বিষয়বস্তুতে চলুন

ব্যবহারকারী:Drshipo/খেলাঘর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

আব্দুন নূর (মাস্টার)[সম্পাদনা]

আব্দুন নূর মাস্টার (১৯৫০-২০২০), যার পুরো নাম হাজী মোহাম্মদ আব্দুন নূর, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার একজন কৃতিসন্তান। তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় সংগঠক, সমাজসেবক, সালিশ বিচারক, শিক্ষানুরাগী, সুদক্ষ দলিল লেখক এবং একজন আদর্শ পিতা ছিলেন।

তিনি ১৯৫০ কমলগঞ্জ উপজেলার পতনঊষার ইউনিয়নের গোপীনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে আব্দুর নূর মাষ্টার সাহেবের জন্ম। পিতা মরহুম মোহাম্মদ আমিল মাস্টার মাতা মরহুম নেকজান বিবি। ৭ ভাই বোনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ট তিনি। মাত্র ৭ বছর বয়সে তাকে হতে হয় পিতৃহারা । কনিষ্ট চাচা ক্বারী ইউসুফ আলীর কাছে ধর্মী শিক্ষা গ্রহণের পর মরিচা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কুলাউড়া কে, সি উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি খেলাধূলা ছাড়াও সাংস্কৃতিক- সামাজিক কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন। এসএসসি উর্ত্তীণ হওয়ার পর পিতা ও পিতামহের আদর্শে শিক্ষকতাকেই তিনি পেশা হিসাবে বেঁচে নেন। ১৯৬৮ ইং সালে মৌলভীবাজার জেলা পিটিআই থেকে একজন আউট সাইডার হিসেবে ট্রেনিং গ্রহণ শেষে স্থানীয় শ্রীরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় শিকতার পেশায় নিযুক্ত হন।[১]

রাজনৈতিক জীবনঃ[সম্পাদনা]

রাজনগরের হাওর করাইয়ার ভূমি আন্দোলনের সময় আব্দুন নূর মাষ্টার ছিলেন টগবগে তরুণ। কাজী জাফর (সাবেক মন্ত্রী) হায়দার আকবর খান রনো, তাঁর ভাই জনো, কুলাউড়ার রাজা সাহেব, কৃষক নেতা মফিজ আলী, প্রয়াত সৈয়দ মতিউর রহমান, এ্যাডভোকেট আব্দুস ছোবহান, নলিনী দে, আব্দুর রশিদ, ললিত মোহন দাস, আবু কায়সার খান, তারা মিয়া, বীর কটুসহ আরো অনেকের নেতৃত্ব ছিলো এই আন্দোলনে। জমিদারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিলো বলে স্থানীয়ভাবে অনেক লোকই কৃষকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। [২]স্লোগান ছিলো-

          ''লাঙল যার জমি তার

          দা যার ছন তার

          হাওর করাইয়ার পথ ধরো, জমিদার খতম করো।

          হাওর করাইয়ার বীর কটু লাল সালাম।''


আব্দুন নূর মাষ্টার সাহেব স্বাধীনতার স্বপক্ষের একজন মানুষ হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় অনন্য একজন সংগঠক ছিলেন। যুদ্ধের সময় গোপীনগর গ্রাম ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট একটি নিরাপদ স্থান। সেখান থেকে তারা জেলার রাজনগর, কুলাউড়া ও কমলগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অপরেশন চালাতেন। যোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজটি নূর মাষ্টার সাহেব রাতের আঁধারে করতেন। এ খবর পেলো পাক বাহিনী। রাজাকারদের সাথে নিয়ে তাই তারা নূর মাষ্টারকে খোঁজাখুঁজি করতো। তিনি এসব প্রতিকূলতা কাটিয়ে চলতেন খুব বিচক্ষণতার মাধ্যমে। [৩]


মৌলভীবাজার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা যাওয়ার একটি নিরাপদ রুট ছিলো এই গোপীনগর গ্রাম। পাকিস্থানি সৈন্যদের চোখ ফাকি দিয়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে এই কাজটি করেছেন নূর মাস্টার ও তার দেশপ্রেমিক গ্রামের মানুষেরা। বিভিন্ন দিনে কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধা এই রুট দিয়ে নিরাপদে যাতায়াত করতো।

