ব্যবহারকারী আলাপ:সাইমুন হাসান সান

পাতাটির বিষয়বস্তু অন্যান্য ভাষায় নেই।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাংলা উইকিপিডিয়ায় স্বাগতম[সম্পাদনা]

মা-উপন্যাস[সম্পাদনা]

'মা'... আজাদের মা', "শহীদ আজাদের মা", কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের অনবদ্য একটি উপন্যাস " মা"। এ শুধু একটি উপন্যাসই নয়, এ এক মায়ের গল্প, এ এক সংগ্রামের গল্প, জীবনের গল্প, লড়াই করে বেঁচে থাকার গল্প, এ এক বিজয়িনীর গল্প, দেশ জয়ের গল্প, বাস্তবতারর ইতিহাস, স্বাধীনতার গল্প...। ভারতবর্ষ যখন স্বাধীনতার জন্য আজাদী আজাদী বলে আত্মহারা, আজাদের জন্ম তখন, আর তাই তার নাম রাখা হয় 'আজাদ'..। আজাদের বাবা ছিলেন ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় লোকদের একজন( ইউনূস চৌধুরী)। আজাদের বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করেন আজাদের মা আজাদকে নিয়ে এক কাপড়ে ইস্কাটনের রাজপ্রসাদ ছেড়ে আজাদকে নিয়ে চলে আসেন। শুরু হয় আজাদকে নিয়ে তাঁর নতুন যুদ্ধ, এই যুদ্ধ আত্মমর্যাদর। আজাদের মায়ের স্বপ্ন ছিলো তার ছেলেকে মানুষ করা, মানুষের মতন। আজাদ করাচি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে। সেখানে মিলি নামের একটি মেয়ের সাথে আজাদের পরিচয় হয় এবং তার ভিষন ভালো লাগে। আজাদ মাকে চিঠিতে মেয়েটির কথা লিখত। আজাদ এবং মেয়েটি ঘনিষ্ঠ হয়ে যায় কিন্তু যখন মিলির পরিবার জানে আজাদের বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কথা তখন মিলির পরিবার আজাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি এবং মিলিকেও যোগাযোগ করতে দেয়নি। এরই মধ্যে ইউনূস চৌধুরীও আজাদের মায়ের সাথে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন এবং তাকে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানায় কিন্তু তিনি তাঁর আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দেননি এবং যত দিন বেঁচে ছিলেন কখনো তার মুখ দেখেননি, দেখানওনি। চলতে থাকে আজাদের মায়ের টিকে থাকার লড়াই। আজাদ মাকে বলতো মা আমি যদি কখনো পৃথিবীতে বিখ্যাত হতে পারি তাহলে সারা পৃথিবীকে জানাবো তোমার কথা, তোমার সংগ্রামের কথা, তোমার জীবনের কথা। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে দেশে এসে করাচিতে আর যায়নি, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়। আজাদ মাকে চিঠিতে লিখতো পাকিস্তান আর আমাদের মধ্যেকার পার্থক্য, তারা এক জাতি আমরা আরেক জাতি, আমাদের ভাষা বাংলা ওদের ভাষা উর্দূ এবং নানা পার্থক্যের কথা। আমরা আর ওরা কখনো এক হতে পারি না। আজাদ আন্তর্জাতিক ও গনযোগাযোগ বিভাগ থেকে মাষ্টার্স পাশ করে। আজাদের মা আজাদকে বলতো 'বাবা তোমাকে আমি আমার জন্য মানুষ করতে চাই না আমি তোমাকে মানুষের জন্য দেশের জন্য মানুষ করতে চাই। আজাদের মায়ের জীবন সংগ্রামের সাথে দেশে আরেকটি সংগ্রাম শুরু হয়, এই সংগ্রাম মুক্তির, এই সংগ্রাম স্বাধীনতার। ১৯৭১ সাল ৭-ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক...। একাত্তরে ২৫শে মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙ্গালির স্বাধিকার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আজাদদের