সবিতা রায়চৌধুরী
সবিতা রায়চৌধুরী | |
---|---|
জন্ম | ১৯৩২ আমতোল নোয়াটা, শৃখোল, যশোর, অবিভক্ত ভারতবর্ষ, (বর্তমানে বাংলাদেশ) |
মৃত্যু | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, নববারাকপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
ধরন | ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, কথাসাহিত্যিক |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি | বেলা অবেলা, এখন প্রদোষকাল |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | আশাপূর্ণা দেবী স্মারক সম্মান |
দাম্পত্যসঙ্গী | সত্যপ্রকাশ রায়চৌধুরী |
সন্তান | গায়ত্রী দত্ত (কন্যা), তনুশ্রী রায় (কন্যা), কবি ও প্রাবন্ধিক সুব্রত রায়চৌধুরী (পুত্র), দেবব্রত রায়চৌধুরী (পুত্র) |
সবিতা রায়চৌধুরী (১৯৩২ – ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। মূলত ছোটগল্পকার হিসাবেই তিনি সমধিক পরিচিত। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জীবনযন্ত্রণা, উদ্বাস্তু মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই, বেকারত্ব,[১] সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই সবিতাদেবীর রচনার মূল উপজীব্য। ব্যক্তিজীবনে নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ সবিতাদেবী ছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা। বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাষায় তার জ্ঞান বিশেষত ছিল না। বঞ্চিত হয়েছিলেন প্রথাগত শিক্ষালাভেও। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণশক্তির মাধ্যমে জীবনের পড়ন্ত বেলায় ৬০ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করে তিনি অর্জন করেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখিকার আসন।[২] তাঁর বেলা অবেলা (উপন্যাস), রোদবৃষ্টি (গল্পগ্রন্থ), এখন প্রদোষকাল (গল্পগ্রন্থ) গ্রন্থগুলি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির মধ্যে অন্যতম। পেয়েছেন যোগেশচন্দ্র বাগল প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকার পক্ষ থেকে আশাপূর্ণা দেবী স্মারক সম্মান।[৩]
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
[সম্পাদনা]জন্ম ১৯৩২ (৩১ কার্তিক ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) সালে বর্তমান বাংলাদেশের যশোহর জেলার শৃখোল গ্রামে। ছয় মাস বয়সেই বাবা নগেন্দ্রনাথ মিত্র মারা যান। মা কিরণশশী মিত্র অত্যন্ত কষ্টে দেওর কিরণ মিত্রের সহযোগিতায় যৌথ পরিবারের আবহাওয়ায় মানুষ করে তোলেন দুই কন্যা পুষ্পরাণী শিকদার ও লেখিকা সবিতা রায়চৌধুরীকে। বিবাহ হয় যশোহর জেলারই মাগুরার বীরেশ্বর রায়চৌধুরীর পুত্র শ্রী সত্যপ্রকাশ রায়চৌধুরীর সঙ্গে।[৪] লেখিকার বড়ো ছেলে সুব্রত রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক।[৫]
শিক্ষা ও জীবনসংগ্রাম
