ধারক

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ধারক
চিত্র: ধারকের প্রতীক

ধারক (ইংরেজি: Capacitor) একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র, যা বর্তনীতে বৈদ্যুতিক শক্তি ও বৈদ্যুতিক আধানের হিসেবে কাজ করে। ক্ষেত্রবিশেষে এটা উচ্চ ও নিম্ন তরঙ্গের জন্য ছাঁকনি (filter) হিসেবেও কাজ করে। পূর্বে একে শীতক (ইংরেজি: Condenser) বলে অভিহিত করা হত। কারণ প্রথমে বিজ্ঞানীগণ ভেবেছিলেন, ধারকে তড়িৎ একেবারে জমাট বেঁধে যায়। কিন্তু পরে জানা যায় যে এখানে তড়িৎ জমে যায় না; শুধু আধান ও শক্তি সঞ্চিত হয় এবং প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবহার করা যায়।[১]

ধারকের সঞ্চিতশক্তির রাশিমালা

u= 1/2 ×€0 E²

গঠন[সম্পাদনা]

দুইটি পরিবাহী পাতের মাঝে একটি পরাবৈদ্যুতিক অপরিবাহী পদার্থ নিয়ে এটি গঠিত। ডাই-ইলেকট্রিক এমন একটি পদার্থ যা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের প্রভাবে পোলারায়িত হতে পারে। এ পদার্থ হতে পারে কাঁচ, সিরামিক, প্লাস্টিক বা শুধুই বাতাস।

ধারকত্ব[সম্পাদনা]

ধারকত্ব হল কোন নির্দিষ্ট বিভব পার্থক্যে সঞ্চিত তড়িৎ আধানের পরিমাপ। তড়িৎ আধান সঞ্চয়ের জন্য দুই পাত বিশিষ্ট ধারক সর্বাধিক প্রচলিত। যদি ধারকের পাতদ্বয়ে আধানের পরিমাণ যথাক্রমে +Q ও -Q এবং পাতদ্বয়ের বিভব পার্থক্য V হয়, তবে ধারকত্ব

ধারকত্বের এসআই একক হল ফ্যারাড। ১ ফ্যারাড = ১ কুলম্ব প্রতি ভোল্ট।

শক্তি[সম্পাদনা]

সমান্তরাল পাত ধারকে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধানের পৃথকীকরণ। মাঝের ডাই-ইলেকট্রিক পদার্থ (কমলা) ধারকত্ব বৃদ্ধি করে

ধারক চার্জ করতে কৃতকাজ ধারকে সঞ্চিত শক্তির সমান। ধারক চার্জ করার অর্থ হল ধারকের দুই পাতের মধ্যে বিভব পার্থক্য সৃষ্টি করা। ধরা যাক C ধারকত্ববিশিষ্ট কোন ধারকের দুই পাতে যথাক্রমে +q ও -q আধান সঞ্চিত আছে। V = q/C বিভব পার্থক্যে অতিক্ষুদ্র আধান ধারকের এক পাত হতে অপর পাতে নিতে কৃতকাজ :

যেখানে,

W হলো কৃতকাজ যার একক জুল
q হলো আধান যার একক কুলম্ব
C হলো ধারকত্ব যার একক ফ্যারাড।

উপরিউক্ত সমীকরণটি যোগজীকরণের মাধ্যমে ধারকে সঞ্চিত শক্তি নির্ণয় করা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় ধারকের পাতদ্বয় আধানহীন (q=০)। এক পাত হতে আরেক পাতে আধান নিয়ে পাতদ্বয়কে যথাক্রমে +Q and -Q আধানে আধায়িত করতে কৃতকাজ W:

ধারকের ব্যবহারিক একক[সম্পাদনা]

প্রত্যেক বস্তুরই আধান ধারণের একটি নির্দিষ্ট সামর্থ্য আছে । আধান ধারণ করার সামর্থ্য বা ক্ষমতাকে ধারকত্ব (Capacitance) বলে। কোনো পরিবাহীতে আধানের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে বিভব বৃদ্ধি পায়। আধান এবং বিভব পরস্পরের সমানুপাতিক।

