জিতেন ঘোষ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
জিতেন ঘোষ
জিতেন ঘোষ
জন্ম১৯০১
মৃত্যু৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬(1976-02-03) (বয়স ৭৪–৭৫)
আন্দোলনসাম্যবাদ

জিতেন ঘোষ (১৯০১ - ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬) ছিলেন একজন সশস্ত্র বিপ্লববাদী, কমিউনিস্ট নেতা, লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা।

প্রথম জীবন[সম্পাদনা]

জিতেন ঘোষের জন্ম কুমারভোগ, মুন্সীগঞ্জে। তার পিতার নাম বংগচন্দ্র ঘোষ। মাত্র ১৪ বছর বয়েসেই পুলিশ তাকে বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ভেবে আটক করে। ১৯২০ সালে আই.এ পাশ করে বি.এ তে ভর্তি হন তারপরই ১৯২১ এর অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। ফলত কারাবরণ করতে হয়। জেলে ঘানি ঘোরাতে অস্বীকার করায় তার ওপর অত্যাচার চালায় ইংরেজ পুলিশ। তার অনমনীয় দৃঢ়তা দেখে অন্য কারাবন্দীরাও তাকে সেলাম জানায়। ছয়মাস পরে ছাড়া পেলেও আবার আইনভঙ্গের কারণে টানা দুবছর জেল। মাদারীপুর জেলে থাকার সময় বাঘা যতীনের সহকর্মী বিপ্লবী পূর্ণ দাসের সাথে আলাপ হয়। এইসময় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা পত্র পড়ার সুযোগ হয় তার। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে ছাড়া পেয়ে পিকেটিং করার অপরাধে আবার গ্রেপ্তার। এসময়ে হুগলী জেলে বিপ্লবী যতীন্দ্র নাথ দাস ছিলেন সাথী। জেলের কঠোর আইন ও অত্যাচারের প্রতিবাদে অনশনও করেন বিপ্লবী জিতেন ঘোষ।[১]

বর্মায় বিপ্লবী আন্দোলন[সম্পাদনা]

ক্রমাগত গ্রেপ্তারি আর ব্রিটিশ পুলিশের হাত এড়াতে গা ঢাকা দিলেন বর্মায় ১৯২৪ সালে এবং রেলে একাউন্টস বিভাগে চাকরিও পান। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সহ বহু বাংগালী স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ব্রিটিশ সরকার বর্মার জেলে পাঠিয়েছিল, তিনি গোপনে জেল থেকে সুভাষচন্দ্রের চিঠি পত্র, লেখা বাইরে আনার দায়িত্ব নেন। তার বিশেষ প্রচেষ্টায় প্রবাসী বাংগালীদের নিয়ে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে বর্মায়, পরে মাদ্রাজি ও আরাকানীরাও এর সাথে যোগ দেয়। সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করলে আবার গ্রেপ্তার। ১৯৩১ এ জেলে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসা না হওয়ায় অনশন।

দেশে প্রত্যাবর্তন ও গ্রেপ্তার[সম্পাদনা]

অসুস্থতাজনিত কারণে মুক্তি পেয়ে দেশে এলেও বেংগল অর্ডিন্যান্স এ আবার তাকে আটক করে পুলিশ। প্রেসিডেন্সি জেলে থাকাকালীন কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেনের সাহচর্যে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় আগ্রহ। ১৯৩৩ এ তাকে দেউলি বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়। আন্দামান বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনার দাবীতে যে অনশন হয় দেউলিতে তাতে যোগদান করেন। তাকে তারপর বহরমপুর জেলে পাঠানো হয় এবং মুক্তি পাওয়ার পরেও সরকার নজরবন্দী রাখার ব্যবস্থা করে স্বগৃহে।

কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ[সম্পাদনা]

ছাড়া পাওয়ার পর আবার বর্মা ফিরে যান পার্টি গঠনের তাগিদে। ডা. অমর নাগ ও রেংগুনের বেঙ্গল একাডেমীর ছাত্রনেতা বিপ্লবী হরিনারায়ণ ঘোষালের সাথে মিলে বর্মা কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক হন ১৯৩৮ খৃষ্টাব্দে। বর্মায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠন গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। সেই বছরই ঢাকায় ফিরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হলেন। শ্রমিক কৃষকদের সাথে সহজেই মিশে কাজ করতে পারতেন বিপ্লবী জিতেন ঘোষ। ১৯৪১ এ কুকুটিয়া গ্রামে কৃষক সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে আবার গ্রেপ্তারবরণ। দু বছর পর মুক্তি পেয়ে কুকুটিয়া অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনে সচেষ্ট হন। স্থানীয় জমিদার ও শাসকেরা সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি গ্রহণ করে আন্দোলন ব্যার্থ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। বিপ্লবী জিতেন ঘোষ কৃষক আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এবং এই চক্রান্ত আটকে যায়। হিন্দু মুসলিম কৃষক নির্বিশেষ যোগদানে তেভাগা সাফল্য লাভ করে।[২]

