জিউস-ক্রোনাসের যুদ্ধ
গ্রিসের মিথোলজি মূলত গ্রিসের কবিদের তৈরি মহাকাব্যকে আধার করে গড়ে উঠেছে। তাদের মতে, মানুষই হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। গ্রিকরা তাদের দেবতাদের কাহিনী তৈরি করলো নিজেদের এই ভাবমূর্তির মতো করেই। দেবতারা যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন তা বিশ্বাস করতো না গ্রিকেরা। তাদের বিশ্বাস ছিল, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই সৃষ্টি করেছে দেবতাদের। দেবতাদের সৃষ্টির পূর্বেই সৃষ্টি হয়েছিল স্বর্গ ও নরকের। মূলত, টাইটানগণ ছিলেন আদি দেবতা, দেবতারা ছিলেন তাদের সন্তান।
টাইটান ক্রনাস
[সম্পাদনা]টাইটানগণ ছিলেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর সর্বাধিকারী।[১] তাদের শক্তি ছিল অবিশ্বাস্য। তারা সংখ্যায় ছিলেন অনেক। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন ক্রনাস। তিনি টাইটানদের শাসনকর্তা ছিলেন। তবে পরবর্তীতে তাকে পরাজিত করে সকল ক্ষমতার অধিকারী হন তার পুত্র 'জিউস'।
টাইটানদের সন্তান ছিল বারো জন। তারা সকলে বাস করতো পৃথিবীর সকল পর্বতশৃঙ্গ থেকে উচ্চতম স্থানে। এর নাম ছিল অলিম্পাস। অলিম্পাসে বসবাসের কারণে তাদের বলা হতো অলিম্পীয়।
আদি প্রেক্ষাপট
[সম্পাদনা]আদিযুগের তথ্যানুযায়ী, ক্রনাস তার পিতা ইউরেনাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। মূলত মায়ের নির্দেশেই ক্রনাস এমনটি করেন। কেননা, ইউরেনাস ছিলেন একজন বাজে শাসক। এমনি তিনি তার সন্তানদেরও মায়ের থেকে দূরে রাখতেন। মূলত এই ক্ষোভ থেকে ক্রনাসের মা তার পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করার নির্দেশ দেন।
প্রেক্ষাপট
[সম্পাদনা]যখন ক্রনাস সিংহাসনে বসেন তখন এক ভবিষ্যৎবর্ণনাকারী তাকে জানান তার সন্তানই তাকে সিংহাসনচ্যুত করবে। তখন থেকেই তিনি তার সন্তানদের হত্যা করতে শুরু করেন। তবে জিউসের মা রিয়া জিউসকে বাঁচাতে সক্ষম হন। রিয়াই মূলত জিউসকে নির্দেশকে দেন ক্রনাসকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় পিতা ক্রনাসের বিরুদ্ধে জিউস বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সংঘটিত হয় ভয়াবহ এক যুদ্ধ।
সমর
[সম্পাদনা]এই যুদ্ধে ক্রনাসের পক্ষে ছিলেন তার ভাই টাইটানেরা এবং জিউসের পক্ষে ছিলেন তার পাঁচ ভাই-বোন। এছাড়াও টাইটান আয়াপেটাসের পুত্র প্রমিথিউসও জিউসের পক্ষ নিয়ে লড়াই করলেন। জিউস শত হস্তবিশিষ্ট দানবদের মুক্ত করে দেন। তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র, বজ্রপাত, ভূমিকম্প দিয়ে জিউসের পক্ষে যুদ্ধ করলো। এছাড়াও জিউসের পক্ষে ছিল প্রমিথিউসের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। প্রমিথিউসের সুচতুর বুদ্ধি আর জিউসের অসীম শক্তি ও বুদ্ধির জোরে জয় হয় জিউসের। জয় শেষে ধরিত্রীদেবী জিউসকে পরাজিত করতে পাঠালেন তার সবচেয়ে বিপজ্জনক সন্তান টাইফনকে। তবে জিউসের কাছে ছিল বজ্র ও আলোক-সম্পাতের নিয়ন্ত্রণ। এর দ্বারাই পরাস্ত করা হয় টাইফনকে।
সমর পরবর্তী ঘটনা
[সম্পাদনা]জিউস ও তার ভাই-বোনেরা জয়ের পর হলেন সকল কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি। পৃথিবী তখন ছিল মানুষের বসবাসের উপযুক্ত। তৎকালীন মানুষের ধারণা ছিল পৃথিবী ছিল একটি গোলাকৃতির চাকতির ন্যায়, যা সমুদ্র দিয়ে দুটি সমান অংশে বিভক্ত ছিল। তাই দেবতারা সৃষ্টি করলেন মনুষ্যজাতিকে।
স্বর্ণ জাতি
[সম্পাদনা]প্রথমে তারা সৃষ্টি করলেন স্বর্ণ প্রজাতি। এরা ছিল সকল শ্রম ও যন্ত্রণা থেকে দূরে, তবে এরা মরণশীল ছিল। এদের ছিল প্রচুর শস্য ও ফসল, তাছাড়া প্রচুর পশুপালনও করতো। তাই এরা ছিল দেবতাদের প্রিয়।
রৌপ্য জাতি