দিনে চাকরি ও রাতে মুক্তি বাহিনীকে সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। গোপনে সৈয়দ শামছুজ্জাম, ললিত মোহন দাস, প্রমোদ রঞ্জন দাস, উস্তার মিয়া মাস্টার, তৈয়ব উল্যা, ইয়াছিন মিয়া, এডভোকেট আব্দুস ছোবান, ইমান আলী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের প্রস্তুতি নেন তিনি।

ভারতে ট্রেনিং নিয়ে সৈয়দ মহসীন আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এলাকায় প্রবেশ করলে তিনি প্রথমে তাদের গোপিনগরের আরজু মিয়া সাবের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। পাক বাহিনী খবর পেয়ে আরজু মিয়া সাবের বাড়ি জ্বালিয়ে দিলে তিনি তাদের পালপুর গ্রামের আব্দুল আহাদ চৌধুরী সফিক মিয়া সাহেবের বাড়ীতে নিয়ে যান। সেখানে থেকে তার সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন এলাকায় একাধিক অপারেশন চালিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুন্সীবাজার পাঞ্জাবী ক্যাম্পে হানা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সৈয়দ মতিউর রহমান ভারত থেকে প্রায় ২০০ মুক্তি বাহিনী ও শিখ সৈন্য নিয়ে পালপুরে এসে তাদের সাথে যোগ দেন। অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে মুন্সীবাজার পাঞ্জাবী ক্যাম্পে চতুর্দিক থেকে সাড়াশি আক্রমণ চালানো হয়। টানা ২ দিন যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর কিছু সৈন্য শমশেরনগর দিকে পালিয়ে যায়। বাকীরা আত্মসমর্পণ করে, শত্রু মুক্ত হয় পাক এই এলাকা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলার সকল মুক্তিযোদ্ধারা জমায়েত ও সৌজন্য অনুষ্ঠানে এক মাইন বিস্ফোরণে আব্দুন নূর মাষ্টার গুরুতর আহত হন। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার ক্ষত চিহ্ন এখনও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাক-হানাদারদের দোসর কর্তৃক এলাকার লোকজনের বাড়িঘর থেকে লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধারেও তার প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল।[৪]

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বৈরাচারের অবসান ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন সহ জনগণের প্রতিটি ন্যায় সংগত লড়াইয়ে কমলগঞ্জের যেসব সোনার ছেলেরা সেদিন সমাজ বদলের স্বপ্নকে বুকে লালন করে আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তীতে আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যারা এ আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের মধ্যে আব্দুর নূর মাষ্টার অন্যতম। উনসত্তরের গন অভ্যুত্থান থেকে ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত সবক’টি আন্দোলনে তিনির নিজ এলাকার মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে আব্দুর নূর ছিলেন অন্যতম। তার উদ্যোগ উদ্যম ছিল সর্বজন বিদিত। আব্দুর নূর মাষ্টার মাষ্টার যখন কুলাউড়া কে, সি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তৎকালীন সময়ে এই এলাকা ছিল বাম রাজনীতির ও আন্দোলনের ঘাঁটি। আব্দুর নূর মাষ্টার ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)র ছাত্র সংগঠনের নেতা। তরুণ বয়সেই সমাজ রাজনীতির হাতেখড়ি নেওয়ায় বেগম মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ দেশবরেণ্য প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল তার।[৫]

কর্মজীবনঃ[সম্পাদনা]

