ব্যবহারকারী আলাপ:Syed Golam Nabi

পাতাটির বিষয়বস্তু অন্যান্য ভাষায় নেই।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাংলা উইকিপিডিয়ায় স্বাগতম[সম্পাদনা]

মরহুম আলহাজ মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ ।। খাঁটি দেশ প্রেমিকের উজ্জ্বল নক্ষত্র[সম্পাদনা]

।।সৈয়দ গোলাম নবী।।' দেশ প্রেমের মূল্যই বা কি? দেশের জন্য আত্মত্যাগ করে দলে দলে জীবন দিল অনেকেই, তাদের সবারই কি সমান মূল্যায়ন হয়? না, --- হয় না। বৃটিশের অনৈতিক শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে সংগঠন, অস্ত্রধরে বিপ্লবী হয়েছেন অনেকেই, জীবন উৎসর্গও করেছেন। স্বাধীন দেশে তাদের সামান্য স্বীকৃতিটুকুও মিলে না। অভাব, অনটন আর দুঃখ কষ্টের মধ্যে তারা বংশ পরস্পরায় দিনাতিপাত করে-করছে। অথচ বৃটিশের গোলামী খেটে, বৃটিশের শাসনকে বাহবা দিয়ে, তাদের অত্যাচারকে মাথা পেতে নিয়ে, শোষণ-বঞ্চনাকে স্বীকৃতি যারা দিয়েছে তারা পেয়েছেন অনেক কিছু। শত লক্ষ কোটি বিঘা জমিসহ জমিদারী, দু’চোখ যতদূর যায় ততদূর দাপট চালানোর মত জমির মালিকানা, বিভিন্ন নামের লম্বা লম্বা খেতাব। তৎকালীন আইন পরিষদের নির্বাচনে লড়াই করার মত আর্থিক সহায়তা। শোষক বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হবার চেষ্টা করলে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সৈনিকদের দমিয়ে দেয়া হত। হামলা, মামলা ও আটক করে নির্যাতন করতেও দ্বিধা করত না বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী। তাদের এসব অপকর্মের সমর্থন ও শতভাগ সহযোগিতা দিত শোষক বৃটিশের পা-ছাটা গোলামরা।


বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে যারা সমগ্র জীবন-যৌবনে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছেন তাদের মধ্যে মরহুম আলহাজ্ব মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান ছিলেন অন্যতম। তিনি পিতৃপুরুষের ধন সম্পদ যা কিছু ছিল তাও আবার বিলিয়েছেন দেশের শিক্ষা বিস্তার ও শিক্ষকদের আন্দোলনের পেছনে। মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ বৃটিশের নানা উপাধি গ্রহণতো দূরের কথা তাদের পোশাক পরিচ্ছেদও পছন্দ করতেন না। তাঁর মত প্রকৃত দেশ প্রেমিক নাগরিক, শিক্ষক, শিক্ষকনেতা ও সুসংগঠক বর্তমান সমাজে বিরল। ১৯৭০ সালের ১৭ই জানুয়ারী ৬৮ বৎসর বয়সে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন।

জন্ম ও পরিচয়ঃ আলহাজ্ব মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ এর জন্ম ১৯০২ সালের ১৪ ই এপ্রিল সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া গ্রামের ছৈয়দ বাড়ীতে। তাঁর পিতা ছিলেন তৎকালীন খেলাফত আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী মরহুম আলহাজ্ব মওলানা ছৈয়দ আলিম উল্লাহ শাহ্। মায়ের নাম লতিফা খাতুন। ছৈয়দ ছোলতান একদিকে বৃটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের কারাবরণকারী সৈনিক অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের সুযোগ সুবিধা ও দাবী আদায়ের লক্ষে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। নিপীড়িত নিগৃহীত ও নির্যাতিত হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি নিরলস পরিশ্রমী সফল সংগঠক ও সমাজ সেবী ছিলেন।


মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মহাকবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর নির্দেশে তিনি শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। মরহুম মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ ১৯২৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি গঠন করেন ও এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পর থেকে তাঁর চিন্তা শুরু হয় সমগ্র উপমহাদেশের শিক্ষকদের কল্যাণের লক্ষ্যে শিক্ষকদের সংগঠিত করার জন্য। ১৯৩২ সাল। কলিকাতায় চলছিল অলইন্ডিয়া কংগ্রেসের সম্মেলনে যোগদেন। সম্মেলনের এক ফাঁকে পূর্ব পরিকল্পনা মত শিক্ষকের নিয়ে সমাবেশ করেন এবং নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি গঠন করেন। সমাবেশ শেষে সর্ব সম্মতিক্রমে শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক সভাপতি, স্যার আজিজুল হক সহসভাপতি ও মরহুম মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবার তার স্বপ্ন জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের দিকে পা বাড়ায়। শিক্ষক সমিতির ব্যানারে সংগঠিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে উপমহাদেশের শিক্ষক সমাজের নিকট নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানের উপায় নির্ধারণ ও শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি আসাম,ত্রিপুরা,বিহার,বাঙলাদেশ অঞ্চলে ব্যাপক ভ্রমণ করেন এবং সংগঠনের শাখা উপশাখা গঠন করেন।

