আভির উপজাতি
প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে আভির উপজাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। ইরিথ্রিয়ান সাগরের পেরিপ্লাস- অঞ্চলে বসবাসকারী একই নামের এক ঐতিহাসিক জনজাতির উল্লেখ রয়েছে। মনে করা হয় তারা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের আক্রমণের পরে পূর্ব ইরান থেকে এদেশে এসেছিলেন। তাদের প্রধান ঘাঁটি ছিল সিন্ধু ব-দ্বীপ (আধুনিক সিন্ধু এবং কাঠিয়াওয়াড় )। প্রাচীন শাস্ত্রে তাদের দেশকে "আবিরিয়া" এবং "আবেরিয়া" হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আধুনিক হরিয়ানায় আভিরদের অন্যান্য কিছু সম্প্রদায় -এর বসবাস ছিল বলে জানা গেছে।
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]ব্যুৎপত্তিগতভাবে, যিনি দশ দিকে ত্রাস সৃষ্টি করেন তাকে আভির নামে অভিহিত করা হয়।[১][স্পষ্টকরণ প্রয়োজন]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]সুনীল কুমার ভট্টাচার্যের বক্তব্য অনুযায়ী, এরিথ্রিয়ান সাগরের পেরিপ্লাস গ্রন্থে আভিরদের প্রথম শতাব্দীর শাস্ত্রীয় পুরাকীর্তি -এর উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি আভিরদের উপজাতি হিসাবে উল্লেখ করার পরিবর্তে একটি জাতি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।[২] রমাপ্রসাদ চন্দের মতো পণ্ডিতরা বিশ্বাস করেন যে আভিররা ইন্দো-আর্য জাতি -এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৩] কিন্তু অন্য ইতিহাসবিদরা, যেমন রোমিলা থাপার, বিশ্বাস করেন যে তারা আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত।[৪] পুরাণ -এ উল্লিখিত আভিররা হেরাতের অঞ্চল দখল করেছিল বলে জানা যায়। তারা আফগানিস্তানের জনগণ কালাতোয়াক এবং হরিতদের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত।[৫]
জয়ন্ত গড়করির মতে বৃষনি, অন্ধক, সাতভাত এবং আভিরের মতো উপজাতিরা দীর্ঘ দ্বন্দ্বের পর যাদব নামে পরিচিত হয়।[৬]
পদ্ম-পুরাণ এবং কিছু সাহিত্যকর্মে আভিরদের ভগবান কৃষ্ণের বংশ্ধর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৭]
আভিরদের পেশাগত মর্যাদা সম্পর্কে কোনও নিশ্চিত তথ্য নেই, প্রাচীন গ্রন্থে কখনও কখনও তাদের যোদ্ধা, কখনও যাজক এবং গোপালক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অন্য সময়ে লুণ্ঠনকারী উপজাতি হিসাবেও এদের উল্লেখ করা হয়েছে।[৮]
বৃষ্ণি, সত্ত্ব এবং যাদবদের পাশাপাশি আভিররা বেদের অনুসারী ছিলেন। তারা উপজাতির প্রধান ও গুরু হিসাবে ভগবান কৃষ্ণের উপাসনা করতেন।[৭][৯]
প্রত্নতাত্ত্বিক শিলালিপিতে আভিরদের ভগবান কৃষ্ণের বংশধর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৭][১০] কে পি জয়সওয়ালের মতে গুজরাটের আভিররা, সম্রাট অশোকের রাস্ট্রিক এবং মহাভারতের যাদবরা একই জাতির অন্তর্ভুক্ত।[১১][১২]
কোঙ্কণে শাসন
[সম্পাদনা]২০৩ থেকে ২৭০ সাল পর্যন্ত আভিররা দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চল শাসন করেছিল। আভিররা ছিল সাতবাহনদের অবিলম্ব উত্তরসূরি।[১৩]
নেপালি শাখা
[সম্পাদনা]১২ শতকের আগে, একটি আহির রাজবংশ বর্তমান নেপালের কিছু অঞ্চল শাসন করেছিল।[১৪] গোপালরাজবংশাবলী অনুসারে, প্রাচীন গোপাল রাজবংশের বংশতালিকা ১৩৮০ সালের দিকে সংকলিত করা হয়েছিল। নেপালের নামকরণ করা হয়েছে নেপা নামক একজন গোপালকের নাম থেকে যিনি আভিরদের নেপালি শাখার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়।[১৫]
আধুনিক আহিরদের সাথে সংযোগ
[সম্পাদনা]গঙ্গা রাম গর্গের মতে, আধুনিক দিনের আহির জাতি আভিরদের বংশধর এবং আহির শব্দটি সংস্কৃত শব্দ অভির -এর প্রাকৃত রূপ।[৭] ভট্টাচার্য বলেছেন যে আহির, আহর এবং গাওলি শব্দগুলি আভির শব্দের বর্তমান রূপ।[২]
