শ্রাবস্তী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শ্রাবস্তী
শ্রাবস্তী
Mulagandhakuti. The remains of Buddha's hut in Jetavana Monastery.
শ্রাবস্তী ভারত-এ অবস্থিত
শ্রাবস্তী
ভারতে অবস্থান
অবস্থানউত্তরপ্রদেশ, ভারত
ধরনরাজধানী শহর

শ্রাবস্তী (পালি: Sāvatthī) হচ্ছে কোশল রাজ্যের এক সমৃদ্ধশালী নগরী। প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। এর আগেও যে প্রাচীন ভারতে রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল না তা নয়, তবে সেই ইতিবৃত্তটি আজও তেমন স্পষ্ট নয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে প্রাচীন ভারতে ষোলোটি স্থানীয় রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই রাজ্যগুলির নাম বৌদ্ধগ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকয় তে পাওয়া যায়। বৌদ্ধসাহিত্যে এই রাজ্যগুলিকে ষোড়শ মহাজনপদ বলে অবহিত করা হয়েছে। এই ষোড়শ মহাজনপদগুলি হল: 'কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বজ্জি, মল্ল, চেদি, বৎস, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস, সুরসেনা, অস্মক, অবন্তী, গান্ধার এবং কম্বোজ।[১] গঙ্গার উত্তরে ছিল কোশল রাজ্য। এই রাজ্যেরই এক সমৃদ্ধশালী নগরী ছিল শ্রাবস্তী।

পরিচয়[সম্পাদনা]

কোশল রাজ্যের একটি নগরী হচ্ছে শ্রাবস্তী। কোশল একটি বৃহৎ রাজ্য ছিল। এতে অযোধ্যা, সাকেত ও শ্রাবস্তী এই তিনটি প্রধান নগরী ছিল। অযোধ্যা ছিল সরযু নদীর তীরবর্তী একটি নগরী। অযোধ্যা এবং সাকেত কে অনেক সময় অভিন্ন মনে করা হয়। কিন্তু রিস ডেভিডস উল্লেখ করেছেন যে গৌতম বুদ্ধের সময়ে দুইটি নগরীর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা জানা যায়। শ্রাবস্তীর বর্তমান নাম সাহেত-মাহেত। এর অবস্থান ছিল রাপ্তি নদীর দক্ষিণ তীরে। [২][৩]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

ভারত উপমহাদেশের মহাকাব্য রামায়ণ এর সূত্রপাত কোশল রাজ্যের অযোধ্যা নগরীটি থেকেই। বাল্মীকি একবার প্রশ্ন করেছিলেন, সম্প্রতি পৃথিবীতে যথার্থ গুণবান কে আছেন, বলুন তো? প্রত্যুত্তরে দেবর্ষি নারদ বললেন, মর্ত্যে সর্বগুণের আধার একজনকেই আমি জানি। তিনি ইক্ষ্বাকুবংশজাত রাম নামে এক রাজা। …স্রোতস্বতী সরযু নদীর তীরে ধনধান্যসমৃদ্ধ, আনন্দকলরোলমুখরিত কোশল নামে এক জনপদ আছে। ত্রিভুবনখ্যাত অযোধ্যা তাঁর নগরী। রাম এর জন্ম সেই অযোধ্যা নগরীতে হয়েছিল। [৪] রাম এর দুই পুত্রের একজনের নাম লব। তাঁর জন্যই একটি নতুন নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল; সে নগরীর নাম ছিল শ্রাবস্তী। রাম কোশল রাজ্যটি দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন। লব পেয়েছিলেন শ্রাবস্তী নগরী এবং জ্যেষ্ঠপুত্র কুশ পেয়েছিলেন কুশবতী নগরী। কুশবতী কোশল রাজ্যের অন্য একটি নগরী। মহাভারতের তথ্য অনুযায়ী শ্রাবস্তী নগরীর গোড়াপত্তন করেছিলেন কিংবদন্তিতুল্য সম্রাট শ্রাবস্ত।

নামকরণ[সম্পাদনা]

পালি ভাষায় শ্রাবস্তী হল সাবত্থি। বৌদ্ধ ঐতিহ্য বলে, সাবত্থি নগরীতে সাধু সাবত্থা বাস করতেন বলেই ঐ নাম।