৪৭ পরবর্তী আন্দোলনে[সম্পাদনা]

দেশ বিভাগের পরে ঢাকায় 'লালঝাণ্ডা' সমাবেশের ব্যবস্থা করলে সভা চলাকালীন পুলিশ তাকে ধরে। ১৯৪৯-৫০ এ কয়েক মাস ব্যাপী ঢাকা ও বাংলাদেশের (ততকালীন পূর্ব পাকিস্তান) রাজবন্দীদের মর্যাদার দাবীতে ক্রমাগত যে অনশন হয় তার অন্যতম নেতা ছিলেন জিতেন ঘোষ। জেল খেটেছেন অসংখ্য বার। এমনকি জেল হাসপাতালে থাকাকালীন নার্স ও ওয়ার্ডেনদের মধ্যে সংগ্রামী ইউনিয়ন গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেন এই বিপ্লবী।[৩]

পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন ও কারান্তরালে।[সম্পাদনা]

১৯৫৩ সালে মুক্তি পেলেও আন্দোলনের পথ থেকে কখোনো সরে আসেননি জিতেন ঘোষ। সামরিক শাসনের সময় কিছুদিন কলকাতায় ছিলেন তারপর পূর্ব পাকিস্তানে বর্গাদার উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কৃষক সংগ্রামে যোগদান। ১৯৫৮ তে সামরিক আইন জারি হলে গ্রেপ্তার এবং টানা চার বছর কারান্তরালে থাকতে হয় তাকে। বিক্রমপুর এলাকায় কৃষকদের নিয়ে অক্লান্ত ভাবে দাংগা প্রতিরোধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে দাংগা ও ভারত-পাক যুদ্ধের সময় বন্দী হন। ১৯৬৭ সালে ছাড়া পেয়ে আবার খাদ্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে বন্দী। ১৯৬৯ তে আয়ুব খাঁর পতনের পর শেখ মুজিবুর রহমান, মণি সিংহ, মতিয়া চৌধুরী অন্যান্য দেশনেতাদের সাথে তিনিও ছাড়া পান।[৩]

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ[সম্পাদনা]

আজীবন বিপ্লবী জিতেন ঘোষ ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধেও সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা থেকে দুর্ভেদ্য কৃষক প্রধান অঞ্চলে চলে যান বিপ্লবী সংগঠনের কাজে। কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের কর্মীরা তার পরামর্শ নিতেন নিয়মিত। মুক্তিযুদ্ধের কার্যপ্রণালী ঠিক করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সত্তরোর্ধ বয়সেও। ১৯৭৫ এ তৈরি কৃষক লীগের অন্যতম সদস্য হন প্রবীন বিপ্লবী জিতেন ঘোষ।

মৃত্যু[সম্পাদনা]

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান খুন হলে কলকাতায় চলে আসেন গোপনে এবং ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬ কলকাতাতে মোটর দুর্ঘটনায় এই বিপ্লবীর মৃত্য হয়।

রচিত গ্রন্থ[সম্পাদনা]

  • অগ্নিদিনের বর্মা
  • জেল থেকে জেলে
  • গরাদের আড়াল থেকে
  • রক্তাক্ত ঊষা
  • এই লেনিনের দেশে[১][৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. রফিকুল ইসলাম। "জিতেন ঘোষ"গুনিজন। ১৪ মার্চ ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  2. শেখ রাসেল ফখরুদ্দিন (১৫. ১২.২০১৬)। "তেভাগা আন্দোলনে বিক্রমপুরে ব্যাপক আলোড়ন"। মুন্সীগঞ্জ টাইমস। ৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫.০১.২০১৭  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  3. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত (২০০৪)। সংসদ বাংগালী চরিতাভিধান (প্রথম খন্ড)। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ১৭৫–৭৬। আইএসবিএন 81-85626-65-0