[সম্পাদনা]তখনকার দিনে ছেলেরা পড়াশুনা করতে পারলেও মেয়েদের সে উপায় ছিল না। তার উপর সবিতাদেবীর বাবা ছয় মাস বয়সেই দেহ রেখেছিলেন বলে তিন ভাই-বোনকে নিয়ে মা কিরণশশী মিত্র ভাসুর ঠাকুরপোর সংসারে পরান্নভোজী হিসাবেই দিন কাটাতেন। জ্যাঠামশাই বা কাকা পিতৃহারা ভাইঝিকে ভালোবাসতেন বটে, তবে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন নি।[৩] একদিন সবিতাদেবী বাইরের ঘরে এক যুবককে আবিষ্কার করলেন। প্রতিদিন সকালে তিনি দাদাদের পড়াতেন। মাঝে মাঝে লুকিয়ে তিনি দেখতেন দাদাদের পড়াশোনা। বড্ড লোভ হত। ভাবতেন তাকেও যদি একটু বসতে দিত ওদের পাশে। কিন্তু মেয়েদের তো পড়তে নেই, ছোটবেলায় পুতুল খেলতে হয়। আর একটু বড় হলেই পুতুলের মতো সংসার পাততে হয়। কাজেই সব ইচ্ছেটুকুকে লাগাম দিয়ে রেখেছিলেন। তবু এরই ফাঁকে দাদাদের সাথে ভাব জমিয়ে শিখে ফেলেছিলেন অক্ষরমালা।[৪] আর এ ভাবেই একসময় হয়ে গেল তাঁর বর্ণপরিচয়।[৬]
প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও শ্বশুরবাড়ীতেই বিদ্যাচর্চার শুরু। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গেল অবিভক্ত ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)যশোর জেলার মাগুরা শহরে রায়চৌধুরীদের একান্নবর্তী বনেদি পরিবারে। সাতমহলা সে বাড়িতে বৈঠকখানার আলমারিতে সাজানো থাকতো বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এমন আরও অনেকের বই। গ্রাম থেকে এসে নতুন সংসারে সামান্য অক্ষরজ্ঞানটুকুর ভরসাতেই এ বইগুলোকে অবসর সময়ের সাথী করে নিয়েছিলেন সবিতাদেবী। ধীরে ধীরে স্বশিক্ষিত হয়েছেন স্বামীর উৎসাহে।[৩] স্বামী সত্যপ্রকাশ রায়চৌধুরী (ধ্রুব) যুবক বয়সে ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিট্রিশদের রক্তচক্ষুর কবলে পড়েছেন। পরবর্তীকালে যোগ দিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে।
ইতিমধ্যে এল দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, এল ডানাভাঙা স্বাধীনতা। স্বামী পরিবার সহ সবিতাদেবীকে চলে আসতে হল পশ্চিবঙ্গের কলকাতায়। সত্যপ্রকাশ যোগ দিলেন পুলিশের ওয়্যারলেস বিভাগে। বহুবছর ছিন্নমূল জীবনযাপনের পর অবশেষে সবিতাদেবীর ঠাঁই হলো উত্তর ২৪ পরগনা জেলার জঙ্গল পরিবেষ্টিত নতুন গ্রাম পশ্চিম মাসুন্দা বুড়ির বাড়ি অঞ্চলে। তখন এই গ্রামেই জঙ্গল কেটে যোগেশচন্দ্র বাগল, হরিপদ বিশ্বাসের মতো মানুষেরা তৈরি করতে শুরু করেছেন নতুন কলোনি নববারাকপুর। আবার নতুন করে সংসার পাতার পালা। শুধু রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধার দিন ফুরলো। তবু অভাব অনটন ছিলই। সন্তানদের বড়ো করা ও সাংসারিক নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়ে ফেললেন তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, অনুরূপা দেবী বা অনুবাদ সাহিত্য।[৭][৪]
সাহিত্যচর্চা
