গওহর জান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
গওহর জান
অ্যান্জেলিনা ইওয়ার্ড
গওহর জান
গওহর জান
প্রাথমিক তথ্য
জন্মনামঅ্যান্জেলিনা ইওয়ার্ড
জন্ম(১৮৭৩-০৬-২৬)২৬ জুন ১৮৭৩
আজমগড়, উত্তর-পশ্চিম রাজ্য, বৃটিশ ভারত
উদ্ভবআজমগড়, উত্তর-পশ্চিম রাজ্য, বৃটিশ ভারত
মৃত্যু১৭ জানুয়ারি ১৯৩০(1930-01-17) (বয়স ৫৬)
মহীশূর
ধরনগজল, ঠুমরি, দাদরা
পেশাগায়িকা ও নর্তকী
কার্যকাল১৮৮৭–১৯৩০

গওহর জান (২৬ জুন ১৮৭৩ - ১৭ জানুয়ারি ১৯৩০) এক স্বনামধন্য ভারতীয় গায়িকা। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের গজল, দাদরাঠুমরি গোত্রের গানের এক বিরল শিল্পী। ভারতের প্রথম মহিলা সুপারস্টার। তিনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী যাঁর গান গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড করে।[১]

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

গওহর জানের জন্ম ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুন বৃটিশ ভারতের বর্তমানে উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে। দাদু ছিলেন বৃটিশ আর দিদিমা ছিলেন ভারতীয়। তাঁদের মেয়ে ভিক্টোরিয়া ছোট থেকেই নাচগানে পারদর্শী। ভিক্টোরিয়ার বিবাহ হয় শুষ্ক বরফ কারখানার ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ইওয়ার্ডের সাথে। তিনি ছিলেন আমেরিকান ইহুদি। গওহর জানের জন্মের সময় নাম ছিল অ্যান্জেলিনা ইওয়ার্ড। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম ও ভিক্টোরিয়ার বিবাহ বিচ্ছেদের পর ভিক্টোরিয়া আন্জেলিনাকে নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে পড়লেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে বারাণসী চলে এলেন। খুরশিদ নাম্নী এক মুসলিম সম্প্রদায়ের সহৃদয় ব্যক্তি ভিক্টোরিয়ার গানের প্রসংশা করলেন এবং তারই বদান্যতায় প্রাথমিক সহায়তা ও মনোবল পেলেন। জন্মসূত্রে গওহর জান খ্রিষ্টান,পরে তিনি ও তার মা বারাণসীতে অবস্থান কালে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মায়ের নাম ভিক্টোরিয়া ইওয়ার্ড পরিবর্তে হয় মালকা জান। ছোটবেলা থেকেই পারদর্শিতার কারণে হিন্দুস্থানী গান, কত্থক, ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পকলায় ছিল তার অনায়াস গতি। কিছুদিন বারানসী অবস্থানের পর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে চলে আসেন দেশের রাজধানী কলকাতায়। তখন মেটিয়াবুরুজে বাস করতেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। তার সভাশিল্পী হিসাবে তিন বৎসর থাকার পর নিজে কলকাতা চিৎপুর অঞ্চলে নাখোদা মসজিদের পাশে (বর্তমানে ৯২, রবীন্দ্র সরণীতে) একটি বাড়ি কেনেন। এখানে ছোট গওহরের সংগীত, নৃত্য ও ভাষা শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের শিক্ষা ও গুণে এমনিতেই গুণান্বিত ছিলেনই। সেই সাথে বহুবিখ্যাত ওস্তাদের ( যেমন পাতিয়ালা ঘরানার কালু খান, আলি বক্স জার্নেল, কিংবদন্তি কত্থকশিল্পী বৃন্দদিন মহারাজ, ধ্রুপদ শ্রীজনবাঈ, চরণ দাসের বাংলা কীর্তন) কাছ থেকে তালিম নেন এবং অচিরেই নৃত্য ও সঙ্গীত পটিয়সী হয়ে ওঠেন ও খ্যাতি অর্জন করেন। মালকা ও গওহর জানের গানের খ্যাতি শুনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন পরবর্তীকালের আর এক কিংবদন্তি বেগম আখতার

সঙ্গীত জীবন[সম্পাদনা]

