বিষয়বস্তুতে চলুন

প্রাচীন সাহিত্যে রাঢ়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

প্রাচীন সাহিত্যে রাঢ় বলতে সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যে ভারতের রাঢ় অঞ্চলের একাধিক মনোজ্ঞ বিবরণকে বোঝানো হয়। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত রাঢ় অঞ্চলের ঐতিহাসিক খ্যাতি সুপ্রসিদ্ধ। মহাভারত থেকে বৌদ্ধ, জৈন ও পরবর্তীকালে রচিত হিন্দু ধর্মীয় ও সাহিত্যগ্রন্থগুলিতে বিভিন্ন নামে এই অঞ্চল উল্লিখিত হয়ে এসেছে। এছাড়া মধ্যযুগে রচিত চৈতন্যদেবের বাংলা জীবনীগ্রন্থ কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থেও রাঢ়ের একটি প্রাঞ্জল ভৌগোলিক বিবরণ পাওয়া যায়।

মহাভারতে রাঢ়

[সম্পাদনা]

মহাভারতে রাঢ় অঞ্চলকে বলা হয়েছে সুহ্ম। ভীম অশ্বমেঘ যজ্ঞকালে সুহ্মের রাজাকে পরাস্ত করে মগধের দিকে ধাবিত হন ও পরে বঙ্গরাজ্য জয় করেন। সুহ্মের সঙ্গে সঙ্গে তাম্রলিপ্ত, কর্বট ও সাগর – এই তিন পূর্বাঞ্চলীয় রাজাও ভীমের হাতে পরাস্ত হয়েছিলেন বলে উল্লেখ। মহাভারতের প্রসিদ্ধ টীকাকার নীলকণ্ঠের বর্ণনা থেকে মনে হয় সুহ্ম বলতে আজকের রাঢ় অঞ্চলকেই বোঝায়।

জৈনশাস্ত্রে রাঢ়

[সম্পাদনা]

জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারাঙ্গসূত্র-এ রাঢ় অঞ্চলের উল্লেখ আছে। ‘আচারাঙ্গসূত্র’-এ রাঢ়কে ‘লাড়’ নামে অভিহিত করে একে এক জনপদহীন অরণ্যসংকুল ভূখণ্ড বলা হয়েছে। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের বলা হয়েছে বর্বর। জৈনগ্রন্থ মতে, রাঢ়ের দুটি বিভাগ হল বজ্জভূমি ও সুহ্মভূমি। সচরাচর উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়কেই এই দুই নামে ডাকা হত বলে অনুমান।

জৈন বিবরণী অনুসারে মহাবীর এই অঞ্চলে তার ধর্মপ্রচার করতে এলে স্থানীয় বাসিন্দারা তার পিছনে কুকুর লেলিয়ে দেয়। বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবংশ-এও এই কাহিনির সমর্থন দেখা যায়।

বৌদ্ধগ্রন্থে রাঢ়

[সম্পাদনা]

সিংহলী বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দীপবংশ’-এ উল্লিখিত কিংবদন্তি অনুসারে, রাঢ়ের অরণ্যরাজ সিংহরাজা বঙ্গের রাজকন্যাকে অপহরণপূর্বক বিবাহ করেন। তাদের মিলনে জাত সন্তান রাঢ়ের অরণ্য ধ্বংস করে লোকবসতি স্থাপন করেছিলেন। ‘সংযুক্তনিকায়’ ও ‘তেলপত্ত জাতক’-এ সুহ্মের অন্তর্গত শেতক বা দেশক অঞ্চলে গৌতম বুদ্ধের ভ্রমণের কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতেও রাঢ়কে এক অরণ্যসংকুল জাতির বাসভূমি বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।

সংস্কৃত সাহিত্যে রাঢ়

[সম্পাদনা]

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যেও রাঢ়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।মহাভারতে সুহ্ম ও তাম্রলিপ্তকে পৃথক করে দেখা হলেও গুপ্ত শাসনে রচিত দণ্ডীর ‘দশকুমারচরিত’-এ বলা হয়েছে ‘সুহ্মেষু দামলিপ্তাহ্বয়স্য নগরস্য’। অর্থাৎ দামলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত) সুহ্মেরই একটি নগর ছিল। ধোয়ীর পবনদূত কাব্যে রাঢ় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে –

গঙ্গাবীচিপ্লুত পরিসরঃ সৌধমালাবতংসো
বাস্যতুচ্চৈ স্তুয়ি রসময়ো বিস্ময়ং সুহ্ম দেশঃ।
 

অর্থাৎ, ‘যে-দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গঙ্গাপ্রবাহের দ্বারা প্লাবিত হয়, যে দেশ সৌধশ্রেণীর দ্বারা অলংকৃত, সেই রহস্যময় সুহ্মদেশ তোমার মনে বিশেষ বিস্ময় এনে দেবে।’ পরবর্তীকালে রচিত ‘দিগ্বিজয়-প্রকাশ’-এ বলা হয়েছে –

গৌড়স্য পশ্চিমে ভাবে বীরদেশস্য পূর্বতঃ।
দামোদরোত্তরে ভাগে সুহ্মদেশঃ প্রকীর্তিতঃ।

অর্থাৎ, গৌড়ের পশ্চিমে, বীরদেশের ([[বীরভূম জেলা|বীরভূম) পূর্বে, দামোদরের উত্তরে অবস্থিত প্রদেশই সুহ্ম নামে খ্যাত। এই সকল বর্ণনার প্রেক্ষিতে বর্তমান হুগলি জেলাকেই প্রাচীন রাঢ়ের কেন্দ্রস্থল বলে অনুমান করা হয় এবং এর সীমানা বীরভূম থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে অনুমান।

চৈতন্যচরিতামৃতে রাঢ়

[সম্পাদনা]

চৈতন্যচরিতামৃতের বর্ণনা অনুসারে রাঢ়ের জঙ্গলাকীর্ণ পথে চৈতন্যদেব কাশীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কবির বর্ণনায় রাঢ়ের অরণ্যভূমির একটি কাল্পনিক বর্ণনা পাওয়া যায়, যা বাংলা সাহিত্যে একটি অন্যতম উজ্জ্বল কবিকল্পনা –

প্রসিদ্ধ পথ ছাড়ি প্রভু উপপথে চলিলা।
কটক ডাহিনে করি বনে প্রবেশিলা।।
নির্জন বনে চলেন প্রভু কৃষ্ণ নাম লইয়া।
হস্তী ব্যাঘ্র পথ ছাড়ে প্রভুকে দেখিয়া।
পালে পালে ব্যাঘ্র হস্তী গণ্ডার শূকরগণ।
তার মধ্যে আবেশে প্রভু করেন গমন।।
ময়ূরাদি পক্ষীগণ প্রভুকে দেখিয়া।
সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ বলে নাচে মত্ত হইয়া।।
হরিবোল বলি প্রভু করে উচ্চধ্বনি।
বৃক্ষলতা প্রফুলিত সেই ধ্বনি শুনি।।
ঝারিখণ্ডে স্থাবর জঙ্গম আছে যত।
কৃষ্ণনাম দিয়া কইলো প্রেমেতে উন্মত্ত।।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]