[সম্পাদনা]চার সন্তানের জননী সবিতাদেবীর লেখালেখি শুরু প্রৌঢ় বয়সে, জীবনের পড়ন্ত বেলায় প্রায় ৬০ বছর বয়সে। প্রথম দিকে গল্পগুলি পাণ্ডুলিপির পাতায় সীমাবদ্ধ ছিল। এ সময় নিজের বাড়িতেই ছেলেমেয়ে-নাতিনাতনিদের উৎসাহে কালবেলা নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেন তিনি। মূলত বড়ো ছেলে কবি ও প্রাবন্ধিক সুব্রত রায়চৌধুরীর উৎসাহে প্রথম গল্প মিতা প্রকাশ পায় ১৯৯১ সালে, পারিবারিক পত্রিকা কালবেলায়। এরপর অনেকগুলি গল্প লিখে ফেললেন। প্রকাশিত হল নানা পত্র-পত্রিকায়।[৮] সেই পত্রপত্রিকাগুলি হল, যোগেশচন্দ্র বাগল প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকা, অক্ষরমালা, আনন্দ দিশারী, কালবেলা প্রভৃতি। প্রথম গল্পগ্রন্থ রোদবৃষ্টি প্রকাশিত হয় ১৯৯৯-এ। এরপর একে একে প্রকাশ পেল দ্বিতীয় ছোঁয়া (গল্পগ্রন্থ, ২০০৫), বেলা অবেলা (উপন্যাস, ২০০৯)। গল্পগ্রন্থ এখন প্রদোষকাল (২০১৫)।
গ্রন্থ পরিচয়
[সম্পাদনা]গল্পগ্রন্থ: রোদবৃষ্টি (১৯৯৯)
[সম্পাদনা]গ্রন্থের নাম 'রোদবৃষ্টি'। এখানে আছে মোট নয়টি গল্প। গল্পগুলির নাম হলো :
- এক রোববারের গল্প
- শেষ সংলাপ
- অপেক্ষা
- বিজয়ার বাতাস
- একটি স্বপ্নের মৃত্যু
- ওরা বড় হয়েছে
- টান
- আহুতি
- রোদবৃষ্টি
শেষ গল্পের নামেই গল্পের নামকরণ করা হয়েছে। রোদবৃষ্টি গল্পের নায়ক-নায়িকা তথা দুই প্রধান চরিত্রের নাম রোদ আর বৃষ্টি। একদিন অফিস ফেরৎ ঝড়বৃষ্টির দুর্যোগের সময় দু'জনের দেখা। তারপর অনেকদিন কেটে গেলে রোদ কেবলই ভাবে আর ভাবে, বৃষ্টির আর দেখা নেই কেন? দেড়মাস কাল জ্বরে কাটলো রোদের। বহুদিন আর খোঁজ মেলে না বৃষ্টির। তারপর ফিরে আসে সেই পুরোনো জায়গায়, যেখানে বৃষ্টির সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। তার দু'চোখ চারদিকে ঘোরে আর বৃষ্টিকেই দেখতে চায়। শেষে একদিন দেখা হলো বৃষ্টির সঙ্গে। সেদিন তাঁর কপালে সিঁদুর, কোলে বাচ্চা। বৃষ্টি গাড়ির জানালায় মুখ রেখে জানতে চায়, আজও কি আপনার নামটা বলতে বাধা? রোদ বিষণ্ণ বেদনায় বলে― তার কি আর প্রয়োজন আছে! অদ্ভুত ইঙ্গিতময়তায় প্রথম শ্রেণির গল্পের এই সমাপ্তি। এখানেই লেখিকার কৃতিত্ব।
গল্পগ্রন্থ : দ্বিতীয় ছোঁয়া (২০০৫)
[সম্পাদনা]লেখিকা সবিতা রায়চৌধুরীর পরবর্তী গল্প সংকলন দ্বিতীয় ছোঁয়ার (২০০৫) অন্তর্গত গল্পগুলো হল :
- আলো ছায়া
- পথিক-তিথির দিনকাল
- হরিহর পন্ডিতের গল্প
- ভাসানো ফুলের মালা
- এবং একগাছা চুড়ি
ভাসানো ফুলের মালা গল্পটি উল্লেখযোগ্য। এই গল্পটির কেন্দ্রে আছে নারীসুলভ পক্ষপাতিত্বের চেনা কাহিনি। অকালে বাবা-মাকে হারিয়ে প্রশ্ন একেবারে অযাচিতের মতোই এসে পড়েছে তার কাকা কাকিমার সংসারে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও সে কোনদিনই কাকিমার মন জয় করতে পারেনি। কিন্তু খুড়তুতো বোন কলি তার দিদির কষ্ট ও বঞ্চনার সমব্যথী ছিল। প্রশ্নের মাঝে মাঝে জ্বর এবং তার সঙ্গে গলায় ব্যথা হলেও কাকিমা বীথি কোনদিনই তার অসুস্থতাকে গুরুত্ব দেয় নি। বাড়ির কাজগুলো ঠিক সময়ে সাঙ্গ হলেই সে খুশি হতো। প্রতিবেশী পরিতোষবাবুর ছেলে উত্তরের সঙ্গে প্রশ্নের একটা মধুর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।
