পালকি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় পালকিবাহক ভাস্কর্য
গামা হিসেবে পরিচিত কোরিয়ার তৈরি পালকি (আনুমানিক ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ)

পালকি এক ধরনের বিলাসবহুল যানবাহন যাতে সাধারণত ধনিকগোষ্ঠী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে থাকে। চাকাবিহীন যানবাহন হওয়ায় কয়েকজন ব্যক্তি ঘাড়ে বহন করে পালকিকে ঝুলন্ত অবস্থায় স্থানান্তরে অগ্রসর হয়। যিনি পালকির ভার বহন করেন, তিনি পালকি বেহারা নামে অভিহিত হন। প্রথমদিকে দেব-দেবীকে আরোহণ কিংবা দেবমূর্তি বহনের উদ্দেশ্যে এরূপ যানবাহন তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অনেক মন্দিরেই পালকি সহযোগে দেবতাদের বহনের দৃশ্যমালা ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরার দৃশ্য চিত্রিত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এতে করে মুখ্যত ইউরোপীয় উচ্চ শ্রেণির সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও ভদ্রমহিলাগণ ভারতীয় উপমহাদেশে রেলগাড়ি প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত চলাফেরা করতেন।[১] আধুনিককালে পালকির ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবুও সীমিত আকারে ভারতীয় উপমহাদেশে বিবাহ অনুষ্ঠান, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে ব্যবহার করতে দেখা যায়।[২]

নাম পরিচিতি[সম্পাদনা]

প্রাচীন রোমে লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো, তুরস্কে টাহটিরেভান ইত্যাদি নামে পালকি পরিচিত হয়ে আসছে।

নির্মাণশৈলী[সম্পাদনা]

ইউরোপে পালকিকে শোবার উপযোগী করে উন্মুক্ত কিংবা বন্ধ অবস্থায় নির্মাণ করা হতো। দুইটি শক্ত খুঁটি সহযোগে প্রান্ত সীমায় পালকি বেহারা কিংবা ভারবাহী জন্তুর মাধ্যমে টেনে নেয়া হতো। ধারণা করা হয় যে, স্লেজচালিত গাড়ীর ধারণা থেকে পালকি পরিবহনটির ব্যুৎপত্তি ঘটেছে। মিশরীয় চিত্রকর্মে এর প্রকাশ ঘটেছে। পরবর্তীতে তা পারস্য রাজ্যেও ব্যবহৃত হয়। এ সংক্রান্ত বিষয়াদি ঈশা সম্বন্ধীয় পুস্তকাদিতে তুলে ধরা হয়েছে। প্রাচ্য দেশসমূহে এ বাহনটি পালকিরূপে পরিচিতি পায়। মূলতঃ প্রাচীন রোমের সম্রাজ্ঞী এবং সিনেটরদের স্ত্রীদের ন্যায় সম্ভ্রান্ত বংশীয় এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যে বরাদ্দ ছিল পালকি। কিন্তু সাধারণ লোকদের জন্যে এ পরিবহন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। সপ্তদশ শতকে ইউরোপে পালকি পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল; মজবুত নির্মাণশৈলী এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায়সহ উভয় খুঁটিতে চামড়ার বর্ম আচ্ছাদন করা হয়। পরবর্তীকালে গুরুতর অসুস্থ রোগী ও আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকেও পালকি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।

ব্যবহার[সম্পাদনা]

