প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নৌযুদ্ধ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নৌযুদ্ধ মূলত: মিত্রশক্তির তুলনামূলকভাবে বিশালাকার নৌবহর ও চতুর্দিকে ঘেরাও করা অবস্থান দ্বারা কেন্দ্রীয় শক্তিকে সমুদ্র অঞ্চলে বাঁধা দেয়ার প্রচেষ্টা এবং কেন্দ্রীয় শক্তির এই অবরোধ অতিক্রম অথবা সাবমেরিন ও রেইডার দিয়ে যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের ওপর কার্যকরী অবরোধ আরোপ করার প্রচেষ্টা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল
পটভূমি: বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে বিধ্বংসী যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে ব্রিটেন এবং জার্মানির মধ্যকার নৌশক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা নিয়ে বেশ কয়েকটি বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে জার্মানির বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী নৌশক্তি ও সমুদ্রবাহিত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল দ্বীপরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের সমপর্যায়ের নৌবহর নির্মাণের প্রচেষ্টাকে প্রায়ই এ দুই দেশের মধ্যে শত্রুতার একটি প্রধান কারণ বলে অভিহিত করা হয়, যা যুক্তরাজ্যকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের দিকে পরিচালিত করেছিল জার্মানির নেতৃবর্গ এমন একটি নৌশক্তি গঠন করতে চেয়েছিল যা তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যকে বৃটেনের কৃপার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম, কিন্তু এমন একটি নৌবহর অবধারিতভাবেই ব্রিটেনের নিজ বাণিজ্য ও সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতো
প্রথম মরক্কো সংকটের (মরক্কোর ঔপনিবেশিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে, মার্চ ১৯০৫ ও মে ১৯০৬ এর মধ্যবর্তী সময়ে) পর থেকেই তাদের নিজ নিজ নৌশক্তি বৃদ্ধি করার প্রতিযোগিতা চলছিল যাহোক, ঘটনাপ্রবাহ এদিকে পরিচালিত হয়: ক্যাপ্টেন আলফ্রেড থায়ের মাহান ছিলেন একজন মার্কিন নৌ কর্মকর্তা যিনি ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ইতিহাসে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন ১৮৮৭ সালে তিনি The Influence of Sea Power upon History নামে একটি বই প্রকাশ করেন এই বইয়ের মূল বিষয় ছিল আধুনিক বিশ্বের বুনিয়াদ হিসেবে নৌ আধিপত্য তিনি দাবি করেন যে রোম থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য পর্যন্ত যে জাতিই সমুদ্রের আধিপত্য পেয়েছে সে জাতিই উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়েছে পক্ষান্তরে যে জাতি নৌ আধিপত্যে পিছিয়ে পড়েছে, যেমন হানিবালের কার্থেজ বা নেপোলিয়নের ফ্রান্স, তা সমৃদ্ধশালী হতে পারেনি তিনি ধারণা করেন যে ব্রিটেন বিশ্বের সমুদ্রাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে নৌবাহিনী গঠনের জন্য যা করেছে তা অন্যরাও করতে পারে- এমনকি করা অপরিহার্য, যদি তারা সম্পদ ও সাম্রাজ্যের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চায়
নৌ-শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা: মাহানের গবেষণা অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল এবং তা বিশ্বজুড়ে নব উদ্যমে নৌ শক্তি অর্জনের এক বিস্ফোরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস অনতিবিলম্বে তিনটি যুদ্ধজাহাজ (দুই বছর পর একটি চতুর্থ USS Iowa সহ) নির্মাণের নির্দেশ দেয় জাপান, যার ব্রিটিশ প্রশিক্ষিত নৌবাহিনী সুশিমার যুদ্ধে রাশিয়ান নৌবহরকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে, লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নৌশক্তিকে একটি প্রভাবশালী বিষয়রূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে যাহোক, এ বইয়ের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে জার্মানিতে জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় উইলহেম যখন তার দাদী রাণী ভিক্টোরিয়াকে দেখতে যান তখন তাকে রাজকীয় নৌবাহিনীতে নিয়ে আসা হয় তার মা বলেন, “উইলহেমের একটি পরিকল্পনা হলো এমন একটি নৌবাহিনী গঠন করা যা ব্রিটিশ নৌবাহিনীর চেয়েও বড় ও শক্তিশালী হবে” ১৮৯৮ সালে প্রথম ও এর দুই বছর পর দ্বিতীয় জার্মান নৌ আইন জারি হয়, যা দেশটির নির্মাণিতব্য জাহাজের সংখ্যা দ্বিগুণ করে তোলে তথা পরবর্তী ২০ বছরে ১৯ টি ব্যাটলশিপ ও ২৩টি ক্রুজার নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় পরবর্তী এক দশকে জার্মানি অস্ট্রিয়ার চেয়েও নিচে থাকা নৌ র্যাংকিং থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রণতরী বহরের অধিকারী দেশে পরিণত হয় ট্রাফালজারের যুদ্ধের পর এই প্রথম ব্রিটেন একটি আগ্রাসী ও বাস্তবিকই বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়