প্রশ্নের কাকা দীনুবাবু শেষপর্যন্ত শুধু শাঁখা-সিঁদুর দিয়েই ভাইঝির সঙ্গে উত্তরের বিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এ নিয়ে পরিতোষবাবুর পরিবারের কোন ক্ষোভ ছিল না। তিনি শুধু মেয়েটিকে তাঁর পুত্রবধূ করতে চেয়েছিলেন। বিয়ের তিনমাস পরে প্রশ্নের গলায় ক্যান্সার ধরা পড়েছিল এবং উত্তরের কোলে মাথা রেখে নার্সিংহোমেই সে মারা গিয়েছিল। কলির কাছ থেকে উত্তর পরে জানতে পেরেছিল যে প্রশ্নের বাবা তাঁর মেয়ের জন্য অনেক টাকা ও গয়নাও রেখে গিয়েছিলেন, যা আত্মসাৎ করেছিল কলির বাবা মা। কলি স্পষ্টই বলেছিল যে, প্রশ্নের এই করুণ পরিণতির জন্য তার মা দায়ী। অনাথ ভাইঝিকে আশ্রিতা ভেবে নির্যাতন এবং অবহেলার ঘটনা চারপাশে ঘটে চলে এখনও।
পিতৃ-মাতৃহীন কন্যাসন্তানের দায় বোধহয় কেউই নিতে চায় না। আর নিলেও রাতদিন খাটিয়ে তা উশুল করে নেয়। এরা আজও আমাদের সমাজে সেই হতভাগি-ই থেকে গেছে। নির্যাতনের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোন বিকল্প পথের দিশা তারা খুঁজে পায় নি। আর সবিতাদেবীও তাঁর যুগে পারিবারিক শোষণের কাছে মেয়েদের আপোস করতেই বেশি দেখেছেন, লড়াই করতে কম দেখেছেন। এটিই উঠে আসে তাঁর এই গল্পে।
উপন্যাস : বেলা অবেলা (২০০৯)
[সম্পাদনা]রোদবৃষ্টি গল্পগ্রন্থের পর প্রকাশিত হয় উপন্যাস বেলা অবেলা (শারদোৎসব-২০০৯)। লেখকের ভাষায়,
একে গল্প উপন্যাস কোনো কিছুই বলবেন না। অতবড় মাপের কাজ করার সামর্থ আমার নেই। এ একান্তই এক ভুল ত্রুটিতে ভরা জীবনকথা।
উপন্যাসের কাহিনি হল এমন : পীতাম্বর চৌধুরী বেলা-অবেলা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। পিটুলি গাঁয়ে তাঁর বাড়ি একসময় তিনি এ-গাঁয়ের মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছেন। অনেক উপকার করেছেন মানুষের। তবে কাজের সূত্রে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হত দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। অবকাশে যখন বাড়ি ফিরতেন, তখনও তার বিশ্রাম ছিল না। কারো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কারো বাবা অসুস্থ, তিনি নিজে সেখানে ছুটে গিয়ে সব ব্যবস্থা করতেন। ছেলে মেয়েদের তিনি ভালোই মানুষ করেছিলেন। তারা সবাই লেখাপড়া শিখে দাঁড়িয়ে গেছে। অবশ্য তারা সকলেই বাইরে চাকুরি করে। তাই বিশাল বাড়িতে তাঁরা মাত্র দুজন- পীতাম্বর চৌধুরী নিজে, আর স্ত্রী শশীকলা। অবসরের পর তিনি ভেবেছিলেন এক, আর হলো আর এক। বাতের তীব্র ব্যথায় তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। তার পাশে চব্বিশ ঘণ্টা শুধু শশীকলা।
