দিগ্দর্শন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দিগ্দর্শন
ধরনমাসিক সংবাদপত্র
মালিকজন ক্লার্ক মার্শম্যান
প্রকাশকশ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস
প্রতিষ্ঠাকাল১৮১৮
ভাষাবাংলা, ইংরেজি
সদর দপ্তরশ্রীরামপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
প্রচলনপ্রতি সংখ্যা গড়ে ৪০০ টি

দিগ্দর্শন (বাংলা) বঙ্গভূমি থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় প্রথম সাময়িকী ছিল। এটি একটি মাসিক পত্রিকা ছিল। নামপত্রে সুস্পষ্টরূপে সাময়িক পত্রিকাটির প্রকৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘যুবলোকের কারণ সংগৃহীত নানা উপদেশ’ (যুবাদের জন্য সংগৃহীত বিভিন্ন তথ্য)।[১]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত দিগ্দর্শন পত্রিকার একটি পাতা।

দিগ্দর্শনের প্রথম সংখ্যা ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় (১২২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে)। পত্রিকাটি শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে প্রকাশিত এবং বিখ্যাত খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক জোশুয়া মার্শম্যান এর পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান সম্পাদিত মাসিক সাময়িকী ছিল।

কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি দিগ্দর্শনকে বিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবে ব্যবহার করার চিন্তা করলে সমিতি এর অনেকগুলি কপি ক্রয় করে এবং সম্পাদককে এটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশের জন্য অনুরোধ জানায়। দৈনিক সংবাদপত্র ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া ১৮১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রত্যেকটি সংখ্যার আলাদা ইংরেজি সংস্করণ এবং কিছুসংখ্যক কপি ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় প্রকাশের প্রস্তাব দেয়। প্রকাশকগণ শেষ পর্যন্ত উভয় প্রস্তাব মেনে নেন। দিগ্দর্শন-এর ২৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল তিনটি ভিন্ন সংস্করণে। বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল ১-২৬ সংখ্যা; ইংরেজি-বাংলা উভয় সংস্করণে ১-১৬ সংখ্যা এবং শুধুমাত্র ইংরেজি সংস্করণে ১-১৬ সংখ্যা। ইংরেজি সংস্করণের নাম ছিল ম্যাগাজিন ফর ইন্ডিয়ান ইয়ুথ (ভারতীয় যুবাদের জন্য সাময়িক পত্রিকা)।

দিগ্দর্শন’কে অনেকে সংবাদপত্র হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন; কিন্তু সংবাদ পত্র বলতে যা বোঝায় ‘দিগ্দর্শন’ তা ছিল না, এতে তেমন সংবাদ ছাপা হত না। তখন খুব বেশি লোকের বাংলা ভাষা জ্ঞান ছিল না,ডাক যোগাযোগেরও সমস্যা ছিল। এই সব কারণে পত্রিকাটির প্রচার তেমন ছিল না। মোট ২৬টি সংখ্যায় সর্বমোট ১০৬৭৬ কপি ছাপা হয়েছিল অর্থাৎ প্রতি সংখ্যায় গড়ে মাত্র ৪০০ কপি। দিগ্দর্শন সচিত্র সাময়িকি ছিল না এবং এতে মূলতঃ পাঠ্য পুস্তকে বর্ণিত বিষয়েরই আলোচনা থাকত। বিষয়বস্তু ছিল পদার্থ বিদ্যা,প্রাণীবিদ্যা,ভূগোল,সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি। ভাষা ও বিষয় বস্তুর একটি নমুনা দেওয়া হলো :

“অনুমান হয় পাঁচশত বৎসর গত হইল চুম্বকপাথরের গুণ প্রথম জানা গেল তাহার গুণ এই যে তাহাকে কোন লৌহে ঘষিলে সে সর্বদা দুই কেন্দ্রে অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে থাকে সেই লৌহ কোম্পাসের মধ্যে দিলে সমুদ্রে কিম্বা মৃত্তিকার উপরে যে কোন স্থানে কোন লোক থাকে সেই কোম্পাসের দ্বারা পৃথিবীর সকল ভাগ সে জানিতে পারে।”

