বিষয়বস্তুতে চলুন

কোমাগাতা মারু ঘটনা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কোমাগাতা মারু ঘটনা
কোমাগাতামারু জাহাজে শিখ, মুসলিম এবং হিন্দু যাত্রীরা
তারিখ২৩ মে ১৯১৪
অবস্থানভ্যানকুভার, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া
ফলাফলজাহাজটিকে কানাডা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করানো হয়
মৃতসরকারি মতে ২৬ জন[ক] প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ৭৫ জন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ৪ এপ্রিল কোমাগাতা মারু নামের এক বাষ্পচালিত জাপানি জাহাজে ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজদের অত্যাচার এড়িয়ে বিদেশে বসবাসের উদ্দেশ্যে ৩৭৬ জন পাঞ্জাবি শিখ, মুসলিম এবং হিন্দু কানাডার উদ্দেশ্য যাত্রা করে। ২৩ মে জাহাজটি ভ্যানকুভারে অবতরণ করলে কানাডা সরকার তৎকালীন আইনানুসারে ২৪ জনকে অভিবাসনের অনুমতি দেয় এবং বাকিদের জোর করে ফেরত পাঠায়। জাহাজটি উপায়ান্তর না পেয়ে, বাধ্য হয়েই শেষে বজবজ বন্দরে অবতরণ করে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ শুরু হয় ব্রিটিশ শাসকের দমননীতি, অসম লড়াই, যা বজবজের যুদ্ধ বা কোমাগাতা মারু ঘটনা হিসাবে পরিচিত হয়। ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ২০জন ভারতীয়, আহত হন অনেকেই।[২]

প্রেক্ষাপট[সম্পাদনা]

কোমাগাতা মারু ঘটনার নায়ক ছিলেন ব্রিটিশ ভারতে পাঞ্জাবের অমৃতসরের এক দূরদর্শী ধনী ব্যবসায়ী বাবা গুরদিত সিং।

বাবা গুরদিত সিং (১৮৬০-১৯৫৪)

তিনি সিঙ্গাপুর ও মালয়ে ঠিকাদারী ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কোন এক সময়ে পাঞ্জাবে ফিরে আসেন এবং গদর পার্টির বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হন। তার উদ্দেশ্য ছিল-

  • প্রাচ্য প্রবাসী শিখদের ন্যায্য মজুরীতে জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা করা এবং
  • কানাডা সরকারের বিদেশীদের জন্য অত্যাচারমূলক বিদেশীদের প্রবেশাধিকার সম্পর্কিত আইন দ্য কন্টিউয়াস প্যাসেজ অ্যাক্ট এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।[৩]

স্বদেশীদের সাহায্য করতে তিনি ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কোমাগাতামারু জাহাজটি ভাড়া করেছিলেন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে জাপানে নির্মিত কোমাগাতা মারু মূলত ছিল পণ্যবাহী জাহাজ। জাহাজটি ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে ৩৭৬ জন যাত্রী নিয়ে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল ব্রিটিশ হংকং থেকে সাংহাই, চীন এবং ইয়োকোহামা জাপান হয়ে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যাঙ্কুভার বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যাত্রীদের মধ্যে ৩৩৭ জন শিখ, ২৭ জন মুসলিম এবং ১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন।[৪] জাহাজটির যাত্রার দুদিন আগেই ব্রিটিশ শাসিত হংকংয়ের পুলিশ গুরদিত সিং-কে গ্রেফতার করে। কেননা গুরদিত কানাডার 'দ্য কন্টিউয়াস প্যাসেজ অ্যাক্ট' সম্পর্কে সব কিছুই জানতেন এবং এর বিরোধিতা করার জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি বেআইনিভাবে টিকিট বিক্রি করেছেন ইত্যাদি নানা অজুহাতে প্রথমদিকে ইংল্যান্ড নয়তো কানাডা নির্দেশের সাপেক্ষে যাত্রা স্থগিত রাখা হয়েছিল। শেষমেষ অনুমতি পাওয়ায় যাত্রা শুরু হয় ৪ এপ্রিল। এই ৩৭৬ জন যাত্রীর মধ্যে ২৪ জন যাত্রীকে কানাডা গ্রহণ করে এবং বাকি ৩৫২ জন যাত্রীকে বন্দরে নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাদের ভারতে ফিরে আসার জন্য চাপ দিতে থাকে। শেষে জাহাজটিকে কানাডার জলসীমায় নোঙ্গর করতে দেয়নি। জলসীমাছেড়ে যেতে বাধ্য করতে কানাডার পুলিশ মধ্যরাতে এর যাত্রীদের উপর হামলা চালায়। আরোহীরা গুলি বর্ষণে পুলিশের হামলা প্রতিরোধ করে।

