জসীম উদ্দিন মন্ডল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
জসীম উদ্দিন মন্ডল
জন্ম১৯২০
মৃত্যু২ অক্টোবর ২০১৭
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ব বাংলাদেশ
পেশারাজনীতি
পরিচিতির কারণবামপন্থী রাজনীতিবিদ
রাজনৈতিক দলবাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

জসীম উদ্দিন মন্ডল (১৯২০ - ২ অক্টোবর ২০১৭) বাংলাদেশের একজন বামপন্থী বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা[১], প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা[২] এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি[সম্পাদনা]

১৯২২ সালে অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার কালিদাসপুর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। যুব বয়সে ১৯৩৯ সালে তিনি রেল ইঞ্জিনে কয়লা ফেলার শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এ থেকে শ্রমিক শোষণের চিত্র দেখে তিনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। একদিকে দারিদ্রতা অন্যদিকে অত্যাচার তাকে বিৃটিশ রেল কোম্পানীর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে, তিনি হয়ে ওঠেন জীবনের রেলগাড়ির অগ্রযাত্রার পথিক। তার পিতা হাউস উদ্দিন মন্ডলও রেলওয়েতে চাকুরি করতেন। তার স্ত্রী ও বড় ছেলে ইতিপূর্বে মারা গেছেন, বর্তমানে তার ৫ মেয়ে ও নাতি-নাতনি রয়েছেন।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

কিশোর বয়সেই জসিম মন্ডল দেখা পেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর। তখন তিনি জানলেন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের কথা। ১৯৪২ এর আগস্ট শুরু হয় ঐতিহাসিক ভারত ছাড় আন্দোলন বৃটিশদের বিরুদ্ধে। চাকুরি করা তখন বেশ কঠিন ছিল। মাসে ১৭ টাকা বেতনে সহকারী ফায়ারম্যান হিসেবে চাকুরি করতে হতো। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, শ্রমিক এলাকায় সক্রিয়ভাবে আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।[৩] অনেকবার তিনি কারাভোগ করেছেন। তিনি শ্রমিক-জনসভাগুলোতে সাধারন ভাষায় সুন্দরভাবে বক্তব্য দিতে পারতেন বলে তার সমাবেশগুলোতে প্রচুর মানুষ উপস্থিত হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ[সম্পাদনা]

কমরেড জসিম মণ্ডল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাঁধে লেখা ছিল 'আইই (ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ার্স)'। মুম্বাই, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে যেসব কামান, বারুদের গাড়ি আসত, সেগুলো ট্রেনে আসামে পৌঁছে দিতেন। ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ভরতেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে নানাবিধ সাহায্য করেছেন।[৪]

ছেচল্লিশের দাঙ্গা[সম্পাদনা]

ছেচল্লিশের দাঙ্গায় জসিম মণ্ডল বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। শিয়ালদহ থেকে রানাঘাটের উদ্দেশে ট্রেন ছেড়েছিল। প্রায় ৫০০ জন দাঙ্গাবাজ ট্রেন লাইনের উপর লাল কাপড় নিয়ে দাড়িয়ে ছিল, যাতে ট্রেন থামে এবং ট্রেনের যাত্রীরা দাঙ্গার শিকার হয়। সে সময় কমরেড জসিম এক অসম সাহসিকতার কাজ করেন। তিনি ট্রেনের চালককে বলেন; ট্রেনে যাত্রী ৫০০০ জন, পক্ষান্তরে দাঙাবাজ ৫০০ জন, পাচঁহাজার যাত্রীকে বাচাঁনোর জন্য ওই দাঙ্গাবাজদের উপরেই ট্রেন চালিয়ে দিতে হবে। কথামত ট্রেনচালক সেই কাজ করেন। কতজন দাঙ্গাবাজ মারা গিয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান কেউ করেনি। তবে কমরেড জসিমের দৃঢ় চিত্তের কারণে বেচেঁ গিয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের প্রাণ।[৪]

খুদবিরোধী আন্দোলন[সম্পাদনা]

খুদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে মুসলিম লীগের মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সৈয়দপুরে রেল কারখানা দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে কমরেড জসিম সহ আরো অনেক শ্রমিকই গিয়েছিলেন। মন্ত্রী শ্রমিকদের সাথে কথাবার্তার পর বললেন, 'এদের বহু চাহিদা, এখন কথা বলার সময় নেই। চলে যাব। ' মন্ত্রীর এই কথায় সামাদ নামের কমিউনিস্ট সমর্থক এক শ্রমিক রেলের কম্পাউন্ডে উঠে ট্রেন জোড়া লাগানোর আংটা কেটে দেয়। পার্বতীপুর যাওয়ার জন্য যখন ইঞ্জিন চালু করা হলো, গোটা ট্রেন অচল হয়ে গেল। কর্মকর্তারা মন্ত্রীকে বললেন, 'আপনার ট্রেন শ্রমিকরা কেটে রেখেছে। কীভাবে যাবেন?' তখন মন্ত্রী বললেন, 'ঠিক আছে, শ্রমিকদের কথা শুনব। ' পরে শ্রমিকদের রেশনে খুদের বদলে চাল দেওয়া হলো।[৪]

উদীচির জন্মলগ্নে[সম্পাদনা]