বাড়ি ছিলো মুক্তিযুদ্ধাদের আশ্রম স্বরূপ। আজাদের মা রান্নাবাড়া করে আজাদের বন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াতেন। তিনি রান্নাবাড়া খুব ভালোবাসতেন মানুষকে খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন, যেটা তিনি ইস্কাটনের বাসায়ও করতেন। আজাদের অনেক বন্ধু ভারতের মেলাঘর থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় আসে এবং ঢাকা গেরিলা অপারেশন শুরু করে। গেরিলাদের মধ্যে ছিলো শাফী ইমাম রুমি (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে)। রুমি যখন যুদ্ধে যেতে চেয়ে মায়ের কাছে অনুমিত চায় তখন তিনি মুশকিলে পড়ে যায়, আবার ছেলেকে নাও করতে পারে না। জাহানারা ইমাম ভাবেন এটুকু ছেলে মাত্রই তো এইচ.এস.সি. পাশ করে বুয়েটে ভর্তি হলো এবং কয়দিন পর আমেরিকায় পড়তে যাওয়া কথা সাত পাঁচ ভাবতে থাকে। রুমি যখন আবার জানতে চায় সে কি যুদ্ধে যাবে? রুমির মা তখন বলেন যা 'বাবা তোকে দেশের জন্য কুরবানি দিলাম'। এই কথা তাকে বহু বছর পুড়িয়েছে। তারা যখন মেলাঘরে ট্রেনিং করতে যায় তখন মেজরঃ খালেদ মোশারফ তাদেরকে বলেছিলো কোনো স্বাধীন দেশ তাদের জীবিত গেরিলা যোদ্ধাদের গ্রহণ করে না। তাদের মধ্যে ছিলো ক্রিকেটার জুয়েল, কাজী কামাল, আবুল বারাক আলভী, বদিউল আলম, সেকান্দার সহ আরো অনেকেই। আজাদের বন্ধুরা যখন আজাদকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে বলে আজাদ বলে মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে 'কারন পৃথিবীতে আমি ছাড়া মায়ের আর কেউ নাই, 'মা ছাড়া আমারও কেউ নাই।' আজাদ তার মায়ের কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইলে মা তাকে প্রথমে কিছু বলে না। আজাদের মা ছিলেন জুরাইনের পীর সাহেবের ভক্ত। পীর সাহেবকে আজাদের মা সব খুলে বলে বললেন ছেলে যুদ্ধে যেতে চায়, পীর সাহেব তখন বলেন ছেলে যুদ্ধে যেতে চায়, যুদ্ধে যেতে দাও। আজাদের মা ছেলেকে অনুমতি দেয়। অনুমতি দিয়ে বললেন 'ঠিক আছে, তুই যুদ্ধে যেতে পারিস। আমার দোয়া থাকলো। আজাদ মাকে বলে 'মা' তুমি কি অন্তর থেকে অনুমতি দিচ্ছো, নাকি রাগের মাথা?' মা বলে 'রাগ করবো কেনো? দেশ স্বাধীন করতে হবে না? আজাদ বন্ধুদের বিভিন্ন গেরিলা অফারেশনে অংশগ্রহন করে...। ৩০শে আগস্ট ১৯৭১, রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আজাদদের বাসা রেট দেয় এবং ধরে নিয়ে যায় আজাদ, বাশার, জুয়েল, সেকান্দারকে। গুলি বিদ্ধ হয় জায়েদ এবং টগর। কাজী কামাল পাকিস্তানি একজন সৈন্যর হাত থেকে স্টেনগান কেড়ে নিয়ে গুলি ককরে পালিয়ে যায়! ঐ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা রেট দেয় রুমিদের বাড়ি, আলতাফ মাহমুদের বাসা সহ ঢাকা শহরে অনেক জায়গায় এবং অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধাদের ধরে নিয়ে যায় আর চালাতে থাকে অমানুবিক বর্বর নির্যান। ৩১শে আগস্ট আজাদের মা রমনা থানায় আজাদের সাথে দেখা করতে যায়। যে আজাদকে তার মা জীবনে একটি ফুলের টোকাও দেয়নি আর সে ছেলেকে দেখলেন রক্তাক্ত। আজাদ মাকে বলে, 'মা' কী করবো? এরা তো খুব মারে। সব স্বীকার করতে বলে। সবার নাম বলতে বলে'। আজাদের মা আজাদকে বলে 'বাবা' তুমি কারো নাম বলোনি তো!' আজাদ বলে না মা বলি নাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরো মারে, যদি বলে ফেলি।' মা আজাদকে বলে 'বাবা রে' যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য কোরো। কারো নাম যেন বলে দিও না।' আজাদ মাকে বলে মা দুই দিন ভাত খাই না। ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। মা তাকে বলে আচ্ছা বাবা কাল যখন আসবো তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসবো। মা বাড়ি ফিরে যায় এবং পরের দিন খুব যত্ন করে গভীর মমতা ও ভালোবাসায় মা তার আজাদের জন্য ভাত রান্না করতে বসেন। আজাদের জন্য ভাত নিয়ে তিনি রমনা থানায় যায় কিন্তু আজাদকে আর দেখা যায় না, আজাদ আসেনি, আজাদ ফিরে আসেনি। মা তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন কিন্তু তার ছেলে আর ফিরে আসে না। আজাদের মা বাড়ি ফিরে যায়। আজাদ শহীদ হওয়ার পর ১৪ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তিনি আর কখনো ভাত খাননি, খাটের উপর ঘুমাননি...! দিন যায় রাত যায়। একদিন রাতে আজাদের পুরোনো চিঠি হাতরাতে থাকেন তার মধ্যে একটি বিশেষ চিঠি খুঁজে পায়। আজাদ চিঠিতে মা লিখেছিলো সে যদি বিখ্যাত হতে পারে তাহলে পৃথিবীকে জানাবে তার মায়ের কথা। সে সব চিঠি গুলোর মধ্যে একটি চিঠি....। মা, কেমন আছ? আমি ভালোভাবেই পৌঁছেছি। এবং এখন ভালোই আছি। হরতাল বন্ধ হয়ে গেছে। রীতিমতো ক্লাস হচ্ছে।পরীক্ষা শীঘ্রই শুরু হবে। দোয়া করো। তোমার দোয়া ছাড়া কোনো উপায় নাই। আমি নিজে কী ধরনের মানুষ আমি নিজেই বুঝতে পারি না। আচ্ছা মা তুমি বল তো সব দিক দিয়ে আমি কী ধরনের মানুষ। আমি তোমাকে আঘাত না দেওয়ার অনেক চেষ্টা করি। তুমি আমার মা দেখে বলছি না; তোমার মতো মা পাওয়া দুর্লভ। এই বিংশ শতাব্দীতে তোমার মতো মা যে আছে কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি এগুলি নিজ হৃদয় থেকে বলছি, তোমার কাছে ভালো সাজবার জন্য নয়। যদি পৃথিবীতে তোমার দোয়ায় বড় বা নামকরা হতে পারি, তবে পৃথিবীর সবাইকে জানাব তোমার জীবনী, তোমার কথা। আমি ভালো পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি। এবং অনেক দোয়া দিয়ে চিঠির উত্তর দিও। ইতি তোমার অবাধ্য ছেলে আজাদ। আজাদের মা ভাত খান না, খাটে ঘুমান না। কেউ তাকে ভাত খেতে বললে তিনি বলতেন আজাদ এলে খাবো! কেউ তাকে আজাদের শহীদ হওয়ার কথা ভললে তিনি তা উড়িয়ে দিতেন। তিনি আশায় থাকতেন আজাদ আসবে, ফিরে আসবে। তিনি বিশ্বাস করতেন তার আজাদ মরে নাই। সত্যিই তো আজাদরা কি মরতে পারে..? আজাদরা মরে না, রুমিরা মরে না, জুয়েলরা মরে না, মরতে পারে না। তাঁরা বেঁচে থাকে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা পূণ্য ভূমিতে। তারা বেঁচে থাকে লাল-সবুজ পতাকার লাল বৃত্তে। আজাদ বেঁচে থাকে প্রতিটি মায়ের আত্মত্যাগে। আজাদের মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পরে তাঁর কবরে যেন তাঁর স্বামীর নাম না লেখা থাকে যে নারী একদিন এক কাপড়ে তাঁর স্বামীর ঘর ছেড়ে এসেছেন তার কবরে কি করে স্বামীর নাম ফলক থাকে..? ৩০শে আগস্ট আজাদের মায়ের মৃত্যু হয়। যেদিন তার ছেলেকে তুলে নিয়ে যায় সেদিনে তাঁর মৃত্যু..! আজাদের মা বলেছিলেন যেন তাঁর মৃত্যুর পর তার কবরে লেখা থাকে "শহীদ আজাদের মা"..।