বিষয়বস্তুতে চলুন

জীবন ও তার বৈচিত্র্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে


জীবন ও জীবের বংশবিস্তার

ভূমিকা[সম্পাদনা]

এই বিশ্বপ্রকৃতির বুকে প্রধানত দু'রকম বস্তু আছে, জীব এবং জড়। জীবের জীবন আছে কিন্তু জড়বস্তু প্রাণহীন এতে কোন জীবনের লক্ষণ নেই। পৃথিবী সকল প্রকার সজীব বস্তুর উৎপত্তি, গঠন, প্রকৃতি, জীবন প্রক্রিয়া, পরিবেশের সঙ্গে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, স্থায়িত্ব, বংশবিস্তার প্রত্যেকের সঙ্গে জীবজগৎ জড়িত। জীবদেহ বিভিন্ন জৈব ও অজৈব বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত, কিন্তু গঠন ও কার্যগত জড় বস্তুসমূহের ঐক্যবদ্ধ ও বিশেষ এক ভৌত রাসায়নিক সাম্যাবস্থায় নতুন বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যা হল জীবন। বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা যেভাবে জীবনের সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হল - বৃদ্ধি, প্রজনন, পরিব্যক্তি, বিবর্তন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য প্রকাশকারী প্রোটোপ্লাজমীয় ব্যবস্থাপনাকে জীবন বলে।

জীবন কাকে বলে?[সম্পাদনা]

জীবন কাকে বলে? এই প্রশ্ন যে কতকাল ধরে আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে আসছে তা বলে শেষ করা যায় না, তবু আজ পর্যন্ত এর সঠিক উত্তর খুঁজে পওয়া যায় নি। জীবন শব্দটি অনেকটা ভাবমূলক বা বিমূর্ত (abstract), কেননা এটি মানসিক উপলব্ধির বিষয়, বাস্তবে যার ধরা ছোঁওয়া পাওয়া যায় না। সৌন্দর্য বলতে যেমন ঠিক কোন জিনিসকে বোঝায় তা আমরা সঠিক বলতে পারি না, এও অনেকটা সেইরকম।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কীভাবে আমরা জীব ও জড়ের পার্থক্য টের পাই? এটা ঠিক জীবনের সংজ্ঞা জানার জন্যে নয়, বরঞ্চ জীবনের কতকগুলো বাহ্যিক লক্ষণ দেখে আমরা জীবন সম্পর্কে মনে মনে একটা ধারণা গড়ে তুলি। জীব মাত্রেই ঐসব জীবন লক্ষণ প্রকাশ করে। কিন্তু জীবন লক্ষণ আর জীবন এক জিনিস নয়, ঠিক যেমন কোনো রোগের লক্ষণগুলিকেই সেই রোগ বলা যায় না। আসল কথা, জীবন এক অজ্ঞাত রহস্যময় বস্তু যার সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায় না।

রহস্যময় বলা হচ্ছে এই কারণে যে, কোনো জীব যতোদিন বেঁচে থাকে ততোদিন তার মধ্যে জীবন-লক্ষণগুলি আমরা প্রকাশ পেতে দেখি, কিন্তু মৃত্যুর পরে তা পরিণত হয় নিষ্প্রাণ জড় বস্তুতে। অথচ তখনও তো জীবদেহের গঠনগত উপাদান একই থাকে। আবার একটি বীজের মধ্যে ঐরকম প্রাণ লক্ষণের প্রকাশ না ঘটলেও জল বাতাসের সংস্পর্শে আসামাত্র তা হয়ে ওঠে সজীব বা প্রাণময়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, জীবন সম্ভবত এক অদৃশ্য শক্তি যা জীবদেহকে ঘিরে নিজেকে ব্যক্ত করে। বীজের মধ্যে এই শক্তিই সুপ্ত অবস্থায় থাকে, যাকে 'অব্যক্ত জীবন' বলা যেতে পারে। সজীব বস্তুর মধ্যে কোথায় কীভাবে লুকিয়ে থাকে ঐ অদৃশ্য জীবনীশক্তি সে রহস্য আজও উদঘাটিত হয় নি। যতোদিন জীব বেঁচে থাকে ততোদিনই জীব পরিবেশ থেকেই পৃথক বা স্বতন্ত্র, কিন্তু মৃত্যু সেই পার্থক্যের বেড়া ভেঙে দেয়। তখন জীবদেহ জড় পদার্থে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে পঞ্চভূতে বিলীন হয়,অর্থাৎ পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। সে কারণে বলা হয়েছে। "Death is a great leveller" যতদূর জানা গেছে, অ্যারিস্টটল-ই (Aristotle, 384-322 B.C.) জীবনবিজ্ঞানের জনক। তিনি উদ্ভিদ ও প্রাণীকে জীবন্ত বস্তু বলে প্রমাণ করেন। অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে বর্তমানের কোন বিজ্ঞানী জীবনের সঠিক সংজ্ঞা দিতে পারেন নি। তবে সাধারণভাবে জীবনের সংজ্ঞা নিম্নরূপ হতে পারে:

  • কোন বস্তুর জটিল গতি-প্রকৃতির সুসংগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিত অবস্থাই জীবন।
  • পুষ্টি, বৃদ্ধি, জনন, বংশগতি, বিবর্তন ইত্যাদি ধর্মযুক্ত কোষীয় সজীব জটিল ক্রিয়াকাণ্ডকেই জীবন বলে।
  • সজীব বস্তু ও পরিবেশের জড় বস্তুর মধ্যস্থিত বিভিন্ন আন্তঃবিক্রিয়ার বহিঃ- প্রকাশকে জীবন বলে।

তথ্যসূত্রঃ মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান সহায়িকা: ষন্নিগ্রহী - ষন্নিগ্রহী। এপ্রিল ১৯৮৬, পৃঃ ১

জীবনের লক্ষণ[সম্পাদনা]

সজীব বস্তুমাত্রেই এমন সব জীবন-লক্ষণ প্রকাশ করে যা দিয়ে জড়বস্তু থেকে তাদের পার্থক্য খুঁজে নেওয়া যায়। এইসব জীবন-লক্ষণ বা প্রাণ-লক্ষণের মধ্যে আছে-

(i) প্রোটোপ্লাজম (Protoplasm; Gr. Protos= প্রথম, plasma= জীবন) সজীব বস্তু বলতে প্রোটোপ্লাজম নামে একরকম সজীব উপাদানকে বোঝায়। জড়বস্তুতে কখনই এই উপাদান দেখা যায় না। সজীব দেহের একক বা অগণিত কোষে এই প্রোটোপ্লাজম পাওয়া যায়, যা জীবের সমস্ত জৈবনিক ক্রিয়া (Life processes) পরিচালনার মূল কেন্দ্র। প্রখ্যাত জীববিদ্‌ হাক্সলির (Huxley) কথায়, এই প্রোটোপ্লাজম হ'ল জীবনের ভৌত ভিত্তিস্বরূপ।

(ii) নির্দিষ্ট অবয়ব (Definite shape and size)

সজীব বস্তু যখনই জীবদেহরূপে আত্মপ্রকাশ করে (তা সে সূক্ষ্ম বা বৃহৎ যাই হোক না কেন) তখন তা নির্দিষ্ট আকার বা অবয়ব পায়। যেমন ঘাস, আমগাছ, মশা, মাছি, বানর বা মানুষ প্রভৃতির কথা মনে হ'লেই তাদের একটি বিশেষ চেহারার ছবি আমাদের চোখে ফুটে ওঠে।

(iii) উত্তেজনায় সাড়া দেওয়া (Irritability or response to stimulus)

যে কোন রকম উত্তেজকের সংস্পর্শে এলে সজীব বস্তুর মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হয়, আর তা কার্যকরভাবে তাতে সাড়া দেয়। আলো, তাপ, চাপ, স্পর্শ বা রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে এইরকম উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে। প্রাণীরা শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার যে জন্মগত প্রবণতা দেখায় তা এর অন্তর্ভুক্ত।

(iv) সচলতা (Movement)

সচলতা বা গতিময়তা প্রাণের অন্যতম প্রধান ধর্ম। ভিতরের প্রেরণা বা তাগিদ এই সচলতার জন্যে দায়ী, এটা বাহ্যিক শক্তি প্রয়োগের অপেক্ষা রাখে না। সজীব দেহের কোষে কোষে এই সচলতার প্রকাশ আছে বলেই কোষ-পদার্থ বা প্রোটোপ্লাজমকে একটি সচল রাসায়নিক কারখানার সঙ্গে তুলনা করা চলে। নিত্যই সেখানে ছোটাছুটির কাজ চলেছে। নীচু জাতের উদ্ভিদ ও অধিকাংশ প্রাণীর যে সচলতা আমরা বাইরে থেকে প্রত্যক্ষ করি তা ঐ অভ্যন্তরীণ সচলতা বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

(v) অভিযোজন-ক্ষমতা (Adaptibility) পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী আপন প্রকৃতিতে কিছুটা অদলবদল ঘটিয়ে বাঁচার পথ প্রশস্ত করার নামই অভিযোজন। সজীব বস্তুমাত্রেই এই বিশেষ ক্ষমতা বা গুণের অধিকারী।

(vi) ধারাবাহিক জৈবনিক ক্রিয়া বা বিপাক ক্রিয়া (Metabolism)

সজীব বস্তুর দেহে (অর্থাৎ, প্রোটোপ্লাজম-পদার্থের মধ্যে) প্রতিনিয়ত যে রাসায়নিক ক্রিয়াকান্ড ঘটে চলে তাকেই এক কথায় বিপাক-ক্রিয়া বলে। এর মধ্যে যার মাধ্যমে দেহে শক্তি সঞ্চয় হয় তাহ'ল গঠনাত্মক বিপাক বা উপচিতি (Anabolism) এবং যা ঐ শক্তিকে ব্যয়িত করে তা ধ্বংসাত্মক বিপাক বা অপচিতি (Katabolism)। এই দু'রকম ক্রিয়াই একযোগে চলার ফলে দেহযন্ত্র চালু থাকে। এই বিপাক ক্রিয়ার মধ্যে আছে-

