কনস্টান্টিনোপলের তৃতীয় পরিষদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কনস্টান্টিনোপলের তৃতীয় কাউন্সিল, (পূর্ব অর্থোডক্স এবং ক্যাথলিক চার্চ সেইসাথে কিছু অন্যান্য পশ্চিমী চার্চের কাছে ষষ্ঠ ইকুমেনিকাল কাউন্সিল[১]), ৬৮০-৬৮১ সালে অনুষ্ঠিত হয়। এতে একশক্তিবাদ এবং একেষণাবাদকে ধর্মদ্রোহিতা ঘোষণা করে যীশু খ্রিস্টকে দুটি বিধায়ক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়; আর তা হলো শক্তি এবং দুটি ইচ্ছা (ঐশ্বরিক এবং মানব)।[২]

পটভূমি[সম্পাদনা]

পরিষদে এক সেট ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের নিষ্পত্তি করা হয় যা ষষ্ঠ শতাব্দীতে শুরু হয়ে সম্রাট হেরাক্লিয়াস (শা. 610–641) এবং কনস্ট্যানস ২য় (শা. 641–668) এর আমল পর্যন্ত গড়ায়। হেরাক্লিয়াস পারস্যদের কাছে হারানো তার সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ পুনরুদ্ধার করার জন্য যাত্রা করেন এবং একপ্রকৃতিবাদের বিতর্ক মিটানোর চেষ্টা করেন, যা বিশেষত সিরিয়া ও মিশরে শক্তিশালী ছিল। একটি মধ্যপন্থী ধর্মতাত্ত্বিক মাওকেফ প্রস্তাব করেন, যা ইতিহাসে অন্যগুলোর মতো ভাল সমর্থন পায়। ফলস্বরূপ, আবির্ভাব ঘটে প্রথম একশক্তিবাদের। অর্থাৎ খ্রিস্ট, যদিও দুটি প্রকৃতিতে (ঐশ্বরিক এবং মানব) বিদ্যমান ছিলেন, কিন্তু মূলত তিনি ছিলেন একটি শক্তি। দ্বিতীয় ফলাফল ছিল একেষণাবাদের উদ্ভব, এমত অনুযায়ী খ্রিস্টের একটি ইচ্ছা ছিল (অর্থাৎ, মনুষ্য ও ঐশ্বরিক ইরাদার মধ্যে খ্রিস্টের কোনো বিরোধ ছিল না)। এই মতবাদ বেশিরভাগ বাইজেন্টাইন বিশ্বে গৃহীত হয়, কিন্তু জেরুজালেম এবং রোম এর বিরোধিতা করে এবং একটি বিতর্ক শুরু হয়ে যায়, যা পুনরুদ্ধার করা প্রদেশগুলি হারানোর পরেও এবং হেরাক্লিয়াসের মৃত্যুর পরেও অব্যাহত ছিল। হেরাক্লিয়াসের নাতি দ্বিতীয় কনস্ট্যানস যখন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন, তখন তিনি এই বিতর্কটিকে সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি মনে করেন এবং মতবাদের পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলা নিষিদ্ধ করে বাকবিতণ্ডা থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেন[৩] পোপ প্রথম মার্টিন এবং সন্ন্যাসী ম্যাক্সিমাস, একেষণাবাদের প্রধান বিরোধী ছিলেন। তারা একে ব্যাখ্যা করেন খ্রিস্টের প্রতি মানুষের ইচ্ছার অনুষদকে অস্বীকার হিসাবে। ৬৪৯ সালে রোমে একটি সিনডের আয়োজন করেন তারা। সেখানে একশক্তিবাদ এবং একেষণাবাদের দণ্ডাজ্ঞা করা হয়।[৪] প্রায় ৬৫৩ সালের দিকে, কনস্টান্টিনোপলে, কতেক ধর্মবিদ, পোপকে, বিপ্লব সমর্থন করার জন্য অভিযুক্ত করেন। ইহা উচ্চ রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসাবে বিবেচিত হয় এবং মার্টিনকে সেই অনুযায়ী গ্রেপ্তার করে বিচার করা হয়। এরপর দণ্ডাজ্ঞা দিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হয়, সেখানে তিনি অবিলম্বেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। মার্টিন এবং ম্যাক্সিমাসের দৃষ্টিভঙ্গী কনস্টান্টিনোপলের পরিষদের অনেকের কাছে সমর্থিত ছিল।[৫][৬]

প্রস্তুতি[সম্পাদনা]

