মাদকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অভিযুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মাদক যুদ্ধ বা মাদকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধ একটি চলমান অভিযান। মাদক ব্যবসায়ীদেরকে অভিজাত বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) -এর অপরাধ দমন ইউনিট এবং পুলিশ কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকেকে মানবাধিকার সংগঠন এবং বিদেশি কূটনীতিকরা সমালোচনা করেছেন।[১][২]
পটভূমি
[সম্পাদনা]বাংলাদেশে অজানা সংখ্যার প্রচুর মানুষ মাদক সেবন করে থাকে। ধারণা করা হয় এ সংখ্যা ১০০,০০০ থেকে ৪ মিলিয়ন পর্যন্ত হতে পারে।[৩] ২০১৫ সাল থেকে, বাংলাদেশ সরকার ইয়াবাদেহুত নামে পরিচিত একটি সস্তা মিথামফেটামিন ট্যাবলেট নির্মূল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, এবং পুলিশ সেই সময় থেকে প্রচুর পরিমাণে ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে।[৪] ২৯ মিলিয়নেরও বেশি "ইয়াবা" বড়ি কেবলমাত্র ২০১৬ সালেই জব্দ করা হয়েছিল, যা ২০১১ সালে ছিল মাত্র ১.৩ মিলিয়ন। বাংলাদেশ সরকারের ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে এসব জানা যায়।[৫] অভিযোগ রয়েছে যে, মাদকের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের সদস্য,[৬] সরকার সমর্থক যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য রয়েছে।[৭]
ঘটনা সমূহ
[সম্পাদনা]"ইয়াবার" ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ২০১৮ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি বড় "ইয়াবা" ক্র্যাকডাউন শুরু করে। অভিযানের প্রথম ১০ দিনে বাহাত্তর মাদক ব্যাবসার আসামী নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিল।[১] বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্রের মতে, অভিযানের প্রথম তিন সপ্তাহে দেশব্যাপী অভিযানে প্রায় ১৫,০০০ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।[৫] মাদকের ব্যবসায়ের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১১ সালের মাঝামাঝি থেকে জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত ২২,০০০ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।[৮] ঢাকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মতে, ২০১১ সালের মধ্য মে থেকে জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত ২১১ জন মাদক সন্দেহভাজনকে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে তৃতীয়াংশেরও বেশি প্রথমে গ্রেপ্তার হয়েছিল।[৪] বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড একটি সাধারণ স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করেছিল: অভিযুক্ত মাদক ব্যবসায়ীরা "বন্দুকযুদ্ধে" মারা যান, সাধারণত রাত্রে, নিহত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে অস্ত্র ও মাদক পাওয়া যেত।[৯]
হত্যার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হ'ল:
- কামরুল ইসলাম (৩৫), যাকে মাদকদ্রব্য ও অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করা ১৫ টি মামলার আসামি করা হয়েছিল। যদিও তাকে কখনই দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি, কিন্তু ২৫ মে ২০১৮ এ তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তার স্ত্রী দাবি করেছেন যে, ১০ বছর আগে তাদের প্রথম কন্যা সন্তানের জন্মের পরে ইসলাম মাদকের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।[৫]
- আকরামুল হককে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গুলি করে হত্যা করে। র্যাব দাবি করেছে যে হক মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। ২৭ মে ২০১৮ তারিখে জীবনের শেষ মুহূর্তে হকের স্ত্রীর সাথে কথা বলার ১৫ মিনিটের একটি ফোন কল রেকর্ডিং কক্সবাজারে ছড়িয়ে পরে, যদিও এটি যাচাই করা হয়নি।
- শ্বশুরবাড়ির বাড়ি থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় রিয়াজুল ইসলামকে বাংলাদেশ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। পরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং দু'জন কর্মকর্তা আহত হন বলে বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে। হাসপাতালের রেকর্ডে দেখা গেছে যে একটি গুলি তাঁর বাম কানের কাছাকাছি ইসলামের মাথায় প্রবেশ করে এবং তার ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। দু'জন পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যেককেই একটির হাতের সামান্য আঘাতের এবং ফোলাভাবের জন্য চিকিৎসা করা হয়েছিল।[৯]
বিতর্ক