[সম্পাদনা]দেবতারা স্বর্ণ জাতির পর মনুষ্যপ্রজন্ম তৈরি হলো রূপা দিয়ে। এদের বুদ্ধিমত্তা এতই কম ছিল যে, তারা নিজেরাই নিজেদের আঘাত করার মাধ্যমে ধরিত্রী থেকে বিদায় নিল।
তাম্র জাতি ও লৌহ জাতি
[সম্পাদনা]রৌপের পরে এলো তাম্র প্রজাতি। এরা ছিল খুব ভয়ংকর ও শক্তিশালী। এরা নিজেরাই নিজেদের হাতে ধ্বংস হয়েছিল। এরপর পৃথিবীতে এলো দেবতাদের মতো বীর। তারা বিভিন্ন গৌরবময় যুদ্ধ ও দুঃসাহসিক অভিযানে লিপ্ত ছিল। অবশেষে তাদের স্থান হলো স্বর্গের মতো এক দ্বীপে, যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। সর্বশেষ হলো লৌহ প্রজাতি, যারা এখন বসবাস করছে পৃথিবীতে।
নারী সৃষ্টি
[সম্পাদনা]প্রমিথিউস মনুষ্যজাতির প্রতি অর্থাৎ পুরুষদের প্রতি ছিলেন উদার। তিনি তাদের জন্য সূর্য থেকে আগুন চুরি করলেন। শুধু তাই নয়, তিনি এমন এক ব্যবস্থা করলেন, যাতে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গকৃত পশুর উৎকৃষ্ট অংশটি পায় পুরুষেরা এবং নিকৃষ্ট অংশটি পায় দেবতারা। তিনি একটি ষাঁড় জবাই করলেন, উৎকৃষ্ট অংশটুকু তিনি আচ্ছাদনে লুকিয়ে রাখলেন। আর হাড়গুলো তিনি স্তূপাকারে সাজালেন। এগুলোকে তিনি আচ্ছাদিত করলেন উজ্জ্বল চর্বি দ্বারা। এরপর তিনি জিউসকে যেকোনো একটি অংশ পছন্দ করতে বললেন। জিউস পছন্দ করলেন চর্বিযুক্ত অংশটি। তবে পরবর্তীতে তিনি দেখলেন, এটি কেবল চর্বি দিয়ে সাজানো হাড়ের স্তূপ। কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। কেননা তিনি ইতোমধ্যেই নিজ পছন্দ সেরে ফেলেছিলেন।
জিউসের কাছে এ ছিল এক বিরাট অপমান। তিনি প্রমিথিউস এবং তার অতীব প্রিয় মানবজাতির উপর প্রতিশোধ নেবেন বলে ঠিক করলেন। তাই পুরুষ জাতির উপর অমঙ্গল বয়ে আনতে জিউস সৃষ্টি করে প্রথম নারী, যার নাম প্যান্ডোরা।[২] এর অর্থ- সকলের উপহারের সমন্বয়। কেননা তাকে সকল দেবতার দেওয়া উপহারের সমন্বয়ে সৃষ্টি ও সাজানো হয়েছিল। তার রূপ দেখে ভরে গেলো দেবতা ও পুরুষদের মন। এই থেকেই শুরু হলো প্রথম নারীর যাত্রা, যার সৃষ্টি হয়েছিল কেবল পুরুষজাতির মাঝে অমঙ্গল বয়ে আনতে।
তাকে যে অমঙ্গল আনতেই সৃষ্টি করা হয়েছিল, এর একটি বড় প্রমাণ হলো তাকে উপহার দেওয়া দেবতাদের একটি বাক্স। এই বাক্সের ভেতরে ছিল সকল অশুভ সামগ্রী, এমনকি প্যান্ডোরাকে বাক্সটি খুলতে দেবতারা বারণও করেছিলেন। তবে তাকে সৃষ্টিই করা হয়েছিল এভাবে যে, নিষিদ্ধ সবকিছুর প্রতি তার অগাধ কৌতূহল ছিল। যা-ই হোক, এই উপহারের বাক্সটিসহ প্যান্ডোরাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো এপিমিথিউসের কাছে, যিনি ছিলেন প্রমিথিউসের ভাই। প্রমিথিউস যদিও এপিমিথিউসকে মানা করেছিলেন, দেবতাদের কাছ থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে, তবুও তিনি তাকে গ্রহণ করলেন। তবে পরে তিনি টের পান যে, তার ভাইয়ের দেওয়া উপদেশটি পালন করলে কতটা মঙ্গলজনক হতো। এপিমিথিউসের সাথে থাকা অবস্থাতেই প্যান্ডোরা বাক্সটি খুলে ফেলেন। বাক্সটি থেকে বের হয় সকল মহামারী, মানবজাতির জন্য সীমাহীন দুঃখ ও ক্ষতি। প্যান্ডোরা দ্রুত ঢাকনাটিকে বসিয়ে দিলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। অবশ্য সেখানে একটি ভালো জিনিসও ছিল, তা হলো 'আশা'; অসংখ্য অশুভের মাঝে কেবল একটি শুভ। মানবজাতির সকল দুর্দশার মাঝে এটি আজও রয়ে গেছে সান্ত্বনা হিসেবে।
মূলত প্রমিথিউসের জিউসের সাথে করা অমন কাজের কারণেই পৃথিবীতে অশান্তির আবির্ভাব ঘটে। তাই শেষটা করা যাক প্রমিথিউসের নিয়তি বলার মাধ্যমেই। টাইটানদের সাথে যুদ্ধে প্রমিথিউসের অবদানের জন্য জিউস তার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন। তবে প্রমিথিউসের এহেন কর্মের ফলে জিউস তার অবদানের কথা ভুলে যান। জিউস কেবল প্রমিথিউসের প্রিয় মনুষ্যজাতির জীবনে অমঙ্গল এনেই ক্ষান্ত হননি, তিনি প্রমিথিউসকে ককেশাসে নিয়ে বন্দী করে রেখেছিলেন।