১৯৫৪ সালে ৯২-এর ক-ধারায় কমরেড জসিম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। রাজশাহী, ঢাকা জেলে ছিলেন। ঢাকা জেলে সত্যেন সেন, নগেন সরকার, শহীদুল্লাহ কায়সারের সেসময় সান্নিধ্যে এসেছিলেন। সত্যেন সেন, নগেন সেনকে জসিম গুরু মানতেন। জসিম সর্বদাই বলতেন 'দাদা, এ দেশের মানুষ গান খুব পছন্দ করে। মুকুন্দ দাসের মতো একটি গানের দল না বানাতে পারলে এ দেশে বিপ্লব হবে না। ' রণেশদা (দাশগুপ্ত), সত্যেনদা বসে আলাপ করে এক দিন বললেন, 'হ্যাঁ গানের দল হবে'। কি নাম হবে, তা নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা চলছিল। শেষে একদিন ঠিক হলো, নাম হবে উদীচী। অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে যে আলোর উদয় হয়। ঢাকা জেলের ২৬ নম্বর সেলে সত্যেন সেন উদীচীর জন্ম দিলেন। জেল থেকে বেরোনোর পর তারা দল তৈরি করেন।[৪]

মুক্তিযুদ্ধে অবদান[সম্পাদনা]

কমরেড জসিম ও তার পরিবার প্রথম থেকেই পাকিস্তানের জন্মই স্বীকার করেননি। একাত্তরে ভারতে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখেন জসিম মণ্ডল।[৫] জসিমের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, অর্থাৎ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রাজাকারদের দেওয়া সেই তথ্যের ভিত্তিতে তাই যুদ্ধের সময় পুরো ঈশ্বরদীতে কোনো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা না হলেও; প্রচণ্ড হিংসাবশত তার বাড়ি পুড়িয়ে খুঁটি পর্যন্ত তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে সেই জমি বিক্রি করে তারা খেয়েছেন। তারা; কুষ্টিয়া-পাবনা সেক্টরে গেরিলা বাহিনীতে কুষ্টিয়ার কমিউনিস্ট জাহিদ রুমীর অধীনে যুদ্ধ করেছেন। জসিমের পুরো পরিবারের মুল কাজ ছিল—দেশের ভেতরে যাওয়া ও যুদ্ধের জন্য ছেলেদের জোগাড় করা, যারা সীমান্তের ভেতরে বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে আছে, তাদের দেখভাল করা। ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেওয়া। গ্রামগুলোতে তাদের অনেক নিরাপদ ঘাঁটি ছিল। জলপাইগুড়ি, দিনহাটাসহ সব সীমান্তে ঘুরে বেড়াতেন এই বিপ্লবী। মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা ভারতের অর্ধেক চষেছিলেন তিনি। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, রণেশ মিত্র, ইলা মিত্রের কাজই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অর্গানাইজ করা। কে কোথায় ট্রেনিং নিয়ে এসেছে, ক্যাম্পে জায়গা হচ্ছে কি না সব দেখাশোনা করা। এই বিপ্লবী মানুষটার দুই মেয়েকে জ্যোতি বসু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাজ দিয়েছিলেন। তবুও তার মেয়েরা কেউ মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাননি।[৪]

পলায়নপর জীবন[সম্পাদনা]

জসিম মণ্ডলকে অসংখ্যবার পালিয়ে থাকতে হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে ছিলেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামল, এরশাদের শাসনামলেও খেটেছেন জেল।[৪] পালিয়ে থাকা অবস্থায় পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন করেছিলেন, অংশগ্রহণ করেছিলেন শ্রমিক এলাকার বিভিন্ন সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে। মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।[৩]

শিক্ষায় অবদান[সম্পাদনা]

জসিম উদ্দিন মণ্ডলের নিজস্ব কোনো বাড়ি ছিল না। বন্দোবস্ত নেওয়া সরকারি এক খণ্ড জায়গায় তিনি বসবাস করতেন। বাড়ির পাশেই নিজ উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। বিদ্যালয়ের নাম রেখেছিলেন পশ্চিম টেংরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।[৬][৭]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় জসিম মন্ডলকে ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর সকাল ৬টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। পরদিন ৩ অক্টোবর তার মৃতদেহ জাতীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে রাখা হয় এবং যোহরের নামাযের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার জানাযা সম্পন্ন হয়। এরপর একইদিন সন্ধ্যায় রাজবাড়ী ও কুমারখালীতে এবং রাতে কুষ্টিয়া সদরে তার আরো ৩টি জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর, ৪ অক্টোবর তারিখ সকাল ৭ ঘটিকায় তার পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের হৃদয়পুর-ছাতারপাড়ায় আরেকটি জানাযা শেষে তাকে ঈশ্বরদী পৌর গোরস্থানে এনে দাফন করা হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. প্রতিনিধি, পাবনা (২০১৭-১০-০২)। "কমরেড জসিম মন্ডল গুরুতর অসুস্থ"অমৃতবাজার পত্রিকা। ঢাকা: অমৃতবাজার পত্রিকা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১০-০২ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. ঈশ্বরদী প্রতিনিধি, পাবনা অফিস ও (২০১৭-০৯-২৪)। "জসিম মন্ডল শয্যাশায়ী"সমকাল। ঢাকা: দৈনিক সমকাল। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. করেসপন্ডেন্ট, স্পেশাল (২০১৭-১০-০২)। "সিপিবির উপদেষ্টা জসিম মন্ডল মারা গেছেন"বাংলা নিউজ। ঢাকা: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর .কম। 
  4. "সাক্ষাৎকারে জসিম মণ্ডল"। কালের কন্ঠ। ১৭ আগস্ট ২০১৭। 
  5. "শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত কমরেড জসিম মণ্ডল"। bdnews24। ২০১৭-১০-০৩। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  6. প্রতিনিধি, ঈশ্বরদী (পাবনা) (২ অক্টোবর ২০১৭)। "কমিউনিস্ট নেতা জসিম উদ্দিন মণ্ডল আর নেই"প্রথম আলো। ঢাকা: মতিউর রহমান 
  7. "কমরেড জসিম মণ্ডল আর নেই"। বাংলাদেশ প্রতিদিন।