শশীকলার শৈশব কৈশোরের মায়াময় দিনগুলির ছবি তাঁর মানসপটে ভেসে ওঠে। শশীর আজও মনে পড়ে কুসুম পিসির বয়াম থেকে আচার চুরি করে বুলুদি তাকে দিত। আর কুসুম পিসির জীবনের কথা ভেবে শশীর চোখে জল আসে। কুসুম পিসিকে দেখতে ছিল ঠিক কুসুমেরই মতো। কুসুম বিয়ের পর পরই মাত্র ন'বছর বয়সে বিধবা হয়। বিধবা হয়ে ফিরে আসে বাপ-ভাইয়ের সংসারে। বিনা মাইনের সর্বক্ষণের দাসি হতে হয় কুসুম পিসিকে। অসুস্থ স্বামী পীতাম্বর চৌধুরীর শয্যাপার্শ্বে বসে রাত্রির মধ্যযামে শশীকলার কুসুমের দুঃখী জীবনের কথা মনে পড়ে।
কিছুকাল পরে পীতাম্বর-শশীকলার কাছে তাদের নাতি-নাতনি, ছেলে-বৌরা এসে হাজির হলো। তাঁরা ঘোষণা করল যে, অনেক চেষ্টা করে বিদেশ-বিভুঁই থেকে কেবল তাঁদের মা-বাবাকে দেখা শোনা করার জন্য ফিরে এসেছে। অবশেষে ওরা ঘোষণা করল যে, এই বিশাল অপ্রয়োজনীয় বাড়ি ভেঙে ফেলে বিরাট ফ্ল্যাটবাড়ি তুলতে হবে। পীতাম্বর শশীকলাকে বলল, ছেলেরা সামনে এসে বলতে পারল না, বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। এখানে চারতলা বিরাট ফ্ল্যাটবাড়ির কমপ্লেক্স গড়ে উঠবে। তারপর একদিন পিটুলি গাঁয়ের মানুষ সবিস্ময়ে দেখলো- পীতাম্বর চৌধুরীর বাড়ি ভাঙছে। শশীকলা আরও একা হয়ে গেল। কিন্তু শশীর গল্প শেষ হলো না। ওরা দুজন এসে পৌঁছালো হরিদ্বারে।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। সেখানেও শশীকলা দেখা পেল অত্যাচারিতা সহায় সম্বলহীন এক দুঃখী মেয়ের। নাম তার পুঁটি। পুঁটিকে আশ্রয় দিল শশীকলা। শেষে খুঁজে পেতে পুঁটির বিয়েও দিল। পাত্র কৃষাণ। কিন্তু পুঁটি চলে যাওয়ার পর থেকেই শশীকলা, আনমনা, গম্ভীর ও শোকার্ত।
শশী নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, সব ছেড়ে স্বামীর হাত ধরে বেরিয়ে পড়লে, তবে কেন রাস্তার উটকো ঝামেলা কাঁধে তুলে নিলে? শশী দেখে নিশুতি রাত, একফালি চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে গঙ্গার বুকে। গঙ্গা মা, আপন খুশিতে দু-কূল উত্তাল করে উদ্দাম গতিতে ছুটে চলেছে। সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে মুহূর্তের মধ্যে শশীর কাছে, সমাজ সংসার স্বামী পুত্র-কন্যা সব যেন মিথ্যে হয়ে যায়। তাঁর দু'চোখে নামে জলধারা। সে বলে ওঠে― সুন্দর, সুন্দর তোমার সৃষ্টি।
গল্প সংকলন : এখন প্রদোষকাল (২০১৫)
[সম্পাদনা]এখন প্রদোষকাল গল্প সংকলনটি লেখিকার মৃত্যুর পর প্রকাশিত। এ সম্পর্কে সূচনায় সুব্রত রায়চৌধুরী বিষণ্ণ সংবেদনায় লিখেছেন,
আমার মায়ের লেখা এই বইটি অনায়াসেই তিনি দেখে যেতে পারতেন। অন্তত তাহলে বইটি প্রকাশে বিলম্বজনিত কোনো অপরাধবোধ থাকতো না... গল্পগুলিতে জীবনের নানা বাঁকবদলের কথা থাকলেও তাতে ধরা পড়েছে বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের নানামুখী ভাঙনের কথা। তার মতো আমাদেরও তাই মনে হয়― এখন প্রদোষকাল।
এই গ্রন্থে গল্পের সংখ্যা মোট ১৯। তার মধ্যে আহুতি এবং একটি স্বপ্নের মৃত্যু, 'রোদ বৃষ্টি' গল্প সংকলনে (জানুয়ারি, ১৯৯৯) ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। মোট ১৭টি গল্পের বিন্যাস এইভাবে দেখানো যেতে পারে―
