বিষয়বস্তুতে চলুন

তাবিজ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

তাবিজ, যা সৌভাগ্যের তাবিজ বা ফাইল্যাক্টরি নামেও পরিচিত, এমন একটি বস্তু যা এর মালিককে সুরক্ষা প্রদান করে বলে বিশ্বাস করা হয়।[] "তাবিজ" শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ অ্যামুলেটাম থেকে, যা প্রাচীন রোমের ইতিহাসবিদ প্লিনি দ্য এল্ডার তার গ্রন্থ ন্যাচারাল হিস্ট্রি-তে "একটি বস্তু যা একজন ব্যক্তিকে বিপদ থেকে রক্ষা করে" হিসেবে বর্ণনা করেছেন। [] [] আবার কারো কারো মতে তাবিজ শব্দটি আরবি حمَلَت (হামালেত ) থেকে এসেছে শব্দের অর্থ ঝুলন্ত জিনিস।[] যেকোনো বস্তু তাবিজ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে; সাধারণত ব্যবহৃত বস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে মূর্তি, মুদ্রা, চিত্রাঙ্কন, উদ্ভিদের অংশ, প্রাণীর অংশ এবং লিখিত শব্দ।

বদনজর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি তাবিজ

যেসব তাবিজ জাদুর মাধ্যমে তাদের বিশেষ গুণ বা শক্তি অর্জন করে এবং ভাগ্য প্রদান করে, সেগুলো সাধারণত লোকধর্ম বা পৌত্তলিক বিশ্বাসের অংশ। অন্যদিকে, খ্রিস্টধর্মের মতো আনুষ্ঠানিক মূলধারার ধর্মে তাবিজ বা পবিত্র বস্তুর নিজস্ব কোনো ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা হয় না—যতক্ষণ না তাতে যীশুতে বিশ্বাস এবং একজন যাজকের আশীর্বাদ যুক্ত থাকে। এ বিশ্বাস অনুসারে, এসব বস্তু ধারককে অতিপ্রাকৃত উপকার দেবে না যদি তার চরিত্র বা বিশ্বাস উপযুক্ত না হয়।

"তাবিজ" ও "অ্যামুলেট" শব্দ দুটি প্রায়ই একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাবিজ বলতে এমন যেকোনো বস্তু বোঝায় যার ক্ষমতা রয়েছে মন্দ প্রভাব বা দুর্ভাগ্য দূর করার। তাবিজ সাধারণত রক্ষার উদ্দেশ্যে পরা হয় এবং এগুলো ধাতু, শক্ত পাথর বা অন্য কোনো টেকসই উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। যদিও কাগজে লেখা কিছু মন্ত্রও তাবিজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাবিজকে অনেক সময় নান্দনিক ছোট দুলের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়, যা গলায় ঝোলানো হয়। যদিও প্রতিটি দুল তাবিজ নাও হতে পারে, তবুও যেকোনো বস্তু—যা ধারককে বিপদ থেকে রক্ষা করে বলে বিশ্বাস করা হয়—তাও তাবিজ হিসেবে গণ্য হতে পারে।

ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, কিছু স্কলার এমন তাবিজকে—যা কুরআনের আয়াত বা শরিয়তসম্মত লিখন ছাড়া শুধু প্রতীক, চিহ্ন বা বস্তু দিয়ে বানানো তামিমা" বলে অভিহিত করেন। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে এসব তামিমা ব্যবহার করা হারাম বা নিষিদ্ধ, কেননা এতে শিরক (আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করা) এর সম্ভাবনা থাকে। সহিহ হাদিসে নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন:

যে ব্যক্তি তামিমা ঝুলায়, সে শিরকে লিপ্ত হয়।

— মুসনাদে আহমদ: ১৭৪৪০, (সহি সনদে) []

