বিষয়বস্তুতে চলুন

ঘেঁটুপূজা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ঘেঁটুপূজা হল বাংলার এক অন্যতম লৌকিক দেবতা ঘেঁটুঠাকুরের উদ্দেশ্যে বাৎসরিক পূজা ও উৎসব। বাংলার লোকসংস্কৃতিতে বসন্ত ঋতুতে আবির্ভূত ছোঁয়াচে চর্মরোগের (খোস-পাঁচড়া) নিবারণের জন্য ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তিতে ঘেঁটুর পূজার্চনা করা হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরদক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, বাঁকুড়া জেলায় বাঙালি হিন্দুসমাজে ঘেঁটুপূজা হয়ে থাকে।[]

ঘেঁটু ঠাকুর

[সম্পাদনা]

ঘেঁটু বা ঘণ্টাকর্ণ হলেন বাংলার জনসমাজের কল্পিত ঘৃণার্হ এক চর্মরোগের দেবতা, শিবের অনুচর এবং তীব্র হরিবিদ্বেষী। মঙ্গল দেবতা বিষ্ণুর বিপরীতে এই দেবতার অবস্থান, অনেকটা কার্তিকী অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত অলক্ষ্মীপূজার মত। বসন্ত ঋতুতে খোস-পাঁচড়ার বাড়বাড়ন্ত যাতে না হয়, সেজন্য এই কাল্পনিক অশুভ দেবতাকে মেরে বিদায় জানানো হয়। পূজার অন্যতম উপকরণ ঘেঁটু ফুল (ভাট ফুল) থেকে দেবতার এরূপ নাম হয়ে থাকতে পারে।[] এই দেবতা (বিষ্ণুবিদ্বেষহেতু) বিষ্ণুনাম কর্ণগোচর যাতে না হয় সেজন্য দুইকানের পাশে সর্বদা ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখেন; তাই এঁর আরেক নাম 'ঘণ্টাকর্ণ'।[]

পূজার নিয়ম

[সম্পাদনা]

প্রতি বছর ফাল্গুনের সংক্রান্তির সকালে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজার জন্য আলাদা করে পুরোহিতের দরকার হয় না, গৃহস্থ পুরুষ-মহিলারাই করতে পারে। পূজার জন্যে লাগে মুড়িভাজার পুরোনো ঝুলকালিমাখা একটি মাটির খোলা ('কেলে হাড়ি'), তেল হলুদে চোবানো অব্যবহার্য ছোট বস্ত্রখণ্ড, তিনটি কড়ি, ছোট ছোট তিনটি গোবর দিয়ে পাকানো পিণ্ড, ঘেঁটু ফুল, সিঁদুর, ধান ও দূর্বা ঘাস।

প্রথমে ব্রতিনীরা এলোচুলে বসে বাম হাতে মাটির খোলাটা নিকোনো জায়গায় বসিয়ে দেন। তার উপরে তিনটি গোবরের পিণ্ড লাগিয়ে সেগুলি কড়ি, সিঁদুর ঘেঁটু ফুল দিয়ে সেটি সাজানো হয়। খোলার উপরে বস্ত্রখণ্ডটি বিছিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির সামনে উঠোনে বা একটু দূরে রাস্তার তিনমাথা, চারমাথার ধারে জনতার মাঝে এটি সম্পন্ন হয়। ছড়া কাটা হয় —

"ধামা বাজা তোরা কুলো বাজা
এলো এলো দ্বারে ঘেঁটু রাজা।"

পূজার শেষে অল্পবয়সী ছেলেরা মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে খোলাটা ভেঙে দিয়ে হরিবিদ্বেষী ঘেঁটু দেবতাকে অপমান করে, তারপর দৌড়ে পুকুরের জলে হাত পা ধুয়ে আসে যাতে তাদের চর্মরোগ না হয়। এরপর মহিলারা ওই বস্ত্রখণ্ডটি এনে বাচ্ছাদের চোখে বুলিয়ে দেন এবং খোলার ঝুলকালি কাজলের মতো পরিয়ে দেন যাতে চোখ ভালো থাকে।

এই ঘেঁটু ঠাকুরকে বিদায় করে হরিনাম কীর্তন বা হরিযশ গাওয়া হয় —

"ভাগ্যমানে কাটায় পুকুর চণ্ডালে কাটে মাটি
কুমোরের কলসী, কাঁসারির ঘটি
জল শুদ্ধ, স্থল শুদ্ধ, শুদ্ধ মহামায়া
হরিনাম করলে পরে শুদ্ধ হয় আপন কায়া।।"

সন্ধ্যেবেলা ছোট ছোট ছেলেরা রঙীন কাগজ ও কঞ্চি দিয়ে ছোট্ট ডুলি বানিয়ে তাতে ঘেঁটু ফুল ও প্রদীপ দিয়ে ঘেঁটু ঠাকুরকে সাজিয়ে তা কাঁধে করে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং ঘেঁটুর গান গেয়ে চাল পয়সা ভিক্ষা করে। [][]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. বাংলার লৌকিক ধর্মসংগীত, তৃপ্তি ব্রহ্ম, পৃষ্ঠা: ২২৭
  2. বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী, আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা: ৭০০০৯৪, প্রথম প্রকাশ:২০০৪, পৃষ্ঠা: ৪৭৯

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]