শ্রীশ্রীপরিহরেশ্বর দেবালয়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শ্রীশ্রীপরিহরেশ্বর দেবালয়
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
জেলাবরপেটা
অবস্থান
অবস্থানডুবি, পাঠশালা
দেশভারত
স্থাপত্য
সৃষ্টিকারীস্বর্গদেউ শিবসিংহ

শ্রীশ্রীপরিহরেশ্বর দেবালয় [১] হচ্ছে আসাম-এর বরপেটা জেলার পাঠশালা থেকে তিনি কিলোমিটার দূরের ডুবি গ্রামে অবস্থিত একটি দেবালয়। এই দেবালয় আসামের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত শৈবপীঠ তথা একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র। কুমার ভাস্করবর্মার ডুবির তাম্রলিপি এই পীঠস্থানের মহত্ব এবং গরিমা বহন করে আসছে। আসামের পুরাতত্ত্ব এবং ইতিহাস, এই দেবালয়টির সাথে গভীরভাবে যুক্ত এবং এটি আসামের এক গৌরবময় কীর্তিস্তম্ভ।

ভৌগোলিক অবস্থিতি[সম্পাদনা]

আসাম-এর বরপেটা জেলার ব্রহ্মপুত্র নদীর উত্তর পারে বজালী মহকুমার অন্তর্গত পাঠশালা শহর থেকে প্রায় তিনি কিলোমিটার দক্ষিণে ডুবি গ্রামে ২৬ ডিগ্রী ২৯ মিনিট (২৬°২৯') উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১ ডিগ্রী ৯ মিনিট ৪৫ সেকেণ্ড (৯১°৯'৪৫') পূর্ব দ্রাঘিমাংশ সংযোগস্থলে এই দেবালয় অবস্থিত। ৩১ নং জাতীয় সড়ক থেকে এর দূরত্ব ৪ কিলোমিটার এবং উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলপথ থেকে এর দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। গুয়াহাটি থেকে এর দূরত্ব ১০৩ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং বরপেটা শহর থেকে এটি ৩৭ কিলোমিটার পূর্বে। নিকটবর্তী রাষ্ট্র ভূটানের নাংলাম থেকে এটি ৫৩ কিলোমিটার দক্ষিণে।

যাতায়াত[সম্পাদনা]

নিকটবর্তী বিমানবন্দর গুয়াহাটি। দূরত্ব ১০৩ কিলোমিটার।
নিকটবর্তী রেলস্টেশন পাঠশালা। দূরত্ব ৩ কিলোমিটার।
নিকটবর্তী বাছ আস্থান পাঠশালা। দূরত্ব ৪ কিলোমিটার।

পাঠশালা শহর থেকে দেবালয় পর্যন্ত রিক্সা, অটোরিক্সা, টেম্পো ইত্যাদিতে যাতায়াতের সুবিধা আছে।

পরিসর[সম্পাদনা]

বিগ্রহর অবস্থিতি[সম্পাদনা]

পরিহরেশ্বর দেবালয়ের মূল বিগ্রহটি হচ্ছে শিব গোঁসাঁইয়ের। প্রায় ২১০ বর্গফুট আয়তনের গহ্বরের মধ্যে এচটা পাথরের উপর সংলগ্ন হয়ে বিগ্রহটি আছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২ ফুট নিচে এই বিগ্রহ অবস্থিত। লিঙ্গপীঠটি উত্তরদিকে এবং যোনিপীঠ বা গৌরীপীঠটি তার নিচে অবস্থিত। শিব লিঙ্গে দেওয়া পদ্ম অর্ঘ্য যোনিপীঠে গিয়ে মন্দির সংলগ্ন কুণ্ডে পড়ার ব্যবস্থা আছে। পূজার সময় দেওয়া সমস্ত জলপুষ্প শিলায় নির্মিত নল দিয়ে গিয়ে উত্তর দিকে থাকা পুষ্করিণীতে পড়ার ব্যবস্থা আছে।

মঠ এবং বরচ'রা[সম্পাদনা]

পরিহরেশ্বর দেবালয়ের বিগ্রেহর উপর একটি উঁচু মঠ বা দ'ল আছে। সেই মঠটি শিবসাগরের শিবদ'লের আদলে তৈরি করা। ১৯৬২ সালে এই মঠটি আরম্ভ করা হয়েছিল এবং সম্পূর্ণ হয়েছিল ১৯৮০ সালে। এই মঠের উচ্চতা ৫৫ ফুট এবং ব্যাস ২৪ ফুট। ১২ ফুট ব্যাসার্দ্ধের প্রায় ৭৫।৫ ফুট বৃত্তীয় পরিসীমাযুক্ত মঠটি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪ ফুট নিচে থাকা বিগ্রহটি জুড়ে আছে। মঠর সাথে একটি প্রশস্ত বরচ'রা সংলগ্ন হয়ে আছে। বরচ'রাটি বড়ো বড়ো শালের খুটার উপর টিনের চালি দিয়ে তৈরি করা। বরচ'রাটির দৈর্ঘ্য ৯০ ফুট এবং প্রস্থ ৪০ ফুট। মন্দিরের পূর্বদিকে ভোগ-মণ্ডপ আছে। এখানে গোঁসাঁইয়ের ভোগ রান্না করা হয়। ভোগ-মণ্ডপের উত্তরদিকে ভোগ-ঘর। এখানে যাত্রীরা ভোগ গ্রহণ করতে পারে। ভোগ-মণ্ডপের দক্ষিণদিকে যাত্রীদের বিশ্রাম ঘর, ভঁাড়ার ঘর এবং দেবালয়ের কার্যালয়।

