অ্যান্টার্কটিকায় বসতি স্থাপন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অ্যান্টার্কটিক চুক্তি ব্যবস্থা অনুসারে অ্যান্টার্কটিকার ভূখণ্ডে বিভিন্ন দেশের দাবীসমূহ:
  দাবিদারহীন

অ্যান্টার্কটিকায় বসতি স্থাপন বলতে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে সপরিবারে স্থায়ী মানব বসতি গড়ার কথা বোঝানো হয়না। বর্তমানে শুধু কিছুসংখ্যক বিজ্ঞানী ও গবেষক অস্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করেন। অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর একমাত্র মহাদেশ যেখানে কোন আদিবাসী বাসিন্দা নেই। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৭০ টি ঘাঁটিতে (৪০ টি সারা বছর জুড়ে ও ৩০ টি শুধু গ্রীষ্মকালে) ৩০ টি দেশের বিজ্ঞানী ও কর্মচারী বসবাস করেন। অ্যান্টার্কটিকার আনুমানিক জনসংখ্যা গ্রীষ্মকালে ৪০০০ ও শীতকালে ১০০০ জন। এ পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকায় অন্তত ১১ বার টিবশিশু জন্মগ্রহণের দৃষ্টান্ত রয়েছে, ৮ টি (প্রথমটি সহ) আর্জেন্টিনার এসপেরাঞ্জ়া ঘাঁটিতে এবং ৩ টি চিলির প্রেসিদেন্তে এদুয়ার্দো ফ্রেই মন্তাল্ভা ঘাঁটিতে

অতীতে বসতি স্থাপনের জল্পনা[সম্পাদনা]

১৯৫০ এর দশকে একটি সাধারণ ধারণা ছিল কাচের গম্বুজের মাঝে আবদ্ধ নগরের মাধ্যমে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে বসতি গড়ে তোলা সম্ভব। বাহ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নগরে শক্তির উৎস এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের উপায় হবে। অ্যান্টার্কটিকার ৬ মাস ব্যাপী রাতের বেলায় গম্বুজের কেন্দ্রীয় মিনারে একটি শক্তিশালী আলোর উৎস একটি কৃত্রিম সূর্য হিসেবে কাজ করবে বলে প্রস্তাবিত হয়েছিল। এই দৃশ্যকল্পে অ্যান্টার্কটিকার সাথে বহির্বিশ্বে নিয়মিত বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অ্যান্টার্কটিকার হিম আচ্ছাদন খনন করে খনিজ সম্পদ আহরণের শহর স্থাপন করার কথাও ভাবা হয়; তবে, শক্তি এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকার সংশ্লিষ্ট সমস্যা আছে। ম্যাকমার্ডো কেন্দ্রের পারমাণবিক চুল্লীটি পরিবেশ দূষণের উৎস হয়ে ওঠায় অনেক আগেই তা বন্ধ করে দেয়া হয়।[১] অ্যান্টার্কটিক চুক্তি ব্যবস্থা, যা ধারাবাহিক কিছু আন্তর্জাতিক চুক্তির সমষ্টি, তা অনুসারে বর্তমানে এন্টার্কটিকায় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এটি পরিবর্তন বা পরিত্যক্ত হলে তবেই বৈধভাবে অ্যান্টার্কটিকায় বড় মাপের বসতি স্থাপন করা যাবে। অপরপক্ষে, অ্যান্টার্কটিকায় স্থায়ী বসতি স্থাপনের অসাধ্যতাই এই ভূখণ্ডের সকল দাবীর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থতার কারণ।[২]

গম্বুজ নগর[সম্পাদনা]