আব্দুন নূর মাষ্টার একজন বহুপ্রতিভা সম্পন্ন মানুষ। তাঁর মেধার পরিধি অনেক বেশি। ব্যক্তি জীবনের সবক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ রয়েছে। জেলার চার থানায় ছিল  তাঁর সু-খ্যাতি। আব্দুন নূর মাষ্টার একজন শিক্ষক, শিক্ষানূরাগী, সমাজ সেবক, গ্রাম্য সালিশ বোর্ডের প্রথম সারির একজন বিচারক ,এমনকি একজন কৌসুলী দলিল লেখকও। তাঁর চতুর্মুখি যোগ্যতার কারণে ব্যক্তি জীবনে সকলের কাছে তিনি ছিলেন সমাদৃত। নূর মাষ্টার অতি অল্প বয়সেই সালিশ বিচারে প্রবেশ করেছিলেন। জেলায় যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সালিশ বিচারে তিনির  প্রয়োজনীয় একান্ত,  বিষয় নিষ্পত্তিতে তাঁর বিচক্ষণতা, যুক্তি ও কৌশল সালিশ বৈঠকের উপস্থিতিকে চমক লাগাত। অনেক সালিশ বৈঠকে তিনিই সিদ্ধান্ত দিতে হয়।

এমনকি সালিশের উপস্থিতিও তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকেন। আজকের এই সমাজ ব্যবস্থায় আব্দুন নূর মাস্টারের বড়ই প্রয়োজন ছিল। [৬]

সমাজসেবা ও শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকাঃ[সম্পাদনা]

আব্দুন নূর মাস্টার চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা পেশাইয় জড়িত ছিলেন। একজন তুখোর জ্ঞানী শিক্ষক হিসেবে তার সুখ্যাতি ছিলো। তার ছাত্র-ছাত্রীরা আজ দেশ বিদেশে বড় বড় অবস্থানে কাজ করছে। তিনি ছিলেন একজন দানশীল ব্যক্তিত্ব। স্থানীয় পতনউষার উচ্চবিদ্যালয় ও অনেক মসজিদ মাদ্রাসায় তাঁর দান বিদ্যমান ছিল। শিক্ষার প্রচার প্রসারে কাজ করেছেন আমৃত্য। নিজ এলাকায় প্রতিস্টিত হয়েছে তার নামে আব্দুন নুর নুরজাহান চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়। [৭] এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ, মাদ্রাসা তৈরীতে তিনি অগ্রনী ভুমিকা রেখেছেন।

আব্দুন নূর মাস্টার একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ গড়তে কাজ করে গেছেন। এলাকায় তিনি নির্মান করেছেন শহীদ মিনার। নিজে মার্চ করে স্কুলের ছোট বাচ্চাদের নিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। দেশপ্রেম তার রক্তের সাথে মিশে ছিলো। তিনি মনে করতেন, শিক্ষাই প্রান্তীক জনগোষ্টির অর্থনৈতিক এবং মানসিক মুক্তির একমাত্র পথ। সে লক্ষ্যেই তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন।


আব্দুন নূর মাস্টার ২০২০ সালে অগাস্ট মাসের ২৫ তারিখ রাতে তার নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরন করেন।[৮]

[সম্পাদনা]

  1. "BDLive24"www.bdlive24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  2. "প্রয়াত আব্দুন নূর মাষ্টার, যার জ্ঞানের পরিধি ছিল বিশাল" |ইউআরএল= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)http (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  3. "প্রয়াত আব্দুন নূর মাষ্টার, যার জ্ঞানের পরিধি ছিল বিশাল" |ইউআরএল= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)http (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  4. "দিনে চাকরি ও রাতে মুক্তি বাহিনীকে সংগঠিত করতেন আব্দুন নূর মাষ্টার"Bangladesh Journal Online। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  5. "দিনে চাকরি ও রাতে মুক্তি বাহিনীকে সংগঠিত করতেন আব্দুন নূর মাষ্টার"Bangladesh Journal Online। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  6. "প্রয়াত আব্দুন নূর মাষ্টার, যার জ্ঞানের পরিধি ছিল বিশাল" |ইউআরএল= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)http (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  7. "প্রয়াত আব্দুন নূর মাষ্টার, যার জ্ঞানের পরিধি ছিল বিশাল" |ইউআরএল= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)http (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  8. sylhetview24.com। "পতনউষারের আব্দুন নূর মাস্টার আর নেই"www.sylhetview24.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