ধারকত্বের সংজ্ঞা[সম্পাদনা]

কোনো ধারকের বিভব এক একক বৃদ্ধি করতে যে পরিমাণ আধানের প্রয়োজন হয়, তাকে উক্ত ধারকের ধারকত্ব (ইংরেজি: Capacitance) বলে। একে C দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ধারকত্ব ধারকের আকার, মাধ্যমের প্রকৃতি এবং অন্য বস্তুর সান্নিধ্যের উপর নির্ভর করে।

ধারকত্বের এসআই একক[সম্পাদনা]

ধারকত্বের স্থির বিদ্যুৎ একক ছোট এবং বিদ্যুৎ চুম্বকীয় একক বড় হওয়ায় ব্যবহারিক কাজের সুবিধার জন্য বিখ্যাত বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে ধারকত্বের আরও একটি একক প্রচলন করেন। ফ্যারাডের নাম অনুসারে ধারকত্বের এ এসআই এককের নাম হয় ফ্যারাড (Farad) ।

ফ্যারাড[সম্পাদনা]

কোনো ধারকের বিভব এক একক বৃদ্ধি করতে যদি এক কুলম্ব আধানের প্রয়োজন হয়, তবে এর ধারকত্বকে এক ফ্যারাড বলে। একে সংক্ষেপে F দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

ধারকত্বের ব্যবহারিক একক[সম্পাদনা]

ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ফ্যারাড খুব বড় হয় বলে এর ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগকে ধারকত্বের আর একটি নতুন একক ধরা হয়। এর নাম মাইক্রো-ফ্যারাড । একে সংক্ষেপে μF দ্বারা প্রকাশ করা হয় ।

  • ১ ফ্যারাড (F) = ১০ মাইক্রো-ফ্যারাড (μF)
  • ১ মাইক্রো-ফ্যারাড (μF) = ১০−৬ ফ্যারাড (F)

এছাড়াও ন্যানো-ফ্যারাড (nF) এবং পিকো-ফ্যারাড (pF) নামে আরও ব্যবহারিক একক আছে । পিকো-ফ্যারাড (pF) কে মাইক্রো-মাইক্রো-ফ্যারাড (μμF) ও বলা হয় ।

  • ১ ফ্যারাড (F) = ১০ ন্যানো-ফ্যারাড (nF)
  • ১ ন্যানো-ফ্যারাড (nF) = ১০−৯ ফ্যারাড (F)
  • ১ ফ্যারাড (F) = ১০১২ পিকো-ফ্যারাড (pF)
  • ১ পিকো-ফ্যারাড (pF) = ১০−১২ ফ্যারাড (F)

[২][৩]

সংখ্যা পদ্ধতিতে ধারকের মান[সম্পাদনা]

সাধারণত পিকো-ফ্যারাডের ধারকের মান সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে উক্ত ধারকে শুধু সংখ্যায় মান লেখা থাকে।

যেমন : 8, 64, 103, 104, 205 ইত্যাদি।

এক্ষেত্রে,

μF

μF

μF

μF

μF

μF

pF

pF

pF

μF

μF

μF

pF

pF

pF

μF

μF

μF

pF

pF

pF

μF

μF

μF

[৪]

ধারক গ্রুপিং[সম্পাদনা]

সমতুল্য ধারকের ক্যাপাসিট্যান্স বাড়ানো বা কমানোর জন্য ধারক এর গ্রুপিং করা হয়। ধারক গ্রুপিং এর ধরনের উপর ক্যাপাসিট্যান্স নির্ভর করে।

ধারক গ্রুপিং এর শ্রেণিবিভাগ:[সম্পাদনা]

প্রয়োজন অনুসারে মোট ক্যাপাসিট্যান্স এর মান বাড়ানো বা কমানোর জন্য দুইটি পদ্ধতিতে ধারকের গ্রুপিং করা হয়।

  • সিরিজ গ্রুপিং
  • প্যারালাল গ্রুপিং.