শ্রাবস্তী নগরীর নামসংক্রান্ত আরও একটি কাহিনি আছে। যেখানে শ্রাবস্তী নগরী গড়ে উঠেছিল সেখানেই এককালে একটি অতিথিশালা ছিল। অতিথিশালায় নানা রাজ্যের বণিকেরা সমবেত হত। বণিকেরা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করত, কিম বানডাম আত্থি? (কী আছে সঙ্গে?) উত্তরে বলা হত, সাবাম আত্তি (আমাদের সব আছে)। এই সাবাম আত্তি শব্দ দুটো থেকেই হয়তো নগরীর নাম সাবত্থি বা শ্রাবস্তী হয়েছে।

অবকাঠামো[সম্পাদনা]

প্রাচীন শ্রাবস্তীর নগরীর দেয়াল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে তিনটি প্রাচীন স্থাপত্য দেখার জন্য আজও দেশবিদেশের পর্যটকেরা ভিড় করে—আঙ্গুলিমালা স্তুপ, অনাথপিণ্ডিক স্তুপ আর একজন জৈন তীর্থঙ্করের উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রাচীন জৈন চৈত্যগৃহ। আর রয়েছে জেতবন, গৌতম বুদ্ধের নিবাস গন্ধকুটির। জেতবনে রয়েছে আনন্দবোধি বৃক্ষ।

জেতবন ও গৌতম বুদ্ধ[সম্পাদনা]

গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে শ্রাবস্তী নগরীর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। সুদত্ত ছিলেন শ্রাবস্তী নগরীর একজন ধনী শ্রেষ্ঠী। সুদত্ত ব্যবসায়ের কাজে মগধের রাজধানী রাজগৃহ নগরীতে গিয়েছিলেন। ওই রাজগৃহে নগরীতেই সুদত্ত প্রথম বুদ্ধকে দেখেছিলেন। বুদ্ধের সঙ্গে কথা বলে সুদত্ত বুদ্ধের এক পরম ভক্তে পরিণত হয়। বুদ্ধকে একবার শ্রাবস্তী যাওয়ার অনুরোধ করেন সুদত্ত। বুদ্ধ রাজী হন।

কিছুকাল পরের কথা। বুদ্ধ শ্রাবস্তী আসছেন; সঙ্গে কয়েক হাজার শিষ্য। এত লোককে কোথায় থাকবার আয়োজন করা যায়। সুদত্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শ্রাবস্তী নগরীর বাইরে যুবরাজ জেত এর বিশাল একটি বাগান ছিল। সুদত্ত বাগানটি কিনতে চাইলে জেত প্রথমে রাজী হননি। পরে অবশ্য শর্তসাপেক্ষে রাজী হলেন—স্বর্ণমুদ্রায় সম্পূর্ণ বাগান ঢেকে দিতে হবে। সদুত্ত সম্মত হলেন। সুদত্ত গোশকট করে স্বর্ণমুদ্রা এনে বাগান ঢেকে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সুদত্তর পরম বুদ্ধভক্তি দেখে জেত অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি সুদত্তকে বাগানখানি দান করলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সুদত্ত জেত এর নামে বাগানে নাম রাখেন জেতবন

বুদ্ধ শ্রাবস্তী এলেন। ধ্যান করলেন, দান করলেন; শ্রাবস্তী নগরীকে অমর করে রাখলেন। রাজকুমার জেত অসম্ভব ধনাঢ্য ছিলেন; তিনি বুদ্ধকে আঠারো কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করেন।

সুদত্ত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুদত্ত অনাথদেরকে অন্ন (পিণ্ডক) দিতেন বলে তাঁকে অনাথপিণ্ডিক বলা হত। [৫] অনাথপিণ্ডিক নামটি বুদ্ধই দিয়েছিলেন।

গন্ধকুটির[সম্পাদনা]

গৌতম বুদ্ধের ব্যবহারের জন্য সুদত্ত গন্ধকাষ্ঠ দিয়ে একটি কুটির নির্মাণ করেন, যা বৌদ্ধ সাহিত্যে গন্ধকুটির নামে সুবিখ্যাত। [৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. An Advanced History of India
    R. C. Majumdar, H. C. Raychaudhuri, Kalikinkar Datta
  2. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস
    অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায়
  3. Buddhist India
    T. W. Rhys Davids
  4. গদ্যে বাল্মীকি রামায়ণ
    সম্পাদক: জ্যোতিভূষণ চাকী
  5. ভগবান বুদ্ধ
    ধর্মানন্দ কোসম্বী
  6. বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম এবং প্রাচীন বৌদ্ধ সমাজ
    শান্তিকুসুম দাশগুপ্ত