বিষয়বস্তুতে চলুন

কুসাই ইবনে কিলাব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কুসাই ইবন কিলাব
قصي بن كلاب
زيد بن كلاب
কুরাইশ গোত্রের প্রথম প্রধান
উত্তরসূরীআবদ মানাফ ইবন কুসাই
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্মযায়দ ইবন কিলাব
৪০০
আরব
মৃত্যু৪৮০ (বয়স ৭৯–৮০)
মক্কা, হিজাজ, আরব
দাম্পত্য সঙ্গীহুব্বা বিনত হুলায়ল
সন্তানআবদ আল-দার (পুত্র)
আবদ মানাফ (পুত্র)
আবদ আল-উজ্জা (পুত্র)
পিতামাতাকিলাব ইবন মুররাহ (পিতা)
ফাতিমা বিনত সা'দ (মাতা)
আত্মীয়স্বজনযুহরা ইবন কিলাব (ভাই)
যে জন্য পরিচিতনবী মুহাম্মদের পূর্বপুরুষ

কুসাই ইবন কিলাব ইবন মুররাহ (আরবি: قصي بن كلاب بن مرة, কুসাই ইবন কিলাব ইবন মুররাহ; আনুমানিক ৪০০–৪৮০), যাঁর নাম বিভিন্নভাবে কুসাই, কুসায়্য, কুসাই বা কসসাই হিসেবেও লেখা হয়, জন্মনাম ছিল যায়দ (আরবি: زيد)।[] তিনি ইসমাইলীয় বংশধর এবং ইব্রাহিম নবীর উত্তরসূরি ছিলেন। ছোটবেলায় তিনি পিতৃহীন হন। পরবর্তীতে তিনি মক্কার প্রধান এবং কুরাইশ গোত্রের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।[] তিনি মূলত ইসলামের নবী মুহাম্মদের পূর্বপুরুষ হিসেবে বিখ্যাত। এছাড়াও তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ রাশিদুন খলিফা উসমান এবং আলী-এর পূর্বপুরুষ ছিলেন। তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকে উমাইয়া, আব্বাসীয়, এবং ফাতিমীয় খলিফাদের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ খলিফা এবং হাশেমীয় বংশের প্রভাবশালী শাখাসমূহ উদ্ভূত হয়েছে।[]

পটভূমি

[সম্পাদনা]

কুসাইয়ের পিতা ছিলেন কিলাব ইবন মুররাহ, যিনি কুসাই শৈশবে মারা যান। ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, কুসাই ইব্রাহিম (আব্রাহাম)-এর বংশধর ছিলেন, যিনি তাঁর পুত্র ইসমাইল (ইসমাইল)-এর মাধ্যমে এই বংশধারা চালিয়ে যান। কুসাইয়ের বড় ভাই যুহরা ইবন কিলাব ছিলেন বানু যুহরা গোত্রের পূর্বসূরি। পিতার মৃত্যুর পর, কুসাইয়ের মা ফাতিমা বিনত সা'দ ইবন সাইল, বনী আজরা গোত্রের রাবিয়াহ ইবন হারাম-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রাবিয়াহ তাঁকে সিরিয়া নিয়ে যান এবং সেখানে ফাতিমা 'দাররাজ' নামক এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।[] কুসাইয়ের চাচা ছিলেন তাইম ইবন মুররাহ ইবন কা‘ব ইবন লু'য়্য ইবন গালিব ইবন ফিহর ইবন মালিক ইবন আন-নাদর ইবন কিনানাহ, যিনি কুরাইশ আল-বিতাহ-এর অন্তর্গত ছিলেন। অর্থাৎ, তিনি সেই কুরাইশিদের মধ্যে ছিলেন যারা কাবার আশেপাশে মক্কায় বসবাস করতেন।[]

সিরিয়ায় জীবন

[সম্পাদনা]

কুসাই তার সৎপিতা রাবিয়াহকে নিজের প্রকৃত পিতা হিসেবে গণ্য করে বড় হন। এক সময় রাবিয়াহ গোত্রের কিছু সদস্যের সঙ্গে কুসাইয়ের বিবাদ হয়। তারা তাকে অপমান করে জানিয়ে দেয় যে, তারা কখনোই কুসাইকে নিজেদের একজন বলে মেনে নেয়নি। কুসাই এই বিষয়টি তার মায়ের কাছে জানালে তিনি বলেন, "হে আমার পুত্র, তোমার বংশ তাদের চেয়ে অনেক সম্মানজনক। তুমি কিলাব ইবন মুররাহ-এর সন্তান, আর তোমার জাতির লোকেরা মক্কায় পবিত্র কাবা ঘরের সান্নিধ্যে বসবাস করে।" এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কুসাই সিরিয়া ছেড়ে মক্কায় ফিরে আসেন।[]

মক্কায় জীবন

[সম্পাদনা]