কিশোরী গওহর জানের প্রথম অনুষ্ঠান ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বিহারের দ্বারভাঙা মহারাজের আমন্ত্রণে। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি হয়ে গেলেন রাজার সভাশিল্পী। পরে চলে আসেন কলকাতায়। নিজেই স্বাধীন ভাবে অনুষ্ঠান করতে থাকেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার অনুষ্ঠানে "ফার্স্ট ড্যানসিং গার্ল" হিসাবে পরিচিতি পান। এরপর দেশের বিভিন্ন শহরে মেহফিল করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইতিমধ্যে চিৎপুরের তার বাড়ি কলকাতার বিশেষ দ্রষ্টব্য "গওহর বিল্ডিং" (বর্তমানে পরিবর্তিত নাম 'সেলিম মঞ্জিল')এ পরিণত। মায়ের মৃত্যুযন্ত্রণার শোক ভুলতে পার্সি অভিনেতা অমৃত কেশব নায়কের (১৮৭৭ - ১৯০৭) সংস্পর্শে আসেন ১৯০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই শহরে। তিনি মাত্র দু-তিন বছরের সম্পর্কে অনেক খানি জায়গা নিয়ে ছিলেন তিনি গওহরের জীবনে। কিন্তু ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে অমৃত পরলোক গমন করেন। গওহর তো আর রাত রঙিন করা তবায়েফ ছিলেন না, তিনি ছিলেন জাত শিল্পী। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মাদ্রাজের (বর্তমানে চেন্নাই এর) ভিক্টোরিয়া পাবলিক হলে সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবং সেটি সপ্রশংস তামিল মিউজিক বুকে আলোচিত হয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ রাজ পঞ্চম জর্জের সম্মানে দিল্লির দরবারে এলাহাবাদের (বর্তমানে প্রয়াগরাজের) জানকী বাঈয়ের সাথে সঙ্গীত "মুবারক হো,মুবারক হো", য়ে হ্যায় তজ্পোশী কা জলসা" পরিবেশন করেন তিনি। রাজা পঞ্চম জর্জ খুশি হয়ে এক হাজার গিনি উপহার দিয়েছিলেন দুজনকেই।

কলের গান মানেই গওহর জান[সম্পাদনা]

কথাটি সেসময় বহুল প্রচলিত ছিল। কেননা মার্কিন সঙ্গীতজ্ঞ ও রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেড গেইসবার্গ ( ১৮৭৩-১৯৫১) এর তত্ত্বাবধানে গ্রামোফোন কোম্পানি গওহরের গাওয়া খেয়াল (রাগ - যোগিয়া, উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত ঘরানার ভৈরব ঠাটের অন্তর্গত ) রেকর্ড করলেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ই নভেম্বর প্রথম কোন ভারতীয় শিল্পীর গান ৭৮ আরপিএম রেকর্ড হিসাবে বের হয়। গওহর শুধু যে হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করেছিলেন তা' নয়। তিনি নিজেও গীতিকার ছিলেন। অমৃত কেশব নায়কের সাথেও অনেক গান লিখেছিলেন। রবীন্দ্র সংগীতও গাইতেন। তার ভীষণ প্রিয় ছিল কবিগুরুর গান। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেশবিদেশের দশটি ভাষায় - বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠা, তামিল, আরবি,পার্সি, পাশতুন, ফরাসি ইংরাজী - গান করেছেন। গ্রামোফোন কোম্পানিও তার এই দশটি ভাষায় প্রায় ৬০০ টি রেকর্ড প্রকাশ করেছিল। আর কোন ভারতীয় শিল্পীর এমন কৃতিত্ব ছিল না সেসময়।

অনেক খ্যাতি সহ সম্পদ ও প্রাচুর্যের অধিকারী হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভালবাসায় প্রত্যাঘাত হয়েছিলেন তিনি। যাকে মনের মানুষ ভেবে বয়সে অনেক ছোট তবলচি সৈয়দ আব্বাসকে বিবাহ করেছিলেন,সে ঠকিয়ে তার সম্পত্তি আত্মসাৎ করে। ফলে মামলা মোকদ্দমায় সর্বস্বান্ত হয়ে একদিন কলকাতার চিৎপুরের বাড়িটাও চোখের জলে ছাড়তে হয়েছিল ভারতের গানের রাণীকে। সে বেদনা তার নিজের লেখা গানে, তার কণ্ঠেও বেজে উঠেছে। শেষমেষ ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা আগস্ট মহীশূররাজের কৃষ্ণ রাজা ওয়ারিঅর চতুর্থ ডাকে চিরতরে কলকাতা ছাড়লেন। [২]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

কিন্তু পারফর্ম না করে অন্যের বদান্যতায় বাঁচার পাত্রী ছিলেন না গওহর। রাজার সভাশিল্পী হিসাবে মাত্র দেড় বৎসর বেঁচে ছিলেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি মাত্র ৫৭ বৎসর বয়সে প্রয়াত হন।[১]

সম্মাননা[সম্পাদনা]

জীবৎকালে গওহর জান পেয়েছেন অনেক অনেক নজরানা আর খ্যাতি। কিন্তু শেষে, খ্যাতি ছাড়া খুইয়েছেন সবই, শেষ বয়সে একেবারে নিঃস্ব। মৃত্যুর প্রায় নয় দশক বাদে গুগুল ভারতের এই গ্রামোফোন কন্যার ১৪৫ তম জন্মদিনে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুন শ্রদ্ধা জানায় ডুডুলের মাধ্যমে।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]