পৃষ্ঠাটির প্রতিলিপিতে লক্ষণীয় বিষয় হল সে সময়ে রচিত বাক্যে কোন যতি চিহ্ন ব্যবহৃত হতো না। ইংরেজি ভাষার দেখাদেখি পরে যতি চিহ্নের ব্যবহার হতে থাকে।

২য় খণ্ড-১৩ ভাগ-১৮২০ জানুয়ারি সংখ্যায় ‘চীন দেশের মহাপ্রাচীর বিষয়ে’ লেখা হয়েছে : “এই প্রাচীর চীন দেশের সকল হইতে আশ্চর্য্য এবং প্রায় পৃথিবীর মধ্যেই আশ্চর্য্য ঐ প্রাচীর দ্বারা তাতার দেশ হইতে সে দিকে চীন দেশের রক্ষা হয়।” দিগ্দর্শন পত্রিকাটি দীর্ঘস্থায়ী না হলেও প্রথম পত্রিকা হিসাবে দিক দর্শনের ভূমিকায় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

দিগ্দর্শনকে যুবাদের জন্য সামায়িক পত্রিকা বলা হতো। এতে ভূগোল, কৃষিবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ইতিহাস, কলম্বাসের (আমেরিকার) আবিষ্কারের মতো ভৌগোলিক আবিষ্কারের উপর নিবন্ধ, এবং ভারত ও বাংলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গল্পসমূহ স্থান লাভ করতো। সাময়িকীটিতে কোনো চিত্র ব্যবহৃত হতো না। যদিও বাংলা গদ্য তখন শৈশবাবস্থায় ছিল তবুও দিগ্দর্শন অসাধারণ সরল ভাষা ব্যবহার করতো। ১৮২১ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যাটিতে দশপৃষ্ঠার একটি অভিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেখানে বিভিন্ন নিবন্ধে ব্যবহূত শব্দাবলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ভবিষ্যৎ সাময়িক পত্রিকাসমূহের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

দিগ্দর্শন প্রকাশের অন্য একটি ইতিহাস আছে। সে সময়ে প্রশাসকেরা ইংরেজী সংবাদপত্রকে খুব ভাল চোখে দেখত না। সেজন্য দিগ্দর্শনকে সংবাদপত্রের পরিবর্তে পরীক্ষামূলকভাবে মাসিক পত্র হিসাবে প্রকাশ করা হয়েছিল। ‘দিগ্দর্শন’ প্রকাশের পরেও যখন কোন আপত্তি উঠল না, তখন মিশনারিরা অন্য নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বের করার সিদ্ধান্ত নেন। ইংল্যাণ্ডের প্রাচীনতম সংবাদপত্র Mirror of News-এর নামানুসারে সাপ্তাহিকটির নাম সমাচার দর্পণ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

দিগ্দর্শন-এর লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ড. কেরী, মি. ওয়ার্ড, ড. জোশুয়া মার্শম্যান এবং তার পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান প্রভৃতি মিশনারিরা। এছাড়া ছিলেন রামমোহন প্রমুখ এদেশীয় পণ্ডিত ব্যক্তিগণ। রামমোহন রায়ের লিখিত ‘অয়স্কান্ত অথবা চুম্বকমণি’,‘মকর মৎস্যের বিবরণ’, ‘বলুন’, ‘প্রতিধ্বনি’ ইত্যাদি প্রবন্ধ দিগ্দর্শনেই প্রথম প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে কেদারনাথ মজুমদার বলেন– “১৮৫৪ অব্দে জনৈক মিশনারিসাহেব স্কুল বুক সোসাইটির দ্বারা বঙ্গ-বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগের জন্য ‘বঙ্গীয় পাঠ্যাবলী’ নামে এক পুস্তক প্রকাশ করেন। আমরা মিলাইয়া দেখিয়াছি সেই প্রবন্ধগুলি ও দিগ্দর্শনের প্রবন্ধগুলি এক।” দিগ্দর্শনের ৭ম সংখ্যায় ‘ছাপা কর্ম্মের উৎপত্তির বিবরণ’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এতে ছাপাখানার সে সময়ের ইতিহাস বিবৃত করা হয়েছে। মুদ্রণ শিল্পে সমসাময়িক প্রচেষ্টা ও বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্যম সম্বন্ধে জানার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "দিগ্দর্শন"বাংলাপিডিয়া। ৫ মে ২০১৪। ১৬ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ এপ্রিল ২০২০