কনস্টানসের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী, চতুর্থ কনস্টানটিন ৬৭৮ সালে কনস্টান্টিনোপলের মুসলিম অবরোধ কাটিয়ে উঠার পর, অবিলম্বে রোমের সাথে যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করার জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি স্থাপন করেন: তিনি পোপ ডোনাসকে এই বিষয়ে একটি সম্মেলনের পরামর্শ দিয়ে চিঠি লিখেন। চিঠিটি যখন রোমে পৌঁছায়, পোপ ডোনাস তখন মারা যায়, কিন্তু তার উত্তরাধিকারী, পোপ আগাথো, সম্রাটের পরামর্শে সম্মত হন এবং পশ্চিম জুড়ে কাউন্সিলের আদেশ দেন, যাতে লেগেটরা পশ্চিমী চার্চের ঐতিহ্য প্রদর্শন করতে পারে। আর্চবিশপ মৌসুয়েটাসের অধীনে মিলানে একটি সিনড সংগঠিত হয়; ৬৮০ সালে হ্যাটফিল্ডে আরেকটি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ থিওডোর সভাপতিত্ব করেন। পোপ আগাথো তখন ৬৮০-এর পুনরুত্থান পার্বণের আঞ্চলিক সিনোডের প্রতিনিধিদের নিয়ে রোমে একটি ধর্মসভা আহ্বান করেন।

তারপর তিনি কনস্টান্টিনোপলে প্রাচ্যীয়দের সাথে সাক্ষাত করার জন্য একটি প্রতিনিধি দল পাঠান।[৭] প্রতিনিধিরা দুটি চিঠি নিয়ে যাত্রা করেন, একটি পোপ আগাথো থেকে সম্রাটের কাছে এবং অন্যটি রোম সিনডের বিশপের কাছ থেকে কনস্টান্টিনোপলে সমবেতদের কাছে।[৮]

ইতিমধ্যে, কনস্টানটিন কনস্টান্টিনোপলের পাদ্রি প্রথম জর্জ এবং তার অধিক্ষেত্রের সমস্ত বিশপদের একটি পরিষদে ডেকে পাঠান। তিনি অ্যান্টিওকের পাদ্রি ম্যাকারিয়াসকেও ডেকে পাঠান, যিনি একজন বাইজেন্টাইন- নিযুক্ত কনস্টান্টিনোপলে স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন, কারণ তার চৌহদ্দি মুসলিমগণ দখল করে নেয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

কার্যধারা[সম্পাদনা]

৭ নভেম্বর, ৬৮০ সালে, মাত্র ৩৭ জন বিশপ এবং সামান্য সংখ্যক প্রেসবিটার ইম্পেরিয়াল প্রাসাদে, ট্রুলাস নামে পরিচিত গম্বুজবিশিষ্ট হলটিতে সমবেত হন। কনস্টান্টিনোপল এবং অ্যান্টিওকের পাদ্রিগণ ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যেখানে আলেকজান্দ্রিয়া এবং জেরুজালেমের পাদ্রিগণদের প্রতিনিধিত্ব করেন বাইজেন্টাইন-নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ, কারণ সারাসেন মুসলিম বিজয়ের কারণে এই তারিখে এই দুটি চৌহদ্দির মধ্যে কোনও পাদ্রিই ছিল না। কয়েকজন পুরোহিত এবং বিশপ, পোপ এবং রোমে অনুষ্ঠিত তার পরিষদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, যেটা পূর্বের সার্বজনীন পরিষদে স্বাভাবিক ছিল। পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে, পরিষদটি একটি সার্বজনীন পরিষদের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। সম্রাট প্রথম এগারোটি অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন এবং সভাপতিত্ব করেন, আলোচনায় অংশ নেন এবং ১৬ সেপ্টেম্বর ৬৮১ তারিখে সমাপনী অধিবেশনে আবার ফিরে আসেন, সে অধিবেশনে ১৫১ জন বিশপ উপস্থিত ছিলেন। [৯]