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় তাবিজের ব্যবহার

[সম্পাদনা]
জেদ, ওয়াজ এবং মিশরীয় ফায়েন্স দিয়ে তৈরি দেবতার মূর্তি।

প্রাচীন মিশরীয় সমাজে তাবিজ (মেকেট) জীবিত ও মৃত উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো।এগুলো ব্যবহৃত হতো সুরক্ষার জন্য এবং মহাবিশ্বের মৌলিক ন্যায়বোধ পুনঃস্থাপনের একটি উপায় হিসেবে। প্রাপ্ত প্রাচীনতম তাবিজের নমুনা বাদারিয়ান যুগের, যা প্রাক-রাজবংশীয় যুগ হিসেবে পরিচিত; এদের ব্যবহার রোমান যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

গর্ভাবস্থায় গর্ভপাত এড়াতে গর্ভবতী মহিলারা সন্তান জন্মের দেবী তাওয়েরেটের চিত্রযুক্ত তাবিজ ধারণ করতেন।[]দেবতা বেস—যার ছিল সিংহের মাথাবামনের দেহ—তাকে শিশুদের রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সন্তান জন্মের পর, একজন মা টাওয়েরেট-চিত্রিত তাবিজটি খুলে ফেলে দেবতা বেসকে প্রতিনিধিত্বকারী একটি নতুন তাবিজ ধারণ করতেন।

তাবিজগুলিতে নির্দিষ্ট কিছু প্রতীক চিত্রিত থাকত, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত ছিল আখ ও হোরাসের চোখ। হোরাসের চোখটি আসলে সেই প্রতীক যা তার কাকা শেঠের সঙ্গে যুদ্ধের সময় নষ্ট হওয়া চোখের পরিবর্তে দেবতা থোথ হোরাসকে প্রদান করেছিলেন।[]তাবিজগুলো অনেক সময় দেবতা, প্রাণী বা হায়ারোগ্লিফ প্রতীক রূপে তৈরি করা হতো। যেমন, স্কারাব পোকা-আকৃতির একটি প্রচলিত তাবিজ খেপরী দেবতাকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করত।

তাবিজ তৈরিতে সবচেয়ে প্রচলিত উপাদান ছিল মিশরীয় ফাইয়েন্স বা টিজেনেট নামে পরিচিত এক ধরনের সিরামিক। এছাড়াও পাথর, ধাতু, হাড়, কাঠ এবং সোনার মত উপাদান থেকেও তাবিজ নির্মাণ করা হতো।[]লিপিবদ্ধ লেখা বা গ্রন্থ সম্বলিত ফাইল্যাকটেরি তাবিজের আরেকটি প্রচলিত রূপ ছিল।

মেসোপটেমীয়দের মতোই প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে জাদুবিদ্যাচিকিৎসার মধ্যে কোনও স্পষ্ট পার্থক্য ছিল না। আসলে, প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে ধর্ম ছিল যাদুকরী নিরাময়ের একটি শক্তিশালীবৈধ উপায়। প্রতিটি চিকিৎসাই ছিল ব্যবহারিক চিকিৎসাজাদুমন্ত্রের একটি পরিপূরক সংমিশ্রণ। সাপের কামড়ের বিরুদ্ধে যাদুকরী মন্ত্রগুলি মিশর থেকে জানা প্রাচীনতম যাদুকরী প্রতিকার।

মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, রোগের পেছনে অতিপ্রাকৃতপ্রাকৃতিক—উভয় ধরনের কারণই কাজ করে। রোগের লক্ষণ দেখে নির্ধারণ করা হতো, নিরাময়ের জন্য কোন দেবতার আহ্বান জানানো হবে।

চিকিৎসকরা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিলেন; ফলে দৈনন্দিন প্রয়োজনে সাধারণ মিশরীয়রা প্রায়শই এমন ব্যক্তিদের উপর নির্ভর করত, যারা পেশাদার চিকিৎসক না হলেও চিকিৎসা-সম্পর্কিত কিছু প্রশিক্ষণ বা জ্ঞান রাখতেন। এই ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন লোকচিকিৎসক ও দ্রষ্টারা, যারা হাড়ের স্থান সোজা করতেন, প্রসূতিদের প্রসব করাতে সহায়তা করতেন, সাধারণ রোগের জন্য ভেষজ প্রতিকার ব্যবহার করতেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতেন। যদি কোনো চিকিৎসক বা দ্রষ্টা উপলব্ধ না থাকতেন, তাহলে সাধারণ মানুষ নিজেরাই সহায়তা ছাড়াই যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করতেন। ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য মন্ত্রআচার মুখস্থ করে রাখা প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে সম্ভবত একটি সাধারণ প্রথা ছিল।

