সাদা ফসফরাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
১৯৩১ সালে একটি জাহাজের উপর সাদা ফসফরাস পরীক্ষা হয়

সাদা ফসফরাস হলো একটি অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ। এটাকে আগ্নেয় অস্ত্র হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। এটা অনেক উজ্জ্বল আলো ও ধোঁয়া ছড়াতে পারে। এর মূল উপাদান হলো ফসফরাসেরই একটি আইসোটোপ। এটা মানব শরীরের জন্য খুবই বিপদজনক। এটা মানুষের ত্বকের নরম টিস্যুতে প্রথম আঘাত আনে। এরপর এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে। অধিক সময় এর সংস্পর্শে থাকলে সেই ব্যক্তি মারা যেতে পারে।

প্রস্তুতি[সম্পাদনা]

খনিজ ফসফেট-চূর্ণ (ফসফোরাইট) বা অস্থিভস্মের সঙ্গে কোক এবং বালি বা সিলিকা (SiO2) ভালোভাবে মিশিয়ে বদ্ধ বৈদ্যুতিক চুল্লিতে উচ্চ তাপমাত্রায় (১৭৭৩K) উত্তপ্ত করে সাদা ফসফরাস প্রস্তুত করা হয়।

গঠনাকৃতি[সম্পাদনা]

সাদা ফসফরাস অণু চতুষ্পরমাণুক (tetraatomic), অর্থাৎ সাদা ফসফরাস P4 এককরূপে অবস্থান করে। অণুটির ৪টি P-পরমাণু একটি সুষম চতুস্তলকের চারটি শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করে। এই চতুস্তলকের P-P-P কোণের মান ৬০°। 3s কক্ষকস্থিত ইলেকট্রন-জোড়টি ফসফরাস পরমাণুর ওপর নিঃসঙ্গ ইলেকট্রন-জোড় হিসেবে থাকে। তিনটি 3p কক্ষকের (3px, 3py, 3pz) তিনটি বিজোড় ইলেকট্রন, চতুস্তলকের অপর তিনটি শীর্ষবিন্দুতে অবস্থিত তিনটি P পরমাণুর প্রত্যেকটির 3p কক্ষকের বিজোড় ইলেকট্রনের সঙ্গে ইলেকট্রন-জোড় গঠনের মাধ্যমে তিনটি P-P সিগমা বন্ধন গঠন করে। যেহেতু দুটি p-কক্ষক পরস্পরের সঙ্গে ৯০° কোণে অবস্থান করে, তাই P-P-P বন্ধন-কোণ ৯০° হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কোণটির মান ৩০° কমে যাওয়ায় অণুটিতে কৌণিক পীড়ন (angle strain) -এর সৃষ্টি হয়। অণুটি পীড়নমুক্ত হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা দেখায়। এ কারণে সাদা ফসফরাসের স্থায়িত্ব কম এবং রাসায়নিক সক্রিয়তা বেশি।

ভৌত ধর্ম[সম্পাদনা]

  • সাদা ফসফরাস মোমের মতো নরম ও রসুনের মতো গন্ধযুক্ত সাদা কেলাসিত কঠিন পদার্থ। আলোকের উপস্থিতিতে এটি হালকা হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
  • এটি অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ। দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্বাসের সঙ্গে ফসফরাস বাষ্প গ্রহণ করলে চোয়াল ও গালের হাড় ক্ষয় হয়। ফসফরাস-ঘটিত এই বিষক্রিয়া তথা রোগকে ফসি-জ (Phosy-jaw) বলে।
  • P4 অণুগুলির মধ্যে দুর্বল ভ্যান-ডার-ওয়াল্স্ আকর্ষণ বল ক্রিয়া করে বলে এর গলনাঙ্ক (৩১৭K) ও স্ফুটনাঙ্ক (৫৫৩K) বেশ কম।
  • এটি জলে অদ্রাব্য, কিন্তু অ্যালকোহল, ক্লোরোফর্ম, ইথার, কার্বন ডাইসালফাইড, বেঞ্জিন প্রভৃতি জৈব দ্রাবকে দ্রাব্য।
  • এটি তাপ ও তড়িতের কুপরিবাহী।
  • বাষ্পীয় অবস্থায় P4 অণু ১০৭০K উষ্ণতা পর্যন্ত স্থিতিশীল। এর থেকে বেশি তাপমাত্রায় P4 অণু বিয়োজিত হয়ে P2 অণুতে পরিণত হয়।

রাসায়নিক ধর্ম[সম্পাদনা]

বায়ুর সঙ্গে ক্রিয়া[সম্পাদনা]