এমএসএ রাও এবং ইতিহাসবিদ যেমন পিএম চান্দরকর এবং টি. পদ্মজা ব্যাখ্যা করেছেন যে প্রাচীন আভির এবং যাদব উপজাতিরা যে আহিরদের সমতুল্য তার অনেক লিখিত এবং ঐতিহাসিক প্রমাণ বিদ্যমান।[১৬][১৭][১৮]
হিন্দু ধর্মের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব
[সম্পাদনা]আভির উপজাতির সাথে প্রধান দুই হিন্দু দেবীর যোগসূত্র আছে বলে জানা যায়।
দেবী গায়ত্রী বৈদিক স্তোত্র ও গায়ত্রী মন্ত্রের মূর্ত রূপ বলে চিহ্নিত।[১৯] মধ্যযুগীয় সংস্কৃত গ্রন্থ পদ্মপুরাণ অনুসারে, ঝড়ের দেবতা ইন্দ্র ব্রহ্মাকে একটি যজ্ঞে সাহায্য করার জন্য একজন আভির উপজাতির কন্যা গায়ত্রীকে পুষ্করে নিয়ে এসেছিলেন। পরে তিনি ব্রহ্মার দ্বিতীয় সহধর্মিণী হন।[২০][২১][২২]
ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দ ১৯১৬ সালে যুক্তি দিয়েছিলেন যে দেবী দুর্গা আসলে " হিমালয় এবং বিন্ধ্যের বাসিন্দাদের দ্বারা পুজিত এক পাহাড়ী দেবীর সমন্বিত রূপ থেকে উদ্ভূত। অনুমান করা হয় এই দেবী ছিলেন আভিরদের এক পূজিত দেবী যিনি যুদ্ধ-দেবী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তার সাথে অধুনা পূজিত দেবী দুর্গার গভীর যোগসূত্র দেখা যায়।[২৩]
গুপ্ত সাম্রাজ্যের আভির উপজাতি
[সম্পাদনা]সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে (আনুমানিক ৩৫০ খ্রী), আভিররা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে রাজপুতানা এবং মালাভাতে বাস করত। ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন তাদের আদি বাসস্থান ছিল হেরাত এবং কান্দাহারের মধ্যবর্তি অভিরাবন এলাকা, যদিও এই ধারনাটি বিতর্কিত।[২৪] পরবর্তী সময়ে তাদের রাজস্থান দখলের কথাও সম্বত ৯১৬ সালের উল্লিখিত যোধপুর শিলালিপি থেকে জানা যায়। সেই শিলালিপিতে উল্লিখিত আছে যে এলাকার আভির জনগণদের আচরন ছিল হিংসাত্মক। তারা তাদের প্রতিবেশীদের কাছে সন্ত্রাসী হিসাবে পরিচিত ছিল।[২৪] রাজপুতানায় আভিররা বলিষ্ঠ এবং ম্লেচ্ছ হিসেবে বিবেচিত হত এবং তারা ব্রাহ্মণ্য বিরোধী কার্যকলাপ পরিচালনা করত।
পারগিটার নামক জনৈক ব্যাক্তি পৌরাণিক আখ্যার দিকে ইঙ্গিত করেন, যেখান উল্লেখ করা আছে যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর বৃষ্ণি ও অন্ধকগণ দ্বারকা ও গুজরাট থেকে উত্তর দিকে যাত্রা করেছিলেন। যাত্রাপথে তারা রাজস্থানের অভদ্র আভিরদের দ্বারা আক্রান্ত হন।[২৫]
আভিররা শুধু রাজস্থানে সীমাবদ্ধ ছিলেননা; তাদের কিছু গোষ্ঠী দক্ষিণ ও পশ্চিমে সরে গিয়ে সৌরাষ্ট্র ও মহারাষ্ট্রে পৌঁছেছিল এবং সাতবাহন রাজবংশ ও পশ্চিম ত্রাপদের অধীনে জীবিকা গ্রহন করে সেখানে বসবাস শুরু করেছিল।[২৬] এছাড়াও মারাঠা দেশের উত্তরাঞ্চলে তারা একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং এই তথ্যের প্রমান হিসাবে সেই অঞ্চলে রাজা ঈশ্বরসেনের নবম বছরের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে।[২৭][২৮]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Soni, Lok Nath (২০০০)। The Cattle and Stick। Anthropological Survey of India। পৃষ্ঠা 14। আইএসবিএন 9788185579573।
- ↑ ক খ Bhattacharya, Sunil Kumar (১৯৯৬)। Krishna — Cult in Indian Art। M.D. Publications। পৃষ্ঠা 126। আইএসবিএন 9788175330016।
- ↑ Chanda, Ramaprasad (১৯৬৯)। The Indo-Aryan races: a study of the origin of Indo-Aryan people and institutions। Indian Studies: Past & Present। পৃষ্ঠা 55।
- ↑ Thapar, Romila (১৯৭৮)। Ancient Indian Social History: Some Interpretations। Orient Blackswan। পৃষ্ঠা 149। আইএসবিএন 978-81-250-0808-8।
- ↑ Miśra, Sudāmā (১৯৭৩)। Janapada state in ancient India। Bhāratīya Vidyā Prakāśana।
- ↑ Jayant GadKari (১৯৯১)। Society and Religion। Gopson Papers। পৃষ্ঠা 184। আইএসবিএন 9788171547432।