ভূমিতিক গম্বুজের বিকাশ সাধনকারী স্থপতি বাকমিন্‌স্টার ফুলার, অ্যান্টার্কটিকায় গম্বুজ নগর তৈরির সম্ভাবনা উত্থাপন করেন যার মাঝে নিয়ন্ত্রিত জলবায়ুতে স্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।[৩] ১৯৬৫ সালে গম্বুজ নগর নির্মাণের উপর তার প্রথম প্রকাশিত নির্দিষ্ট প্রস্তাবনায় তিনি অ্যান্টার্কটিকাকে এমন একটি প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রথম স্থান হিসেবে আলোচনা করেন।[৪] আমুন্ডসেন-স্কট কুমেরু কেন্দ্রের দ্বিতীয় ঘাঁটিটি (১৯৭৫-২০০৩ পর্যন্ত পরিচালিত) তার এই ধারণাটির একটি ক্ষুদ্রতর সংস্করণ; এটি শুধুমাত্র কয়েকটি বৈজ্ঞানিক ভবন আবৃত করার মত বড়। ১৯৭১ সালে জর্মন স্থপতি ফ্রেই ওটোর নেতৃত্বে একটি দল ২ কিমি চওড়া ও ৪০,০০০ বাসিন্দা ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট, বায়ু-অবলম্বিত নগর গম্বুজ তৈরির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে।[৫] কিছু গবেষক সম্প্রতি ধারণাটি হালনাগাদ করার চেষ্টা করেছেন।[৬]

বিদ্যুৎ উৎপাদন[সম্পাদনা]

অস্ট্রেলীয় মসন স্টেশন এর পেছনে ডেভিড পর্বতমালা। স্টেশনের কয়েকটি বায়ুকল ছবিতে দৃশ্যমান।

অ্যান্টার্কটিকায় গ্রীষ্মকালীন ৬ মাস মেরুদিবস হওয়ার কারণে এ সময়ে সৌরশক্তি ব্যবহার করে নীরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অ্যান্টার্কটিকায় সৌর প্যানেল ব্যবহার করে জাপানের শৌওয়া স্টেশন, ব্রিটিশ রথেরা গবেষণা কেন্দ্র[৭] ও রুমানীয় লাও-রাকোভিৎস স্টেশনে[৮] গ্রীষ্মকালীন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। শীতকালীন ৬ মাস মেরুরাত্রির সময়ে সৌর বিকিরণের অনুপস্থিতিতে প্রধানত বায়ুশক্তি ব্যবহার করে, এবং ভূ-তাপীয় শক্তি ব্যবহার করে বছর জুড়ে অ্যান্টার্কটিকায় নির্ভরযোগ্যতার সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সকল মহাদেশের মধ্যে অ্যান্টার্কটিকায় বায়ুপ্রবাহের গড় গতি সর্বাধিক[৯] এবং শীতল নিম্নপ্রবাহী বায়ু এ মহাদেশে খুব সাধারণ ঘটনা হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বায়ুশক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত শীতকালে নিম্নপ্রবাহী বায়ুর গতিবেগ সর্বোচ্চ হয়ে থাকে, যার ফলে সৌর বিকিরণের অনুপস্থিতি জনিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব[৭]। দমকা বা ঝটিকা বায়ুপ্রবাহের জন্য অণুভূমিক অক্ষ বায়ুকলের চাইতে উল্লম্ব অক্ষ বায়ুকল বেশি কর্মদক্ষ হওয়ায়[১০] এ ধরনের বায়ুকল অ্যান্টার্কটিকার জন্য বেশ উপযোগী। এছাড়াও উল্লম্ব অক্ষ বায়ুকল অপেক্ষাকৃত দৃঢ় গঠনসম্পন্ন এবং অধিকাংশ যন্ত্রাদি ভূমির কাছে হওয়ায় মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ অপেক্ষাকৃত সহজ, যা অ্যান্টার্কটিকার মত বৈরী পরিবেশে সুবিধাজনক। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মসন স্টেশন, দক্ষিণ আফ্রিকার সানায়ে ৪ গবেষণা কেন্দ্রে বায়ুকলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। মসন স্টেশনের বিদ্যুৎ চাহিদার ৭০% এরও বেশি বায়ুশক্তির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও রস দ্বীপে অবস্থিত বায়ু খামার থেকে স্কট ঘাঁটিম্যাকমার্ডো স্টেশনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে[৭]। অ্যান্টার্কটিক মূল ভূখণ্ড এবং পারিপার্শ্বিক দ্বীপগুলোতে অনেক সংখ্যক সক্রিয় ও সুপ্ত আগ্নেয়গিরি থাকায় ভূ-তাপীয় শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। স্কট ঘাঁটি হতে ৪০ কিমি দূরে অবস্থিত সক্রিয় আগ্নেয়গিরি এরেবাস পর্বতের নিকটে ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছে। ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্রগুলো সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে শীতল করার পর বিপরীত আস্রবণের মাধ্যমে স্কট ঘাঁটিতে ব্যবহারের জন্য পানিও পাওয়া সম্ভব হবে[৭]। ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে এ পর্যন্ত কোন প্রকল্প না নেয়া হলেও, ভবিষ্যতে এ ধরনের উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর বিদ্যুৎ ও পানির সুলভ উৎসের কারণে এরেবাস পর্বতের নিকটবর্তী অঞ্চল মানব বসতি স্থাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ভবিষ্যত অবস্থা[সম্পাদনা]

