আকারমাত্রিক স্বরলিপি
আকারমাত্রিক স্বরলিপি বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি সঙ্গীত লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতি।
এই পদ্ধতির স্বরলিপিতে আ-কার (-া)-এর মত চিহ্ন ব্যবহার করে তালের মাত্রা চিহ্নিত করা হয় এবং এ কারণেই এই পদ্ধতির নাম আকারমাত্রিক। এই পদ্ধতিতে সাতটি শুদ্ধ স্বর এবং পাঁচটি বিকৃত স্বর মিলিয়ে মোট বারোটি স্বর লিখিত হয় আ-কার সহযোগে।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]ভারতে আকারমাত্রিক স্বরলিপি উদ্ভাবন করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পরবর্তীকালে তার অনুজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই পদ্ধতির উন্নয়ন করেন।
স্বরসমূহ
[সম্পাদনা]আকারমাত্রিক স্বরলিপিতে মধ্য বা মুদারা সপ্তকের বা গ্রামের ৭ টি শুদ্ধ স্বরকে স, র, গ, ম, প, ধ, ন দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
কোমল র-কে ঋ, কোমল গ-কে জ্ঞ, কড়ি বা তীব্র ম-কে হ্ম, কোমল ধ-কে দ এবং কোমল ন-কে ণ লেখা হয়। উদারা বা নিম্ন বা খাদ সপ্তকের স্বরের নিচে () হসন্ত এবং তারা বা উচ্চ সপ্তকের স্বরের উপরে () রেফ্ চিহ্ন দেওয়া হয়।
এছাড়া, অতিকোমল ও অণুকোমল স্বরকে প্রকাশ করার ব্যবস্থা রয়েছে।
নাম | অবস্থান | স্বর | . | নাম | অবস্থান | স্বর |
---|---|---|---|---|---|---|
অতিকোমল র | স ও ঋ -এর মধ্যবর্তী | ঋ১ | . | অণুকোমল র | ঋ ও র -এর মধ্যবর্তী | ঋ২ |
অতিকোমল গ | র ও জ্ঞ -এর মধ্যবর্তী | জ্ঞ১ | . | অণুকোমল গ | জ্ঞ ও ম -এর মধ্যবর্তী | জ্ঞ২ |
অতিকোমল ধ | প ও দ -এর মধ্যবর্তী | দ ১ | . | অণুকোমল ধ | দ ও ধ -এর মধ্যবর্তী | দ ২ |
অতিকোমল ন | ধ ও ণ -এর মধ্যবর্তী | ণ ১ | . | অণুকোমল ন | ণ ও ন -এর মধ্যবর্তী | ণ ২ |
মাত্রা
[সম্পাদনা]আকার চিহ্ন (-া) দ্বারা ১ মাত্রা প্রকাশ করা হয়। যেমন, সা = ১ মাত্রা, সা -া= ২ মাত্রা, সা -া -া= ৩ মাত্রা। যদি একাধিক স্বর যুক্ত করে শেষে আকার দেওয়া হয়, তাহলে সবকটি স্বর একসঙ্গে এক মাত্রায় উচ্চারিত হবে। যেমন
- সরা = ১ মাত্রায় ২ টি স্বর স এবং র, প্রতিটি ১/২ বা অর্ধমাত্রা করে;
- সরগা = ১ মাত্রায় ৩ টি স্বর, প্রতিটি ১/৩ বা এক তৃতীয়াংশ মাত্রা করে।
বিসর্গ চিহ্ন (ঃ) অর্ধ (১/২ ) মাত্রা এবং শুন্য বা গোল চিহ্ন (০) দ্বারা সিকি (১/৪) মাত্রা বোঝানো হয়। যেমন
- সঃ = ১/২ মাত্রা,
- সাঃ = ১১/২ মাত্রা,
- সঃ রঃ = ১ মাত্রা,
- সাঃ রঃ = ২ মাত্রা,
- সরগাঃ = ১১/২ মাত্রা, প্রতিটি স্বর ১/২ করে;
- স০ = ১/৪ মাত্রা।
বিরাম আর মাত্রার চিহ্ন একই। যদি মাত্রার চিহ্নের সামনে কোন অক্ষর বা হাইফেন (-) না থাকে, তাহলে সেই সময়টুকুতে স্বর অনুপস্থিত থাকে।
বিশেষ স্বরগোষ্ঠী
[সম্পাদনা]যখন কোন স্বর আরেকটি স্বরকে সামান্য স্পর্শ করেই উচ্চারিত হয় যখন সেই স্পর্শস্বর -কে প্রধান স্বরের সামনে সামান্য উঁচু করে লেখা হয়। যেমন নস। আর যদি মূল স্বরের শেষে প্রধান স্বর সামান্য ভাবে উচ্চারিত হয় তখন স্পর্শস্বরকে প্রধান স্বরের পরে উঁচুতে লেখা হয়। যেমন সন।
একটি স্বর যখন আরেকটি স্বরে বিশেষভাবে গড়িয়ে যায় সেই দুই স্বরে নিচে অর্ধচন্দ্রাকার মীড় চিহ্ন বসে। যেমন—মা ͜ ণা