যখন কুসাই প্রাপ্তবয়স্ক হন, তখন বানু খুজা'আ গোত্রের প্রধান হুলাইল ইবন হুবশিয়্যাহ কাবা শরিফের তত্ত্বাবধায়ক ও অভিভাবক ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই কুসাই হুলাইলের কন্যা হুব্বার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে এক সংঘর্ষের পর সালিসির মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে, এবং হুলাইল মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি কাবার চাবি হুব্বার হাতে তুলে দেন। হুলাইল তার নিজের সন্তানদের চেয়ে কুসাইকেই উত্তরসূরি হিসেবে পছন্দ করেছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছামাফিক কুসাই কাবার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব লাভ করেন।

এরপর কুসাই তার কুরাইশ আত্মীয়দের মক্কার উপত্যকায় পবিত্র স্থান সংলগ্ন এলাকায় বসবাসের জন্য ডেকে আনেন। তিনি তাঁর ভাই যুহরা, চাচা তাইম ইবন মুররাহ, অন্য এক চাচার পুত্র মাখযুম ইবন ইয়াকযা এবং আরও কিছু আত্মীয় যেমন জুমাহ ও সহম—যারা তুলনামূলকভাবে দূর সম্পর্কীয়—তাদের সেখানে স্থাপন করেন।[] এইসব পরিবার ও তাদের বংশধরদের কুরাইশ আল-বিতাহ বলা হতো, অর্থাৎ "উপত্যকার কুরাইশ", যাদের বসতি ছিল কাবার আশেপাশে। অপরদিকে দূরবর্তী আত্মীয়রা আশেপাশের পাহাড়ি অঞ্চলের উপত্যকায় ও গ্রামাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। তারা পরিচিত ছিল কুরাইশ আয-যাওয়াহির নামে, অর্থাৎ "প্রান্তিক কুরাইশ"।[]

কুসাই একজন রাজা হিসেবে শাসন পরিচালনা করতেন। তিনি কাবা পুনর্নির্মাণ করেন, যা তখন ক্ষয়প্রাপ্ত অবস্থায় ছিল। তিনি আরবদের কাবার চারপাশে ঘর নির্মাণে উৎসাহিত করেন। কুসাই আরব উপদ্বীপে প্রথম "শুরা ভবন" বা সভাগৃহ নির্মাণ করেন, যা পরিচিত ছিল ‘আসাবার ঘর’ নামে। বিভিন্ন গোত্রের নেতারা এখানে একত্র হয়ে সামাজিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। কুসাই এমন আইন প্রণয়ন করেন, যার মাধ্যমে হজ পালনকারীদের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ নিশ্চিত করা হতো—এ খরচ জনগণের প্রদত্ত কর দ্বারা নির্বাহিত হতো। এছাড়া তিনি তীর্থযাত্রীদের সেবাযত্ন, কাবা দেখাশোনা, যুদ্ধবিগ্রহ, এবং মক্কায় বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো দায়িত্ব বিভিন্ন জনের মধ্যে ভাগ করে দেন।[]

পুত্রগণ

[সম্পাদনা]

কুসাইয়ের বহু পুত্র ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন—আবদ (যিনি ফাতিমা বিনত আমর-এর মাতৃনৈক বংশের প্রপিতামহ), আবদ আল-দার ইবন কুসাই, আবদ মানাফ ইবন কুসাই এবং আবদ আল-উজ্জা ইবন কুসাই[] কুসাইয়ের বংশধারায় একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রতিটি প্রজন্মে এমন একজন পুরুষ থাকতেন যিনি সকলের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতিমান ও মর্যাদাসম্পন্ন হতেন। কুসাইয়ের চার পুত্রের মধ্যে আবদ মানাফ তার জীবদ্দশাতেই সম্মান লাভ করেছিলেন। তবে কুসাই তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদ আল-দারকেই বেশি পছন্দ করতেন, যদিও তিনি ছিলেন সকলের মধ্যে সবচেয়ে অযোগ্য। অন্যদিকে, দ্বিতীয় পুত্র আবদ মানাফকে তিনি সম্মান ও মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। মৃত্যুর কিছু আগে কুসাই তাঁর সমস্ত অধিকার, ক্ষমতা এবং 'সভা ভবনের' মালিকানা আবদ মানাফের হাতে হস্তান্তর করেন।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Ibn IshaqThe Life of Muhammad। পৃষ্ঠা 3। 
  2. Lings, Martin (১৯৮৩)। Muhammad: His Life Based on the Earliest SourcesGeorge Allen & Unwin। পৃষ্ঠা 6। আইএসবিএন 0946621330 
  3. Ibn Hisham। The Life of the Prophet Muhammad1। পৃষ্ঠা 181। 
  4. Maqsood, Ruqaiyyah Waris। "The Prophet's Line Family No 3 – Qusayy, Hubbah, and Banu Nadr to Quraysh"। Ruqaiyyah Waris Maqsood Dawah। ৩০ মে ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ জুলাই ২০১৩ 
  5. Armstrong, Karen (২০০১)। Muhammad: A Biography of the Prophet। Phoenix। পৃষ্ঠা 66। আইএসবিএন 0946621330 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]