যদিও অ্যান্টার্কটিকার বর্তমান পরিবেশে স্থায়ী মানব বসতি সার্থকভাবে সম্ভব করে তোলা খুব কষ্টকর, অবস্থার ভবিষ্যতে উন্নয়ন ঘটতে পারে। প্রস্তাবিত হয়েছে যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের ফলে, ২২শ শতাব্দীর শুরুতে পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার জলবায়ুর অবস্থা অনেকটা আলাস্কা, আইসল্যান্ড ও উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বর্তমান জলবায়ুর মত হবে।[১১] এমনকি অ্যান্টার্কটিকার সবচেয়ে উত্তুরে এলাকায়, যেমন অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপের পশ্চিমাংসে তখন চাষাবাদ ও ফসল ফলানোও সম্ভব হতে পারে।

অ্যান্টার্কটিকায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম মানবশিশু[সম্পাদনা]

এমিলিও মার্কোস পালমা (জন্ম জানুয়ারি ৭, ১৯৭৮) অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রথম মানুষ। তিনি একজন আর্জেন্টাইন নাগরিক, যিনি অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপের এসপেরাঞ্জ়া ঘাঁটির ফরতীন সার্জেন্তো কাবরাল এ জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তার ওজন ছিল ৩.৪ কেজি (৭ পা ৮ আউন্স)। তার পিতা, ক্যাপ্টেন জর্জ এমিলিও পালমা উক্ত ঘাঁটিতে কর্মরত আর্জেন্টাইন সামরিক সদস্যদের নেতা ছিলেন।[১২]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Elzinga, Aant (1993). "Antarctica: The Construction of a Continent by and For Science". In Elisabeth Crawford, Terry Shinn, & Sverker Sörlin (Eds.), Denationalizing Science: The Contexts of International Scientific Practice, pp. 73-106. Dordrecht: Kluwer.
  2. Joyner, Christopher C. (1992). Antarctica and the Law of the Sea, p. 49. Martinus Nijhoff Publishers. আইএসবিএন ০-৭৯২৩-১৮২৩-৪.
  3. Marks, Robert W. (Aug. 23, 1959). "The Breakthrough of Buckminster Fuller". The New York Times, pp. SM14, SM15, SM42, SM44.
  4. Fuller, Buckminster (Sep. 26, 1965). "The Case for Domed Cities ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে". St. Louis Post-Dispatch.
  5. Walker, Derek (1998). Happold: The Confidence to Build, p. 63. Taylor & Francis. আইএসবিএন ০-৪১৯-২৪০৭০-৫.
  6. Alexander Bolonkin and Cathcart, Richard B. (May 2007). "Inflatable ‘Evergreen’ dome settlements for Earth’s Polar Regions". Clean Technologies and Environmental Policy 9 (2), 125–132[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ].
  7. Nicole Calder-Steele। "Electricity in Isolation: the progress of power generation in Antarctica" (পিডিএফ)। Government of the United States। ২২ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ January 2013  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  8. Romanian Embassy in Canberra। "Celebrating 8 years since the inauguration of Law – Racoviţă - Negoiţă Scientific Research Station in Antarctica"। Embassy of Romania to the Commonwealth of Australia। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ 
  9. National Satellite, Data, and Information Service। "National Geophysical Data Center"। Government of the United States। ১৩ জুন ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুন ২০০৬ 
  10. Windpower Engineering & Development (১০ নভেম্বর ২০০৯)। "Vertical Axis Wind Turbines vs Horizontal Axis Wind Turbines" 
  11. How to survive the coming century, NewScientist [১].
  12. "Life found under S Pole ice shelf"। The Times। ১০ জানুয়ারি ১৯৭৮।