[সম্পাদনা]ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রচ্ছদ খবরে অভিযোগ করা হয়েছে, অভিযানটি ওই বছরের শেষের দিকের সাধারণ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ভয় দেখানোর জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের একটি আয়োজন।[১০] উদ্ধৃত ঘটনায় বিরোধী দলের কর্মী হাবিবুর রহমান কথিত বন্দুক যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তার পরিবার জানিয়েছে যে তাকে একটি মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনি কখনও মাদক ব্যবহার করেন নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, মার্সিয়া বার্নিকাট এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সকলেই নিহত মানুষের সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।[৪][৫][১১]
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অস্বীকার করে বলেছেন যে, কোনও নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে না এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিচারবহির্ভূত হতাকাণ্ডের সকল অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন।[১১] অভিযুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের হত্যার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া অপারেশনের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন যে মাদকদ্রব্য ব্যবহার অন্য সকল অপরাধের দিকে প্ররোচিত করে এবং দাবি করেন যে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারে কোনও লাভ হয় না।[৪]
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান পুলিশ সন্দেহভাজনদের বিচারিক প্রক্রিয়া না করেই তাদের শাস্তি দিচ্ছে- এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি রয়টার্সকে বলেছেন- “আমাদের আইন প্রয়োগকারীরা কাউকে হত্যা করে না। যদি তারা তা করে থাকে তবে তা হবে আইনবিরোধী এবং তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে তারা আইনের বাইরে কাজ করছে না। এটি আইন-কানুন বিহীন কোনো দেশ নয়”।[৪]
একটি শক্তিশালী অভিযোগ রয়েছে যে, সরকারি দলের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিকে ৫ টি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে মাদকের শীর্ষ পৃষ্ঠপোষক বলা হলেও বদির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয় নি।[১২]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Safi, Michael; Rahman, Shaikh Azizur (২০১৮-০৫-২৫)। "Bangladesh's Philippines-style drugs war creating 'atmosphere of terror'"। The Guardian (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৪।
- ↑ "Over 100 killed in 'war on drugs' in Bangladesh"। The Times of India। ২০১৮-০৫-২৯। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৪।
- ↑ Kulsudjarit, Kongpetch (অক্টোবর ২০০৪)। "Drug Problem in Southeast and Southwest Asia" (ইংরেজি ভাষায়): 446–457। আইএসএসএন 0077-8923। ডিওআই:10.1196/annals.1316.055। পিএমআইডি 15542748।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "New frontline in Asia's crackdown on drugs"। Reuters। ২০১৮-০৮-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৪।
- ↑ ক খ গ ঘ Swati Gupta and Sugam Pokharel (২০১৮-০৬-০৮)। "Bangladesh defends war on drugs as body count mounts"। CNN। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৪।
- ↑ "Bangladesh launches 'Philippine-style' war on drugs"। Deutsche Welle (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৪।
- ↑ "Where does Bangladesh's war on drugs go from here?"। ঢাকা ট্রিবিউন (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-০৫-২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৪।
- ↑ "War on drugs to continue"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-০৬-২৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৪।
- ↑ ক খ Baldwin, Clare (২০১৮-০৮-১২)। "Arrested and killed: inside the Bangladesh prime minister's war on drugs"। Reuters (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৪।
- ↑ Farmer, Ben; Savage, Susannah (১ জুন ২০১৮)। "Bangladesh accused of using drugs war to hide political assassinations"। The Telegraph। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০১৮।
- ↑ ক খ Farmer, Ben; Savage, Susannah (২০১৮-০৬-০১)। "Bangladesh accused of using drugs war to hide political assassinations"। The Telegraph (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0307-1235। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৪।
- ↑ "AL govt unwilling to catch MP Badi despite official reports of drug trade link"। দৈনিক প্রথম আলো (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-০৯-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-৩০।