কেতেকীবাড়ি[সম্পাদনা]

পরিহরেশ্বর দেবালয়ের পিছন দিকে প্রায় দুবিঘা জমি জুড়ে একটি কেতেকীবাড়ি আছে। এই কেতেকীবাড়ির সাথে এক জনশ্রুতি জড়িত হয়ে আছে। কোনো দেবদাসী শিবের সামনে নৃত্য প্রদর্শন করার সময় বারে বারে তালভঙ্গ হয়েছিল এবং খোপা সুলকি পড়েছিল। সেই দেবদাসীকে শিব অভিশাপ দিয়েছিলেন যে তিনি মর্ত্যে এসে কেতেকী ফুল হয়ে ফুল থেকে অন্যদের সুগন্ধি বিলাতে থাকবে। পরিহরেশ্বর দেবালয়ের এই কেতেকীবাড়িটি অঞ্চলবাসীর জন্যও এক গৌরবের সম্পদ। অতি প্রাচীন পরিহরেশ্বর দেবালয়ের দেবদাসী নৃত্যের নাচনীসমূহ খোপার কেতেকী ফুল গুঁজে নৃত্য প্রদর্শন করেছিলেন।

পুষ্পভদ্রা নদী[সম্পাদনা]

খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকে কালদিয়া নদীর একটি সুঁতি গোবিন্দপুর, বামুনকুছি, ডুবি ইত্যাদি গ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়ে পুনরায় উপরনদীতে কালদিয়া নদীর সাথে মিলেছিল। বর্তমান এই সুঁতি নেই, মরা সুঁতির রূপে অ'ত-ত'ত অল্প আছে। ১৮৮৪ সালের আগের জনগণনার নক্সায় এই নদীর অবস্থিতির কথা লিপিবদ্ধ করা আছে। এই সুঁতিটি পুষ্পভদ্রা নামে পরিচিত ছিল।

পুরানো তালগাছ[সম্পাদনা]

পরিহরেশ্বর দেবালয়ের চৌহদ্দির একেবারে পশ্চিম দিকে একটি অতি পুরানো তালগাছ আছে। বজালীর জনসাধারণের মধ্যে এই তালকে কেন্দ্র করে একটি প্রবাদ আছে "হাজোর শাল ডুবির তাল যখন দেখাদেখে হব পুষ্পভদ্রা নদী তখন মুক্তি পাব।" হাজোর হয়গ্রীব-মাধব মন্দিরে থাকা শালগাছ এবং ডুবির এই তালগাছ অনেক উঁচু হওয়ার জন্য, এবং উঁচু হয়ে দেখাদেখি হলেই বর্তমান মরে যাওয়া পুষ্পভদ্রা নদীটি পুনরায় সচল হবে বলে বজালীবাসী এই প্রবাদমতে বিশ্বাস করেন।

ঐতিহাসিক পটভূমি[সম্পাদনা]

ডুবির শ্রীশ্রীপরিহরেশ্বর দেবালয় আসামের শৈবপীঠসমূহের মধ্যে প্রাচীন, ঐতিহ্যপূর্ণ এবং জাগ্রতরূপে খ্যাত অন্যতম দেবালয়। এর ঐতিহাসিক পটভূমি অনেক পুরানো। এখানে থাকা ভাস্করবর্মার তাম্রলিপি থেকে এই দেবালয়ের বৈশিষ্ট্য এবং প্রাচীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। দেবালয়ের মূল মন্দিরের নির্মাণ সামগ্রী এবং আন্তঃগঠন দেখে এর নির্মাণকাল ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে নির্মাণ বলে ধারণা করা যায়। এই মন্দিরে পূজা-অর্চনা করা পুরোহিত ও কুমার ভাস্কর বর্মার ভূমিদান দেয়ার কথা তাম্রলিপিতে পাওয়া যায়।[২] অবশ্য কোনো কারণে এই মন্দিরের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছিল এবং আঠারশ শতকের তৃতীয় দশকের শুরুতে ধর্মবর নামের একজন ব্রাহ্মণ একটি কপিলী গাইকে বিরিণা এটির উপর দুধ দান করতে দেখে দেবালয়ের বিগ্রহটি আবিষ্কার করেন। আহোম রাজা শিবসিংহ-এর রাজত্বকালে ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরের বিগ্রহটি পুনরুদ্ধার হয় এবং রাজা লক্ষ্মীসিংহ-এর সময়ে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি নতুনভাবে তৈরি করা হয়। [১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. টিকেন্দ্রনাথ কলিতা (২০০৮)। "শ্রীশ্রীপরিহরেশ্বর দেবালয়ঃ অতীত এবং বর্তমান"।  অজানা প্যারামিটার |month= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  2. আদ্য শর্মা। "শ্রীশ্রীপরিহরেশ্বর দেবালয়ঃ অতীত এবং বর্তমান": অভিমত।