১৭৭৫ সালে রবার্ট অ্যাডাম অঙ্কিত সিড্যান চেয়ারে ভ্রমণরত রাণী চার্লোত

লন্ডনে পালকিকে সিড্যান চেয়ার নামে আখ্যায়িত করা হয়। এজাতীয় পালকিতে একজন ব্যক্তির জন্যে একটি চেয়ার অথবা জানালা সহযোগে ক্যাবিন রাখার উপযোগী করে তৈরী করা হয়। এর সামনে ও পিছনে কমপক্ষে দুইজন লোক ভার বহন করে নিয়ে যেতো। ভারবহনকারী চেয়ারম্যানরূপে পরিচিতি পেতেন। ঊনবিংশ শতকে এসে তা খুবই কম দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু মর্যাদাসম্পন্ন পরিবহনরূপে কয়েক শতক এর ব্যবহার ছিল যাতে অবরুদ্ধ নারীগণ যাত্রী হতেন। রাতের বেলায় মশাল সহকারে লিঙ্ক-বয় পালকির সামনে থেকে পথ নির্দেশ করতো।[৩] ১৯৭০-এর দশকে উদ্যোক্তা এবং বাথউইকের অধিবাসী জন কানিংহ্যাম সংক্ষিপ্তকালের জন্য সিড্যান চেয়ারের পুণঃপ্রচলন ঘটিয়েছিলেন।

চীনে সনাতনী ধারায় সিড্যান চেয়ারের উপযোগিতা রয়েছে। সাধারণতঃ তা ভাড়া করে বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। লাল সিল্ক দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় কনেকে নিয়ে আসা হয়।[৪] একসময় হংকংয়ে সিড্যান চেয়ার জনসমক্ষে ব্যবহৃত হতো। জনসাধারণের জন্যে ব্যবহৃত চেয়ারের জন্য নিবন্ধন করতে হতো। পাশাপাশি করও প্রদান করতে হতো। ব্যক্তিগত চেয়ার বা পালকি ব্যবহারকারীকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। সরকারী কর্মকর্তারা এ পালকিতে কত জন বেহারার দরকার হতে পারে তা নির্ধারণ করতেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় পালকি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ পালঙ্ক থেকে যার অর্থ বিছানা বা খাঁট। আনুমানিক খ্রীষ্ট-পূর্ব ২৫০ সালে রামায়ণে পালকির কথা তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে চাকাঁচালিত রিকশার প্রচলন ঘটে। এরফলে পালকি তার গুরুত্ব হারাতে শুরু করে।

ইন্দোনেশিয়ার জাভা সম্প্রদায়ে পালকির প্রচলন রয়েছে। দুই খুঁটিতে গড়া জোলি বেহারারা কাঁধে করে পারাপার করতেন এবং যে-কোন যাত্রী অর্থের বিনিময়ে ভ্রমণ করতে পারতেন।[৫]

পালকিওয়ালার গান[সম্পাদনা]

পুরনো পালকিওয়ালারা গান বাঁধতেন, ‘কর্তাবাবুর রঙটি কালো/গিন্নি মায়ের মনটি ভাল/সামলে চলো হেঁইও।’ আবার কর্তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার সময় বাইকেরা গাইতেন, ‘হেঁইও জোয়ান, সরু আল, চলো ধরে। কর্তাবাবুর, দরাজ দিল, দেবে ধরে।’

চিত্রশালা[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Palanquin. Encyclopaedia Britannica, 11th Ed., 1911। সংগৃহীত হয়েছে: 2009-06-18."। ২০১৩-০১-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০১-২৭ 
  2. R.V. Russell. The Tribes and Castes of the Central Provinces of India, Volume II. প্রকাশক: BiblioBazaar, LLC. পৃষ্ঠা- 652. আইএসবিএন 9780559127625। সংগৃহীত হয়েছে: 2009-06-01.
  3. Bath Chronicle (December 2, 2002) Sedan Chairs Ride Again. Page 21.
  4. A Hong Kong Sedan Chair, Illustrations of China and Its People, John Thomson 1837-1921, (London,1873-1874)
  5. Tomlin, Jacob Missionary Journals and Letters: Written During Eleven Years' Residence and Travels Amongst the Chinese, Siamese, Javanese, Khassias, and Other Eastern Nations Nisbet: 1844: 384 pages, pp 251:

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:মানব চালিত যানবাহন