- ↑ ক খ গ ঘ Garg, Dr Ganga Ram (১৯৯২)। Encyclopaedia of Hindu world। Concept Publishing। পৃষ্ঠা 113। আইএসবিএন 9788170223740।
- ↑ Malik, Aditya (১৯৯০)। "The Puskara Mahatmya: A Short Report"। The History of Sacred Places in India As Reflected in Traditional Literature। BRILL and the International Association of Sanskrit Studies। পৃষ্ঠা 200। আইএসবিএন 9789004093188।
- ↑ Radhakrishnan, S. (২০০৭)। Identity And Ethos। Orient Paperbacks। পৃষ্ঠা 31–32। আইএসবিএন 978-8-12220-455-1।
- ↑ T, Padmaja (২০০২)। Ay velirs and Krsna। University of Mysore। পৃষ্ঠা 34। আইএসবিএন 9788170173984।
- ↑ Mularaja solanki (১৯৪৩)। "The Glory that was Gūrjaradeśa, Volume 1"। History। Bharathiya Vidya Bhavan। পৃষ্ঠা 30।
- ↑ K P Jayaswal (১৯৪৩)। "Hindu Polity"। History। Bangalore Print। পৃষ্ঠা 141।
- ↑ Numismatic Society of India (১৯৯১)। The Journal of the Numismatic Society of India। the University of Michigan। পৃষ্ঠা 91–95।
- ↑ Yadav, Punam (২০১৬)। Social Transformation in Post-conflict Nepal: A Gender Perspective। Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 57। আইএসবিএন 978-1-317-35389-8।
- ↑ Malla, Kamal P. (১৯৮৩)। Nepāla: Archaeology of the Word (পিডিএফ)। The Nepal Heritage Society Souvenir for PATA Conference। পৃষ্ঠা 33–39। ২২ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ মে ২০১১।
- ↑ Guha, Sumit (২০০৬)। Environment and Ethnicity in India, 1200–1991। University of Cambridge। পৃষ্ঠা 47। আইএসবিএন 978-0-521-02870-7।
- ↑ Rao, M. S. A. (১৯৭৮)। Social Movements in India। Manohar। পৃষ্ঠা 124, 197, 210।
- ↑ T., Padmaja (২০০১)। Temples of Kr̥ṣṇa in South India: History, Art, and Traditions in Tamilnāḍu। Archaeology Dept., University of Mysore। পৃষ্ঠা 25, 34। আইএসবিএন 978-8-170-17398-4।
- ↑ Bradley, R. Hertel; Cynthia, Ann Humes (১৯৯৩)। Living Banaras: Hindu Religion in Cultural Context। SUNY Press। পৃষ্ঠা 286। আইএসবিএন 9780791413319। ২০২০-১০-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-২০।
- ↑ Nambiar, K. Damodaran (১৯৭৯)। Nārada Purāṇa, a Critical Study। All-India Kashiraj Trust, 1979। পৃষ্ঠা 145।
- ↑ Wadia, Sophia (১৯৬৯)। The Aryan Path (ইংরেজি ভাষায়)। Theosophy Company (India), Limited।
- ↑ Arya, Sharda (১৯৮৮)। Religion and Philosophy of the Padma-purāṇa (ইংরেজি ভাষায়)। Nag Publishers। আইএসবিএন 978-81-7081-190-9।
- ↑ Aiyar, Indira S. (১৯৯৭)। Durga As Mahisasuramardini। Gyan Publishing House, 1997। পৃষ্ঠা 217। আইএসবিএন 9788121205108।
- ↑ ক খ Sharma, Tej Ram (১৯৮৯)। A political history of the imperial Guptas: from Gupta to Skandagupta। Concept Publishing Company। পৃষ্ঠা 87। আইএসবিএন 978-81-7022-251-4।
- ↑ Jain, Kailash Chand (১৯৭২)। Ancient cities and towns of Rajasthan: a study of culture and civilization। Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 9788120806696।
- ↑ Haryana: studies in history and culture। Kurukshetra University। ১৯৬৮। পৃষ্ঠা 44।
- ↑ Bhattacharya, Sunil Kumar (১৯৯৬)। Krishna-cult in Indian art। M.D. Publications Pvt. Ltd.। পৃষ্ঠা 10। আইএসবিএন 978-81-7533-001-6।
- ↑ Majumdar, Ramesh Chandra; Altekar, Anant Sadashiv (১৯৬৭)। Vakataka – Gupta Age Circa 200–550 AD। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 143। আইএসবিএন 978-81-208-0026-7।