মরহুম ছৈয়দ ছোলতান ১৯২৬ সালে নিজ গ্রামে মাদার্শা সোনাকানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দীর্ঘদিন এ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদও অলংকৃত করেন। ১৯৬৪ ও ১৯৫১ সালে তিনি দেশব্যাপী শিক্ষক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও জেলা স্কুল বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সম্মেলন আহ্বান করেন। যার উদ্বোধক ছিলেন শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক। ৫২’সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে দেশব্যাপী শিক্ষক সমাজের মাঝে ব্যাপক প্রচারণা চালান ও ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন সভা ও সমাবেশে যোগদেন। একদিকে শিক্ষকদের নিয়ে আন্দোলন অন্যদিকে দেশ প্রেমিক রাজনীতিক হওয়ায় বৃটিশ সরকারের বদ নজরে ছিলেন। ১৯৪৪-৪৫ সালে মওলানা ইসলামাবাদী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এক গোপন সরকার গঠিত হয়। মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ ছিলেন এই গোপন সরকারের মন্ত্রীসভার একজন সদস্য। আবার, আজাদ হিন্দু ফৌজের বিপ্লবী কমিটিরও নেতৃত্ব দেন। এসব কারণে বৃটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে ১৯৪৪ সালে তাকে ১০ মাস কলিকাতা ও রংপুরে কারাবরণ করতে হয়।


পরবর্তীতে ও দীর্ঘকাল তাকে গৃহ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে শিক্ষকদের দাবী ও রাজনীতির কারণে। তিনি নিখিল বঙ্গ কংগ্রেস, জমিয়তে ওলামা ও কৃষক প্রজা পার্টির অন্যতম সংগঠক ছিলেন। চট্টগ্রাম কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা, সাতকানিয়া সরকারী কলেজ, দেওদীঘি হাইস্কুল, মির্জাখীল হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় অংশ নেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমবায় সমিতি, ফকির মাওলানা হাঙ্গর খাল সমবায় সেচ সমিতি, সোনাকানিয়া ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি ও বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) সমাজ কল্যাণ সমিতি(বিএসকেএস) গঠন করেন। দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি কল্যাণ সাধন ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। সারাজীবন খদ্দের কাপড় পরিধান করতেন তিনি। দেশীয় খদ্দর কাপড় ছাড়া কখনও বিদেশী কাপড় পরিধান করতেন না। ১৯৪৬ সালে সংসদ নির্বাচনে বৃহত্তম সাতকানিয়া আসন থেকে মনোনয়ন পত্র পেশ করেন কিন্তু কংগ্রেস এর কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেন এবং পটিয়া আসনের প্রার্থী মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পক্ষে নির্বাচনী কাজে অংশ নেন।

১৯৪৭ সালে তিনি পবিত্র হজ্ব আদায় করেন। মরহুম আলহাজ্ব মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ ৩ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। ১ম পুত্র মরহুম মুফতী ছৈয়দ মোস্তফা কামাল এশিয়া টাঙ্গাইলস্থ মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেক্টর, ২য় পুত্র মরহুম সাংবাদিক ছৈয়দ মোস্তফা জামাল ও ৩য় পুত্র ছৈয়দ মোস্তফা আইয়ুব একজন স্কুল শিক্ষক। কন্যা দিলু খাতুন একজন গৃহিনী।কনিষ্ঠ পুত্র ছাড়া আর কেউ বর্তমানে বেঁচে নেই। সাংবাদিক সৈয়দ গোলাম নবী মরহুম আলহাজ্ব মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ এর নাতি ও সাংবাদিক ছৈয়দ মোস্তফা জামাল একমাত্র পুত্র।


সাংবাদিকতাঃ শিক্ষকতা ও রাজনীতির পাশাপাশি তিনি কলিকাতা, রেঙ্গুন ও ঢাকার পত্রিকায় নিয়মিত সংবাদ পাঠাতেন। ১৯৭০ সালের ১৭ ই জানুয়ারী নিজ গ্রামের বাড়ীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। সোনাকানিয়া গ্রামের ছৈয়দ ছোলতান পাড়াস্থ মনজিলের দরগাহ নামকস্থানে কাতাল পীর (রঃ) মাজার সংলগ্নে তাকে সমাহিত করা হয়।

পূর্বপুরুষঃ ধর্মপ্রচার করার লক্ষ্যে বসতি স্থাপন পূর্বক মানুষকে ধর্মান্তর করার কর্মসূচী চলাকালে মূল কাতাল পীর (রঃ) এর বংশধর বা ভাগিনা ১ জন সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া গ্রামের মনজিলের দরগাহ নামক স্থানে শহীদ হন। ১৩০০ সালের ঘটনা। ফজরের নামাজের সময় যুবক যুবতীরা তাঁকে কতল করেন। এ ঘটনার ৩শ বৎসর পর ১৬শ সালের প্রথম দিকে দিল্লীর বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমলে আল্লামা আতি উল্লাহ বিন সৈয়দ মুসা নামের এক ব্যক্তিকে লাখেরাজ সম্পত্তি দিয়ে শহীদ কাতাল পীর (রহঃ) মাজার স্থলে ধর্ম প্রচার, মসজিদ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেরণ করা হয়। আল্লামা আতি উল্লাহ বিন ছৈয়দ মুসা সৌদিআরব, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন। তারই বংশধর মরহুম আলহাজ্ব মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ।

দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত নিবন্ধ ২০০১ সাল