- এখন প্রদোষকাল
- পদ্মপুকুরে বেহুলার লাশ
- তুফান সুনামি
- লগ্নভ্রষ্টা
- একটি হারিয়ে যাওয়া নদী
- একটি সাধারণ মেয়ে
- সৌমেনের ঘর সংসার
- পলাশরাঙা গাছ
- কাঁটা তারের বেড়া
- পোষাকপরা মানুষ
- ওকে ধরিলে যে ধরা দেবে না
- আলগা খুঁটি
- একটি চিঠি ও ঝড়ের গল্প
- স্বরূপের ঘরে ফেরা
- বিসর্জন
- একটি অসম্ভব কথা
- খেলার পুতুল
পুরস্কার ও সম্মাননা
[সম্পাদনা]- বেলা অবেলা গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন যোগেশচন্দ্র বাগল প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে আশাপূর্ণাদেবী স্মারক সম্মান।[৩]
- তথ্যসূত্র গবেষণাপত্র কথাসাহিত্যিক সবিতা রায়চৌধুরী ও তাঁর স্বামী সত্যপ্রকাশ রায়চৌধুরীর সম্মানে চালু করেছে সত্য-সবিতা মেধা বৃত্তি।[৯][১০]
- তথ্যসূত্র গবেষণাপত্র প্রতি বছর সবিতাদেবী স্মারক সম্মান প্রদান করে তরুণ গবেষককে।[১১]
জীবনাবসান
[সম্পাদনা]এই জীবনব্যাপী লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪। তাঁর মৃত্যুতে 'আজকাল' সংবাদপত্রের প্রয়াণলেখায় গভীর শোক প্রকাশ করা হয়।[৩][১২] এই নিরলস, প্রচারবিমুখ মানুষটির মধ্যে সাহিত্যরসিক একটি মন যেমন ছিল, তেমনি ছিল সুগভীর সামাজিক অনুসন্ধিৎসা। যে অনুসন্ধিৎসা গবেষণারও অন্যতম মূল কথা। তাঁর এই লড়াইকে শ্রদ্ধা জানাতেই তথ্যসূত্র গবেষণাপত্রের পক্ষ থেকে তরুণ গবেষকদের সবিতাদেবী নামাঙ্কিত প্রতি বছর সবিতাদেবী স্মারক সম্মান প্রদান করা হয়।[১৩]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ রায়চৌধুরী, সবিতা। "এখন সময়, শারদীয়া (আশ্বিন), গল্প : সুমনের স্বপ্ন ও টুকরো টুকরো কয়েকটি ছবি"। www.srishtisandhan.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-৩০।
- ↑ "শ্রীচরণেষু ১"।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ সুব্রত রায়চৌধুরী, সম্পাদিত। "সবিতাদেবী স্মারক সংখ্যা"। তথ্যসূত্র গবেষণাপত্র। বিশেষ সংখ্যা।
- ↑ ক খ গ শাক্য সেন (২০২০)। গবেষণা গ্রন্থমালা ৩ : সবিতা রায়চৌধুরী। নবাবারকপুর, কলকাতা - ৭০০১৩১: তথ্যসূত্র।
- ↑ "সুব্রত রায়চৌধুরী"। উইকিপিডিয়া। ২০২২-০৭-২৩।
- ↑ "Sabita Roychowdhury"। www.facebook.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৪।
- ↑ "শ্রীচরণেষু ২"।
- ↑ বারিদবরণ ঘোষ। "আত্মকথায় ভগ্নদেশ"। সংবাদ প্রতিদিন। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৪।
- ↑ Sushanta Ghosh (২০২২-০৭-৩১)। "সত্য-সবিতা মেধাবৃত্তি ২০২১ | তথ্যসূত্র গবেষণাপত্র | Tattyasutra"।
- ↑ Sushanta Ghosh (২০২২-০২-০৮)। "সত্য-সবিতা মেধাবৃত্তি ২০২২ | তথ্যসূত্র গবেষণাপত্র | Tatthyasutra"।
- ↑ তথ্যসূত্র, গবেষণাপত্র (২০ ডিসেম্বর ২০১৮)। "সবিতাদেবী স্মারক সম্মান"। তথ্যসূত্র গবেষণাপত্র।
- ↑ "শ্রীচরণেষু ৩"।
- ↑ "তথ্যসূত্র"। www.facebook.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৪।