সিরিজ গ্রুপিংয়ে একাধিক ধারকের মোট ক্যাপাসিট্যান্স:[সম্পাদনা]

ধারকের সিরিজ সংযোগ

যখন কতকগুলো ধারককে এমনভাবে সংযোগ করা হয় যে, ১ম টির ২য় প্রান্ত, ২য় টির ১ম প্রান্তের সাথে, পর পর এভাবে যুক্ত থাকে এবং ১ম ধারকের ১ম প্রান্ত ও শেষ ধারকের ২য় প্রান্ত সাপ্লাইয়ের সাথে যুক্ত থাকে, তখন সে সংযোগকে সিরিজ গ্রুপিং বলা হয়। সার্কিটের প্রয়োজনে উচ্চ বিভব পার্থক্য সৃষ্টির জন্য ধারকের সিরিজ গ্রুপিং বা শ্রেণি সংযোগ করা হয়। সিরিজে সংযুক্ত প্রতিটি ধারকের আড়াআড়ি ভোল্টেজ আলাদা এবং চার্জ একই থাকে, যা ক্যাপাসিট্যান্স এর উপর নির্ভর করে।

যদি, আড়াআড়ি ভোল্টেজ= এবং

চার্জ= ধরা হয়।

তাহলে,

সেই অনুসারে,

এবং

তাহলে,

বা, ]

বা,

বা,

যখন, সিরিজ সংযোগের সমতুল্য ক্যাপাসিট্যান্স। এভাবে, সংখ্যক ধারকের জন্য সিরিজ সমতুল্য ক্যাপাসিট্যান্স,

ধারকের সিরিজ গ্রুপিং বা শ্রেণি সমবায়ের ক্ষেত্রে,

  • সমতুল্য ক্যাপাসিট্যান্স কমে যায়, কিন্তু এতে উচ্চ বিভব পার্থক্য সৃষ্টি করা যায়।
  • সমতুল্য ক্যাপাসিট্যান্সের বিপরীত মান, সংযুক্ত ধারক সমূহের বিপরীত মানের পৃথক পৃথক যোগফলের সমান।

প্যারালাল গ্রুপিংয়ে একাধিক ধারকের মোট ক্যাপাসিট্যান্স :[সম্পাদনা]

ধারকের প্যারালাল সংযোগ

যখন একাধিক ধারককে এমনভাবে সংযোগ বা গ্রুপিং করা হয়, যাতে প্রত্যেক ধারকের ১ম প্রান্ত সমূহ একত্রে এবং ২য় প্রান্ত সমূহ একত্রে যুক্ত থাকে, তখন সে সংযোগ বা গ্রুপিংকে ধারকের প্যারালাল সংযোগ বা গ্রুপিং বলা হয়। সার্কিটের প্রয়োজনে চার্জ ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ধারকের প্যারালাল বা সমান্তরাল সংযোগ বা গ্রুপিং করা হয়। প্যারালালে সংযুক্ত প্রতিটি ধারকের আড়াআড়ি ভোল্টেজ একই এবং চার্জ ভিন্ন ভিন্ন থাকে, যা ক্যাপাসিট্যান্সের উপর নির্ভর করে।

যদি, এর চার্জ হয়,

এবং এর চার্জ হয়।

তাহলে,

বা,

বা,

বা,

প্যারালালে সংযুক্ত ধারক সমূহের প্যারালাল সমতুল্য ক্যাপাসিট্যান্স। এভাবে, সংখ্যক ধারকের জন্য প্যারালাল সমতুল্য ক্যাপাসিট্যান্স,

প্যারালাল সংযোগ বা গ্রুপিংয়ের ক্ষেত্রে,

  • সমতুল্য ক্যাপাসিট্যান্স বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, বিভব পার্থক্যের পরিবর্তন হয় না, কিন্তু চার্জ ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • সমতুল্য ক্যাপাসিট্যান্সের মান, সংযুক্ত ধারক সমূহের পৃথক পৃথক ক্যাপাসিট্যান্সের যোগফলের সমান।

[৫]

প্রকারভেদ[সম্পাদনা]