পরিষদ চলাকালীন, পোপ আগাথো'র একটি চিঠি পাঠ করা হয়, তাতে চার্চের সেই ঐতিহ্যগত বিশ্বাসের উপর জোর দেওয়া ছিল যে, খ্রিস্ট ছিলেন দুইটি ইচ্ছার অধিকারী, ঐশ্বরিক এবং মনুষ্য। উপস্থিত বেশিরভাগ বিশপই, চিঠিটি গ্রহণ করেন, এবং ঘোষণা করেন যে প্রেরিত পিতর যেন আগাথোর মাধ্যমেই কথা বলছেন,[১০] যদিও এই পারিষদিকগণ অন্য এক ঐতিহাসিক পোপকে অ্যানাথেমা হিসাবে ঘোষণা করেন। অ্যান্টিওকের ম্যাকারিয়াস একেষণাবাদের পক্ষে মুনাযেরা করেন্ম কিন্তু তার পক্ষপাতিদের সাথে তাকে দণ্ডাজ্ঞা ও পদচ্যুত করা হয়। পরিষদ, আগাথোর চিঠির সাথে মিল রেখে, সংজ্ঞায়িত করে যে, যীশু খ্রিস্টের দুটি শক্তি এবং দুটি ইচ্ছা ছিল কিন্তু মনুষ্য ইচ্ছাটি ছিল 'তাঁর ঐশ্বরিক এবং সর্বশক্তিমান ইচ্ছার অধীন'। পরিষদে অতিসাবধানে ম্যাক্সিমাস কনফেসারের উল্লেখ এড়িয়ে যায়, যাকে তখনও সন্দেহের চোখে দেখা হত। একশক্তিবাদএকেষণাবাদ উভয়কেই ধর্মদ্রোহী বলে রুলিং দেওয়া হয় এবং যারা এই ধর্মদ্রোহিতাকে সমর্থন করেছিল তাদেরকে এই বিচারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে পোপ প্রথম অনারিয়াস এবং কনস্টান্টিনোপলের পূর্ববর্তী চারজন পাদ্রিও ছিলেন।[১১] পরিষদ শেষ হলে, ডিক্রিগুলো রোমে পাঠানো হয়। সেখানে আগাথোর উত্তরসূরি পোপ লিও দ্বিতীয় একে গ্রহণ করেন।[১০] কাউন্সিলের রায় নিশ্চিতকরণ চিঠিতে, পোপ লিও পোপ অনারিয়াসকে "অপবিত্র বিশ্বাসঘাতকতা"র জন্য অভিযুক্ত করেছেন, ...যিনি প্রেরিতীয় ঐতিহ্যের শিক্ষা দিয়ে এই প্রেরিতীয় চার্চকে পবিত্র করার মোটেও চেষ্টা করেননি।"[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

কাউন্সিলের কার্যক্রম চলাকালীন এক পর্যায়ে, একজন একেষণাবাদী পুরোহিত দাবি করেন যে, তিনি মৃতদের জীবিত করতে পারেন, তাই তার বিশ্বাস সর্বোচ্চ প্রমাণিত। তার দাবী সত্যতা যাচাই করার জন্য, একটি মৃতদেহ আনা হয়। কিন্তু তিনি, ফিসফিস করে কিছু প্রার্থনা করেও দেহটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন নি![১২]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Continuity and Change in Creed and Confessions, Credo: Historical and Theological Guide to Creeds and Confessions of Faith, ed. Jaroslav Pelikan (Yale University Press, 2013), 15.
  2. George Ostrogorsky, History of the Byzantine State (Rutgers University Press, 1995), 127.
  3. The Acts of the Council of Chalcedon, Volume 1, transl. Richard Price and Michael Gaddis (Liverpool University Press, 2005), 55.
  4. Tylenda, Joseph N. (২০০৩)। Saints and Feasts of the Liturgical Year। Georgetown University Press। পৃষ্ঠা 60আইএসবিএন 0-87840-399-X 
  5. Ekonomou, Andrew J. (২০০৭)। Byzantine Rome and the Greek Popes: Eastern influences on Rome and the papacy from Gregory the Great to Zacharias, A.D. 590–752.। Lexington Books। আইএসবিএন 978-0-7391-1977-8 
  6. Siecienski 2010
  7. Joseph Brusher, S.J., Popes Through the Ages ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখে.
  8. Hefele, Karl Joseph von. A History of the Councils of the Church, T. & T. Clark, 1896, §313
  9. George Ostrogorsky, History of the Byzantine State (Rutgers University Press, 1995), 127.
  10. Joseph Brusher, S.J., Popes Through the Ages ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখে.
  11. George Ostrogorsky, History of the Byzantine State (Rutgers University Press, 1995), 127.
  12. Kelly, Joseph F. "Chapter Three: The Byzantine Councils." The Ecumenical Councils of the Catholic Church: A History. Collegeville, MN: Liturgical, 2009. 59. Print.

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]