ব্যবহারকারী:নীলপদ্ম/‘সংশপ্তক’

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

‘সংশপ্তক’(১৯৬৫)- শহীদুল্লা কায়সার[সম্পাদনা]


বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম, বাংলাদেশের এক মহান মানব-প্রেমিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মী শহীদুল্লা কায়সার। পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা। নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত ফেনী মহকুমার মজুপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৭ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন নেপথ্য নায়ক এবং শ্রমিক-জনতার নিপুন চিত্রকর। বাঙালী জীবনের দুঃখ ও সংগ্রামের চিত্র তার উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। তাই তিনি তার লেখনীতে এই মেহনতি মানুষগুলোর পক্ষে কলম ধরেছিলেন কারান্তরীণ থাকাকালেই এবং লিখে গেছেন ১৯৭১ সালের বিজয়ের সূর্য উদিত হওয়ার কিছু সময় আগে আলবদর বাহিনীর হতে নিখোঁজ হওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত।

বাংলা সাহিত্যে ‘সংশপ্তক’ শহীদুল্লা কায়সারের এক অমর কীর্তিগাথা। এর আভিধানিক অর্থ করলে দাড়ায়-‘নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যে বীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়ে যায়’। রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত এদেশের হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত জীবন নিয়ে এবং অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে অনুপ্রাণিত সার্থক সৃষ্টি ‘সংশপ্তক’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নির্মাণে শহীদ সাহিত্যিক যে নৈপুন্য প্রদর্শন করেছেন তা আমাদের দেশে একান্তই দুর্লভ। গ্রন্থখানিতে আছে মহাকাব্যিক ব্যপ্তি, আছে প্রসারতা। ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের দীর্ঘ আয়তনে ধরা পড়েছে বহু চরিত্র- সকলের উপর জেগে আছে পুরুষ-শাসিত মুসলিম সমাজে নারীর বিদ্রোহ। উপন্যাসের সূচনা হয়েছে হুরমতির লাঞ্ছনায়। ব্যাভিচারিণী হুরমতির কপালে আগুনে তাঁতানো পয়সাটা দিয়ে ছেঁকা দেবার যে বর্বর নিষ্ঠুর দৃশ্যটিতে উপন্যাসের সূচনা, সেখানেই নারীর বিদ্রোহের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

উপন্যাসের নায়ক জাহেদ একজন বিপ্লবী। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষাপ্রাপ্ত টগবগে যুবক। মানুষ মাত্রই তার ভালবাসার পাত্র। মূলত জহেদ চরিত্রটি লেখকেরই প্রতিচ্ছায়া। স্কুল মাস্টার সেকান্দর, পতিতা হুরমতি, চাষী লেকু- সবাই তার স্নেহ ও ভালবাসা পায়। জাহেদ মানষের প্রতি আশাবাদী, আশাবাদী তার জীবনের প্রতি। চরম বিপদের সময়েও তার বিপ্লবী সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। তাই তাকে গ্রেপ্তার করার সময় বলতে শোনা যায়- ‘‘চিন্তা করিস নে রা’বু আমি ফিরে আসব। আমি আসব”।এই উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে রাবু। সে বিবাহিতা, অতীতকে অস্বীকার করে বিপ্লবী জাহেদের সঙ্গে সমাজ সেবায় ব্রতী হয়। জাহেদকে সে ভালবাসে। রাজনৈতিক মুক্তি পথের পথিক রাবু। সেকান্দর মাস্টারও দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের একজন নিবেদিত কর্মী।

সমগ্র উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে দুটি গ্রাম- বাকুলিয়া ও তালতলি। এখান থেকে ঘটনা কলকাতা, ঢাকা পরিক্রম করেছে। জাহেদ, রাবু, ফেলু, মালু, রমজান, সেকান্দর মাস্টার, হুরমতি, লেকু- এদের চরিত্র-চিত্রণে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে। এই চরিত্রগুলোর গল্পের শেষ নেই। তালতলির গল্প, বাকুলিয়ার গল্প, যুদ্ধের গল্প, দুর্ভিক্ষের গল্প, দাঙ্গার গল্প, ইংরেজ চলে যাবার গল্প, রমজানের মতো যারা এই দেশটাকে ভোজভাজি দেখাল তাদের গল্প, ভিটেহারাদের গল্প, সব মিলিয়ে ওদের নিজেদের গল্প। ওদের এক একটি জীবন অসংখ্য কাহিনী।

আসলে ‘সংশপ্তক’ বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু গ্রামীণ জীবনের সামন্ত প্রভূদের অত্যাচার আর তার মধ্য থেকে সাধারণ মানুষের বাঁচার লড়াইয়ের এক মনোজ্ঞ পাঁচালি। [১]

  1. তথ্যসূত্রঃ শহীদুল্লা কায়সার রচনাসমগ্র(১ম খন্ড)