(ক) পুষ্টিসাধন (Nutrition): ইঞ্জিনকে চালু রাখতে হ'লে যেমন জ্বালানীর দরকার তেমনই সজীব বস্তুর বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজন খাদ্যের। খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে দেহের পুষ্টি ঘটানোর নামই পুষ্টিসাধন। এইভাবে খাদ্যের মধ্যে নিহিত শক্তিকে জীব নিজদেহে সঞ্চিত করে। কাজেই এটি উপচিতি।

(খ) শ্বসন (Respiration): এই প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন খাদ্যবস্তুর জারণ বা জৈবদহন ঘটায় এবং এর ফলে খাদ্যের মধ্যে নিহিত শক্তি নির্গত হয়। এই শক্তির বিনিময়েই প্রোটোপ্লাজম বিপাক-ক্রিয়া চালাতে পারে। এটি অপচিতির অন্তর্গত।

(গ) রেচন (Excretion): বিপাক-ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন রেচন পদার্থ অর্থাৎ রাসায়নিক 'বাইপ্রোডাক্ট' দেহ (কোষ) থেকে নির্গত করার নাম রেচন। এর জন্যে শক্তি ব্যয়ের প্রয়োজন হয় বলে এটি অপচিতির অন্তর্ভুক্ত।

(ঘ) ক্ষরণ (Secretion): বিপাক-ক্রিয়া চলাকালে বিভিন্ন এনজাইম, হরমোন প্রভৃতির ক্ষরণ হয়। বহুকোষী প্রাণীর ক্ষেত্রে দেহস্থ গ্রন্থি (gland) থেকে রসক্ষরণের কাজ চলে। ক্ষরিত পদার্থ মোটেই বর্জ্য বা অপ্রয়োজনীয় নয়, তা জীবের প্রয়োজনে লাগে। এই ক্ষরণও একরকম অপচিতি।

(vii) বৃদ্ধি (Growth)

সজীব বস্তু পুষ্টিসাধন-ক্রিয়ার মাধ্যমে বৃদ্ধিলাভ করে। পুষ্টির মাত্রা ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেলে তবেই বৃদ্ধি ঘটে। এরই ফলে উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহ ক্রমশঃ পূর্ণতা লাভের পথে এগিয়ে চলে।

(viii) প্রজনন (Reproduction)

প্রজনন সজীব বস্তুর অন্যতম প্রধান ধর্ম। অপত্য সৃষ্টির মাধ্যমে আপন জাতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই প্রজননের উদ্দেশ্য। বিজ্ঞানের ভাষায় 'বায়োজেনেসিস' (Biogenesis) শব্দটির জন্ম হয়েছে এর থেকে যার অর্থ জীবন থেকেই জীবন সৃষ্টি সম্ভব।

(ix) নির্দিষ্ট জীবনকাল (Definite span of life)

সজীব বস্তু মাত্রেই মরণশীল, অর্থাৎ জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে জীবের জীবনকাল সীমাবদ্ধ। এই পরিমিতিই জীবনের সৌন্দর্য, এরই কারণে প্রাচীনকে নবীনের জন্যে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। নিত্য নূতনের আবির্ভাবে প্রকৃতিও থাকে চির নূতন।

উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া চিত্র[সম্পাদনা]

লজ্জাবতী গাছ

জীবমাত্র উত্তেজনায় সাড়া দেয়। জীবের উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার ধর্মকে উত্তেজিতা বলে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

এক নজরে জীবের বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

জীব এবং জীবনের এমন কিছু লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য থাকে যা দিয়ে আমরা জড়বস্তু থেকে তাদের আলাদা করতে পারি। জীবের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই সেগুলো নিম্নরূপ;

(1) সমস্ত জীবের নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন থাকে।

(2) জীবদেহ একটি বা অনেকগুলি কোষ নিয়ে গঠিত।

(3) জীবকোষে জীবনের মৌল ভিত্তি প্রোটোপ্লাজম থাকে।

(4) জীবের জনন হয়।

(5) জীবের শ্বসন ঘটে।

(6) জীবদেহে রেচনক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

(7) জীবের পুষ্টি আছে।

(৪) জীবের চলন ও গমন হয়।

(9) জীবের বৃদ্ধি ঘটে।

(10) জীব উত্তেজনায় সাড়া দেয়।

(11) জীবে বিপাকক্রিয়া ঘটে।

(12) জীবের পরিব্যক্তি ঘটে।

(13) জীবের নির্দিষ্ট জীবনচক্র থাকে।

(14) জীবের জন্ম ও মৃত্যু ঘটে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

{{মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান সহায়িকা, ষন্নিগ্রহী-ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি। এপ্রিল ১৯৮৬ পৃঃ ৪,৫}}