কৌণিক পীড়নের জন্য সাদা ফসফরাস অত্যন্ত সক্রিয়। সাধারণ তাপমাত্রায় বায়ুতে তথা অক্সিজেনের সংস্পর্শে সাদা ফসফরাস স্বতঃজারিত হয়ে ফসফরাস ট্রাইঅক্সাইড উৎপন্ন করে। এই স্বতঃজারণের সময় এক ধরনের সবুজ শিক্ষার সৃষ্টি হয় যাতে হাত দিলে তাপ অনুভূত হয় না। এজন্য একে শীতল শিখা বলে। অন্ধকারে এই শিক্ষা উজ্জ্বলতর হয়। ফসফরাসের এই ধর্মকে ফসফরাসের অনুপ্রভা (phosphorescence) বলে। অনুপ্রভা সৃষ্টির জন্য সামান্য জলীয় বাষ্পের উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। ৩০৩K তাপমাত্রায় সাদা ফসফরাস বায়ু বা অক্সিজেনের সংস্পর্শে জ্বলে ওঠে এবং জারিত হয়ে ফসফরাস পেন্টক্সাইডের সাদা ধোঁয়া উৎপন্ন করে। বায়ুতে স্বতজারিত হয় বলেই ফসফরাসকে প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না। স্বতঃজারণ রোধ করার জন্য সাদা ফসফরাসকে জলে ডুবিয়ে রাখা হয়।

ধাতুর সঙ্গে বিক্রিয়া[সম্পাদনা]

সাদা ফসফরাস তীব্র তড়িৎ-ধনাত্মক ক্ষার ধাতু (Na, K প্রভৃতি) ও ক্ষারীয় মৃত্তিকা ধাতু (Ca, Mg প্রভৃতি) দ্বারা বিজারিত হয়ে আয়নীয় ফসফাইড যৌগে পরিণত হয়।

অধাতুর সঙ্গে বিক্রিয়া[সম্পাদনা]

  1. হ্যালোজেনের সংস্পর্শে সাদা ফসফরাস স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলে ওঠে এবং ফসফরাস ট্রাইহ্যালাইড (PX3) ও ফসফরাস পেন্টাহ্যালাইড (PX5) যৌগে পরিণত হয়।
  2. সাদা ফসফরাস সালফারের সঙ্গে বিস্ফোরণসহ বিক্রিয়া করে একাধিক সালফাইড যৌগ, যেমন- P2S3, P2S5, P4S3, P4S7 বা P4S10 উৎপন্ন করে। P4S3 যৌগটি দেশলাই শিল্পে ব্যবহৃত হয়।

ক্ষারের সঙ্গে বিক্রিয়া[সম্পাদনা]

নিষ্ক্রিয় পরিবেশে সাদা ফসফরাসকে NaOH  বা KOH এর মত তীব্র ক্ষারের গাঢ় জলীয় দ্রবণ সহযোগে উত্তপ্ত করলে ফসফিন গ্যাস এবং হাইপোফসফাইট লবণ উৎপন্ন হয়। এটি একটি ডিসপ্রোপর্শনেশন বিক্রিয়া। এক্ষেত্রে P এর জারণ সংখ্যা (0) PH3 -তে হ্রাস পেয়ে -3 এবং NaH2PO2 -তে বৃদ্ধি পেয়ে +1 হয়।

বিজারণ ধর্ম[সম্পাদনা]

অক্সিজেনের প্রতি ফসফরাসের তীব্র আসক্তি আছে। মৌল ফসফরাসের জারণ সংখ্যা 0(শূন্য) এবং এর +3 এবং +5 জারণ স্তরে উত্তীর্ণ হওয়ার বিশেষ প্রবণতা আছে। সুতরাং, সাদা ফসফরাস একটি তীব্র বিজারক পদার্থ যা বিভিন্ন বিক্রিয়ায় জারিত হয়ে ফসফরিক অ্যাসিড (P -এর জারণ সংখ্যা +5) ও ফসফরাস অ্যাসিডে (P -এর জারণ সংখ্যা +3) পরিণত হয়।

  1. সাদা ফসফরাস HNO3 -কে NO2 এবং H2SO4 -কে SO2 -তে বিজারিত করে।
  2. সাদা ফসফরাস কপার, সিলভার এবং গোল্ড-এর লবণকে সংশ্লিষ্ট ধাতুতে বিজারিত করে।
  3. কপার লবণের জলীয় দ্রবণকে সাদা ফসফরাস-সহ সামান্য উত্তপ্ত করলে কালো বর্ণের কপার ফসফাইড (Cu3P2) অধঃক্ষিপ্ত হয়।

সতর্কতা[সম্পাদনা]

সাদা ফসফরাস অত্যন্ত বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক পদার্থ। পরীক্ষাগারে কাজ করার সময় অসাবধানতাবশত হাতে বা শরীরের কোথাও সাদা ফসফরাস লেগে গেলে সেই স্থান সঙ্গে সঙ্গে কপার সালফেট দ্রবণ দ্বারা ধুয়ে ফেলা উচিত। কারণ, কপার সালফেট ফসফরাসকে জারিত করে ফসফরিক অ্যাসিডে পরিণত করে, যা ক্ষতিকারক নয়।