প্রাচীন গ্রিস ও রোমানে তাবিজের ব্যবহার

[সম্পাদনা]
আমলেট, অ্যাম্বার এবং গমের কানসহ একটি রোমান যুগের (খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী) নিদর্শন (আই.ডি. ১)

প্রাচীন গ্রীক ঐতিহ্যের ধারক হওয়ায়, প্রাচীন রোমান সমাজে তাবিজের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত প্রচলিত এবং তা রোমান ধর্ম ও জাদুবিদ্যার সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিল। তাবিজ সাধারণত ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রচলিত পরিসরের বাইরে বিবেচিত হয়, যদিও কখনো কখনো নির্দিষ্ট রত্নপাথরের সঙ্গে কিছু দেবতার সম্পর্কের ইঙ্গিত দেওয়া হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বৃহস্পতি-কে দুধ-সাদা চ্যালসেডোনি পাথরে, সূর্য-কে হেলিওট্রোপে, মঙ্গল-কে লাল জ্যাস্পারে, সেরেস-কে সবুজ জ্যাস্পারে এবং ব্যাকাস-কে অ্যামেথিস্টে প্রতিনিধিত্ব করা হতো তাবিজ পরা হতো কোনো ধর্মীয় আনুগত্যের কারণে নয়, বরং সংশ্লিষ্ট দেবতার শক্তি দ্বারা পরিধানকারীকে অনুপ্রাণিত বা প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে। ভটারফেক্সিক্স’ (বা ‘উটেরে ফেক্সিক্স’, অর্থাৎ ‘ব্যবহারকারীর জন্য সৌভাগ্য’)–এর মতো শিলালিপি বহনকারী তাবিজগুলোর মধ্য দিয়ে এসব বস্তুতে বিদ্যমান অন্তর্নিহিত শক্তি আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। তাবিজ হিসেবে ব্যবহারের জন্য বিশেষ বাক্সও ব্যবহার করা হতো—যেমন যুক্তরাজ্যের নরফোকে আবিষ্কৃত থেটফোর্ড ট্রেজারের একটি অংশে দেখা যায়—যেখানে ঘাড়ে ঝুলিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে তৈরি একটি সোনার বাক্সে সালফার রাখা ছিল, যা অপোট্রপাইক (অশুভ প্রতিরোধী) গুণাবলি বহন করে বলে বিশ্বাস করা হতো।[] শিশুরাবুলা’ (ষাঁড় আকৃতির তাবিজ) ও ‘লুনুলা’ (অর্ধচন্দ্রাকার তাবিজ) পরত, এবং ‘ক্রেপুন্ডিয়া’ নামে পরিচিত একটি অ্যামুলেট-চেইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকত।[]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "Latin Definition for: amuletum, amuleti (ID: 3230) - Latin Dictionary and Grammar Resources - Latdict"latin-dictionary.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৫-১৭ 
  2. "Amulet - Etymology, Origin & Meaning"etymonline (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৫-১৭ 
  3. "Amulets"Archaeology Wiki (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৫-১৭ 
  4. "LacusCurtius • Greek and Roman Amulets (Smith's Dictionary, 1875)"penelope.uchicago.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৫-১৭ 
  5. "Amulets"islam.worldofislam.info। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৫-১৭ 
  6. Brier, Bob; Hobbs, Hoyt (২০০৯)। Ancient Egypt: Everyday Life in the Land of the Nile। Sterling। আইএসবিএন 978-1-4549-0907-1 
  7. Henig 1984, পৃ. 187।
  8. Martin-Kilcher, S. (২০০০)। "Mors immatura in the Roman world – a mirror of society and tradition"। Burials, Society and Context in the Roman World। Oxbow। পৃষ্ঠা 63–77।