থ আজু (দেবনাগরী: सिंह सार्थ आजु) (বিকল্প নাম: সিংহ সার্থ বাহু, সিংহ সার্থ বাহা, সিংহসার্থ বাহু) নেপালি লোকসাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য বণিক।[১][২] ঐতিহ্য অনুসারে তিনি কাঠমান্ডু থেকে তিব্বত গমনকারী প্রথম নেওয়ার বণিক। তার বাণিজ্যযাত্রার কাহিনী নেওয়ার সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সিংহ সার্থকে অনেক সময় গৌতম বুদ্ধের পূর্বতন অবতার হিসেবে অভিহিত করা হয়।[৩][৪]

কিংবদন্তি[সম্পাদনা]

সিংহ সার্থ নেপাল থেকে তিব্বতে একটি বাণিজ্য যাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা এমন একটি জায়গায় পৌঁছান যেখানে অনেক স্ত্রীলোক একত্রে সমাবেশ করছিলেন এবং বণিকেরা তাদের মায়ায় আবিষ্ট হিয়ে যান। তারা তাদের বাণিজ্যযাত্রার কথা ভুলে প্রত্যেকে একটি করে নারী পরিগ্রহ করেন এবং আমোদ ফুর্তিতে দিন অতিবাহিত করতে থাকেন। এক রাত্রে তৈল প্রদীপের শিখায় করুণার বোধিসত্ত্ব করুণাময় সিংহ সার্থের নিকট আবির্ভুত হন এবং তাকে এই বলে সতর্ক করেন যে, তাদের সুদর্শনা প্রণয়ীরা প্রকৃতপক্ষে দানবী, যারা তাদের খাওয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তিনি সিংহ সার্থকে পরীক্ষার্থে তার প্রণয়িনীর পা দেখতে বলেন। কেননা, দানবীদের পায়ের পাতা সাধারণের চেয়ে উলটো দিকে ছিল।

এরপর করুণাময় তাকে ও তার সহযাত্রীদের উদ্ধার করার আশ্বাস দেন। তিনি সেই নারীরূপী দানবীদের পূর্বে সকলকে ঘুম থেকে উঠে নদীর ধারে যেতে বলেন, যেখানে একটি পাখাযুক্ত অশ্ব বা ঘোড়া দেখতে পাবে। সেই ঘোড়ায় চড়েই তারা নদী পার হয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যেতে পারবে। যাই হোক না কেন, তিনি তাদের পেছন দিকে ফিরে তাকাতে নিষেধ করেন, যার অন্যথা হলে দানবীরা তাদের ঘোড়া থেকে টেনে নামিয়ে হত্যা করতে সক্ষম হবে।

সিংহ সার্থ বুদ্ধের এই বার্তা সকলকে জানান, এবং তারা প্রত্যেকে রাক্ষসপুরী থেকে পলায়নের সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্বেই তারা ঘর থেকে বেরিয়ে নদীর তীরে পৌঁছে যান। কথামতো তারা সেখানে একটি ঘোড়া দেখতে পান এবং তার পিঠে চড়ে বসেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী, বোধিসত্ত্ব স্বয়ং ঘোড়ার রূপে তাদের সহায়তা করেছিলেন। ঘোড়া উড্ডয়ন করা মাত্রই নারীরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে এবং তাদের রেখে যেতে নিষেধ করতে থাকে। দানবীদের আকুল কান্নায় ভুলে বণিকেরা পেছনে ফিরে তাকায় এবং সাথে সাথে দানবীরা তাদের ঘোড়া থেকে ফেলে দেয়। সিংহ সার্থই একমাত্র আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় এবং নিরাপদে নেপালে ফিরে আসেন।[৫][৬]

পরম্পরা[সম্পাদনা]

তিব্বতের ইয়ারলুং শাংপো নদীতে চলাচলকারী খেয়া নৌকাগুলোর মাথা কাঠের ঘোড়ার মতো করে নেওয়া হয়, যা সিংহ সার্থকে নিরাপদে বহনকারী অশ্ব শ্যামকর্ণের প্রতিনিধিত্ব করে। লাসার বারখোরে একদা সিংহ সার্থের নামে উৎসর্গীকৃত স্তূপ বিদ্যমান ছিল।[৭] তিব্বতের জাম্পালিংয়ে অনুষ্ঠিত ঐতিহ্যাবাহী একটি মেলা সিংহ সার্থের স্মৃতি বহন করে, যিনি তিব্বতী ভাষায় নরবু সঙ্গ্যা নামে পরিচিত। জাম্পালিংয়ের মহাস্তূপের নিকট তার স্মরণে একটি সৌধ ছিল, যা চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।[৮]

কাঠমান্ডুতে সিংহ সার্থকে বুদ্ধের অবতার চকন দ্যঃ (चकं द्य:) রূপে দেবতাজ্ঞান করা হয়। এমনকি মার্চের পূর্ণিমার মিছিলে শহরব্যাপী তার মূর্তি বাহিত হয়।[৯] সিংহ সার্থকে কাঠমান্ডুর ঠমেলের ঠম্বহিল (বিকল্প নাম বিক্রমশীলা মহাবিহার বা ভগবান বহল) বিহারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়।[১০]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Lewis, Todd T. (নভেম্বর ১৯৯৩)। "Newar-Tibetan Trade and the Domestication of Siṃhalasārthabāhu Avadāna"History of Religions। University of Chicago Press। ১৭ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০১২  Pages 135-160.
  2. Slusser, Mary Shepherd (1982). Nepal Mandala: A Cultural Study of the Kathmandu Valley. Princeton University Press. আইএসবিএন ০৬৯১০৩১২৮২, 9780691031286. Page 363.
  3. Tuladhar, Prem Hira (2009) The Past Lives of the Buddha. Kathmandu: Hira Shobha Tuladhar. আইএসবিএন ৯৭৮-৯৯৩৭-২-১৪৯৭-১. Page 132.
  4. Sakya, Karna and Griffith, Linda (1980). Tales of Kathmandu: Folktales from the Himalayan kingdom of Nepal. House of Kathmandu. Page 28.
  5. তুলাধর, কমল (২০১১)। Caravan to Lhasa : A merchant of Kathmandu in traditional Tibet (২য় সংস্করণ)। কাঠমাণ্ডু: Lijala & Tisa। পৃষ্ঠা ৫৭–৫৮। আইএসবিএন 99946-58-91-3 
  6. Lall, Kesar (1966). Lore and legend of Nepal. Ratna Pustak Bhandar. Page 28.
  7. Tuladhar, Kamal Ratna (2011) Caravan to Lhasa: A Merchant of Kathmandu in Traditional Tibet. Kathmandu: Lijala & Tisa. আইএসবিএন ৯৯৯৪৬-৫৮-৯১-৩. Page 62.
  8. Shakya, Harsamuni (১৯৯২)। "Jampaling Festival: Newar Buddhist Festival in Tibet"Buddhist Himalaya: A Journal of Nagarjuna Institute of Exact Methods। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুলাই ২০১২ 
  9. Yoshizaki, Kazumi (২৫ নভেম্বর ২০০৬)। "The Kathmandu Valley as a Water Pot: Abstracts of research papers on Newar Buddhism in Nepal"। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০১২  Page 95.
  10. Pradhan, Damodar (মে ২০১২)। "Prajñāpāramitā"। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুলাই ২০১২  Pages 8-10.