বিভিন্ন ধরনের ধারক
  • ইলেকট্রোলাইটিক ধারক: উচ্চ ধারকত্ব-র জন্য এই ধারক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। রেডিও-র ফিল্টার বাইপাস সার্কিটে ব্যবহৃত হলেও AC সার্কিটে ব্যবহার করা যায় না।
  • সিরামিক ধারক: এতে সিরামিক ডাই-ইলেক্ট্রিক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এদের ধারকত্ব খুবই কম। মাত্র 1pF থেকে 100pF এবং সর্বোচ্চ সহনীয় ক্ষমতা ৫০০ ভোল্ট পর্যন্ত। মূলত কাপলিং-ডিকাপলিং বাইপাস সার্কিটের এটি ব্যবহৃত হয়।
  • পরিবর্তনশীল বায়ু ধারক: এর মান প্রয়োজনমত বাড়ানো এবং কমানো যায়। এতে অনেকগুলো অর্ধবৃত্তাকার সমান্তরাল অ্যালুমিনিয়ামের পাত দুভাগে ভাগ করে বসান থাকে। পাতগুলোর মাঝে বায়ু ডাই-ইলেক্ট্রিক মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। টিউনিং সার্কিট হিসেবে এদের ব্যবহার করা হয়।

ব্যবহার[সম্পাদনা]

  • মূলত চার্জ সংরক্ষণ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
  • বিভিন্ন বর্তনীতে ধারক ফিল্টার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কারণ ধারক একমুখী তড়িৎ প্রবাহকে বাধা দেয় কিন্তু দিক পরিবর্তী প্রবাহকে তার মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হতে দেয়।
  • বিভিন্ন গ্রাহক বর্তনীতে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ ধরার জন্য বা টিউন করার জন্য ধারক ব্যবহার করা হয়।

ধারক পাওয়ার সাপ্লাই[সম্পাদনা]

চিত্র:ধারক পাওয়ার সাপ্লাই এর সার্কিট ডায়াগ্রাম

ছোট কাজের জন্য ট্রান্সফর্মারের বিকল্প হিসাবে ধারক দিয়ে তৈরি পাওয়ার সাপ্লাই ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত 105J 250V এর ধারক এবং ৪৭০ কিলো-ওহম এর রেজিস্টর ব্যবহৃত হয়। ধারক টি এসি সাপ্লাইয়ের সাথে সিরিজে সংযোগ থাকে এবং ধারকের সাথে রেজিস্টরটিও সিরিজে সংযোগ করা হয়। রেক্টিফায়ার এবং ফিল্টার এর মাধ্যমে এসি পাওয়ার কে বিশুদ্ধ ডিসি পাওয়ারে রূপান্তর করে আউটপুট গ্রহণ করা হয়। আউটপুট ভোল্টেজের উপর নির্ভর করে ধারকের ক্যাপাসিট্যান্স এবং রেজিস্টরের মান নির্ধারণ করা হয়।

অসুবিধা[সম্পাদনা]

  • আউটপুট কারেন্টের পরিমাণ অনেক কম হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ইয়ং, হিউ ডি.; ফ্রিডম্যান, রজার এ. (২০১৭)। University Physics with Modern Physics। পিয়ারসন। 
  2. জেনারেল ইলেকট্রিশিয়ান-১ । মোঃ আবদুল মতিন । পুনর্মুদ্রণ : ২০০৭ ইং । পৃষ্ঠা : ২৬৯-২৭০ । বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা-১২০৭
  3. জেনারেল ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্কস-২ । প্রকৌশলী মো: আনোয়ার হোসেন । পুনর্মুদ্রণ : অক্টোবর - ২০১৩ । পৃষ্ঠা : ২০০। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা-১২০৭
  4. বেসিক ইলেকট্রনিক্স-১ । মৌ প্রকাশনী । পরিমার্জিত সংস্করণ : ১লা জানুয়ারী, ২০০৭ ইং । পৃষ্ঠা : ৮৮-৮৯।
  5. জেনারেল ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্কস-২ । প্রকৌশলী মো: আনোয়ার হোসেন । পুনর্মুদ্রণ : অক্টোবর - ২০১৩ । পৃষ্ঠা : ২০৪-২০৬। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা-১২০৭।