কানাডা সরকারের এই অত্যাচারে প্রবাসী ভারতীয় এবং জাহাজে আরোহী ভারতীয়দের মধ্যে প্রথমে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। ভারতে গদর পার্টির প্রচারকদের প্রচারে ভারতে বিক্ষোভ বিদ্রোহের আকার নেয়।

যাত্রীরা কানাডার পুলিশ বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করলেও কানাডার শাসক অবশেষে কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করে এবং পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়ায় জাহাজটি অবশেষে ফেরত আসে।[৫]

কোমাগাতা মারু ব্রিটিশ অধিভুক্ত হংকং ফিরে আসলে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অজুহাতে আরোহীদের অবতরণ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি তাদের প্রাচ্যের পূর্ব কর্মস্থল সিঙ্গাপুরের অবতরণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষে একরকম নিরুপায় হয়েই কলকাতা অভিমুখে অগ্রসর হয়। প্রকৃতপক্ষে ভারতের ব্রিটিশ শাসকের শাস্তিদানের সিদ্ধান্তেই কোমাগাতা মারুর বজবজে অবতরণ।

কেননা ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর জাহাজটি হুগলি নদীতে প্রবেশের পরপরই ইউরোপীয়ান পোর্ট পুলিশের অধীনে আসে। জাহাজটি শেষ পর্যন্ত ২৯ শে সেপ্টেম্বর বজবজ বন্দরে-এ পৌঁছায়। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ শাসক যাত্রীদের অবস্থান কলকাতায় নিষেধ করে এবং এই উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে ব্যবস্থা করা পাঞ্জাবগামী ট্রেনে চড়ার নির্দেশ দেয়। তারা এটা করতে অস্বীকৃতি জানালে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে[৫] এতে ঘটনাস্থলেই ২০ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনা স্বাধীনতার ঢেউকে আরও তীব্র করে তোলে।

উত্তরাধিকার[সম্পাদনা]

স্মারক[সম্পাদনা]

ভারতে-
কোমাগাতা মারু শহীদগঞ্জ, বজবজ

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার বজবজের শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে। এটির উদ্বোধন করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু । স্থানীয়ভাবে স্মৃতিস্তম্ভটি পাঞ্জাবি মনুমেন্ট নামে পরিচিত এবং এটি আকাশের দিকে উন্নিত একটি কিরপান (খঞ্জর) এর আদলে তৈরি । [৮]প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে, স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মাণ পরিকল্পনা করেছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি হাবিব রহমান

ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক, কলকাতা বন্দর এবং কোমাগাতা মারু ট্রাস্টের মধ্যে নিষ্পাদিত এক ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে ২৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিস্তম্ভটির পাশে নিচের তলায় প্রশাসন ও গ্রন্থাগার, দ্বিতীয় তলে সংগ্রহালয় এবং তৃতীয় তলে প্রেক্ষাগৃহের সুবিধাযুক্ত একটি তিলতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। [৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Report of the Komagata Maru Committee of Inquiry and Some Further Documents। Unistar Books and Punjab Centre for Migration Studies। ২০০৭। পৃষ্ঠা 74। আইএসবিএন 9788189899349। সংগ্রহের তারিখ ১২ এপ্রিল ২০২২ 
  2. "বজবজের রক্তারক্তি ইতিহাস মনে রেখে কানাডায় রাস্তার নাম, কেন এই উদ্যোগ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-২৫ 
  3. "বজবজের যুদ্ধ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-২৫ 
  4. Johnston, Hugh (৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৬)। "Komagata Maru; The Canadian Encyclopedia"www.thecanadianencyclopedia.ca। ৫ এপ্রিল ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ এপ্রিল ২০২১ 
  5. "অমৃতসর এবং কোমাগাতা মারু ঘটনা"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-২৫ 
  6. "Continuing the voyage of Komagata Maru"The Tribune India। সংগ্রহের তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ 
  7. "100 साल बाद कामागाटामारू के हीरो गुरदित्त की याद में केंद्र ने जारी किया 100 रुपए का सिक्का"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৬-২৫ 
  8. Chakraborti Lahiri, Samhita (সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১০)। "Ship of Defiance"The Telegraph। ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫ 
  9. Singh, Gurvinder (জুন ২৭, ২০১৫)। "New building to honour Komagata Maru martyrs" (Kolkata)। The Statesman। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৮, ২০১৫ 


উদ্ধৃতি ত্রুটি: "lower-alpha" নামক গ্রুপের জন্য <ref> ট্যাগ রয়েছে, কিন্তু এর জন্য কোন সঙ্গতিপূর্ণ <references group="lower-alpha"/> ট্যাগ পাওয়া যায়নি