তাল ও অন্যান্য বিভাগ
[সম্পাদনা]প্রত্যেকটি তাল আবর্তের শেষে একটি স্তম্ভ (𝐈) বসে। তালের মধ্যের বিভাগ বাপর্ব বোঝানোর জন্য দাঁড়ি (|) বসানো হয় তাল-বিভাগের শেষ স্বরের পরে। তাল-বিভাগের প্রথম স্বরের উপরে ১, ২, ৩, ৪, ০ সংখ্যা দ্বারা তালাঙ্ক বা তাল-বিভাগের ক্রম বোঝানো হয়। যেমন শূন্য চিহ্ন দ্বারা (০) খালি বা ফাঁক বোঝানো হয়। তালাঙ্কের উপর () রেফ্ চিহ্ন থাকলে ওই বিভাগকে সম্ ধরা হয়। যেমন—
১ | ২ | ৩ | ০ | ||||||||
পা | ধা | | | ণা | র্সা | | | ণা | ধা | | | পা | পা | |
রা | খো | | | র | ঙ্গ০ | | | ও | ত্রি | | | ভ | ঙ্গ |
তৃতীয় লাইনে গানের বোল বা কথা লেখা রয়েছে।
প্রত্যেক কলি-র শুরুতে ও শেষে যুগল স্তম্ভ (𝐈𝐈) বসে। তবে আস্থায়ী এবং বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে[২] কলির শুরুর যুগল স্তম্ভের আগেও কিছু স্বর থাকে। গৎ বা গীতের সব শেষে জোড়া যুগল স্তম্ভ (𝐈𝐈 𝐈𝐈) বসে। তবে অনেক ক্ষেত্রে যুগল স্তম্ভের বদলে যুগল দাঁড়ি (||)-ও দেখা যায়[৩]। যুগল স্তম্ভ বা জোড়া যুগল স্তম্ভ—দুই ক্ষেত্রেই কলি শেষ হওয়ার পর পুনরায় আস্থায়ী-তে ফিরে আস্থায়ী-র যেখানে যুগল স্তম্ভ (𝐈𝐈) রয়েছে সেখান থেকে গান চালিয়ে যাওয়া হয়। আস্থায়ীর যুগল স্তম্ভের (𝐈𝐈) আগে গানের যে অংশটি থাকে সেটি এক বারই গাওয়া হয়। ঐ রকম ক্ষেত্রে প্রত্যেক কলির শেষে উক্তি বা উদ্ধৃতি চিহ্ন (“ ”)-এর মধ্যে অস্থায়ীর পূর্ববর্তী অংশটির কথা পুনরাবৃত্তি করা থাকে। স্থায়ী, অন্তরা ও সঞ্চারী গাওয়ার পর স্থায়ীতে ফেরা হয়, তাই ওদের কলির শেষে যুগল স্তম্ভ থাকে। কিন্তু ‘আভোগ’ গাওয়ার পর স্থায়ীতে ফেরা হয় না, তাই আভোগ কলির শেষে যুগল স্তম্ভ থাকে না।[৪]
কোনো স্বরের উপরে যুগল দাঁড়ি () থাকলে, সেখান থেকে অন্য কলি আরম্ভ করতে হবে।
পুনরাবৃত্তি
[সম্পাদনা]গুম্ফ বন্ধনী ({ })-এর মধ্যের অংশকে দুইবার গাওয়া হয়। ওই অংশের মধ্যে যদি বক্র বন্ধনী (( ))-বেষ্টিত অংশ থাকে তাহলে দ্বিতীয়বার গাওয়ার সময় ওই বক্র বন্ধনীর অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়। যেমন—
- {সরা (গমা) পা} গমা
এই অংশটি দ্বিতীয়বার গাওয়ার সময় সরা পা গমা করে গাওয়া হয়।
কোন অংশ পুনরাবৃত্তির সময় যদি কোন স্বর পরিবর্তনের দরকার হয় তখন পরিবর্তিত স্বর, যা পুনরাবৃত্তির সময় উচ্চারিত হবে, পূর্বব্যবহৃত স্বরের উপরে লেখা হয়। পরিবর্ত্তিত স্বরগুলি ([ ]) সরল বন্ধনীর মধ্যে রাখা হয়। যেমন—
[সা | -রা] | ||||||
𝐈𝐈 | রা | -া | গা | গা | | | মা | -ধা |
নি | ০ | শী | থ | রা | ০ |
কলির শেষে যুগল স্তম্ভ বা গানের শেষে জোড়া যুগল স্তম্ভের মাঝে ([]) বন্ধনী থাকলে, অর্থাৎ 𝐈[]𝐈 বা 𝐈𝐈[]𝐈𝐈বুঝে নিতে হয় আস্থায়ীতে ফিরে পরিবর্তিত স্বর গাইতে হবে।
হাইফেন
[সম্পাদনা]স্বরের নিচে গানের অক্ষর না থাকলে স্বর বা স্বরগোষ্টীর বামে হাইফেন (-) বা কসি বসে এবং গানের পঙক্তিতে শূন্য (০) বসে। স্বরের নিচের গানের অক্ষর স্বরান্ত না হলেও স্বর বা স্বরগোষ্টীর বামে হাইফেন বসে। যেমন—
সা | -া | সা | -রা | -গা | -মা |
মা | ০ | গা | ০ | ০ | ন্ |