অর্থনৈতিক গণতন্ত্র

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

অর্থনৈতিক গণতন্ত্র (গণতান্ত্রিক অর্থনীতি নামেও পরিচিত[১][২]) হলো একটি আর্থসামাজিক দর্শন যেখানে মালিকানা স্থানান্তরিত করা[৩][৪][৫] এবং বাণিজ্যিক অংশীদার ও বাণিজ্যিক পরিচালকদের (যেমন একটি পরিচালনা পর্ষদ) থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সর্বজনীন অংশীজনদের একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীকে (যেমন: শ্রমিক, ভোক্তা, সরবরাহকারী, সম্প্রদায় এবং বৃহত্তর জনসাধারণ) প্রদান করা হয়। এই ব্যবস্থায় একটি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব পুঁজিবাদীদের বা অংশীজনদের হাতে না রেখে সম্পূর্ণ শ্রমিক ও এর উৎপাদনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের হাতে থাকে এবং এ তত্ত্বে বিশ্বাস করা হয় যে, ভোক্তা ও অন্যান্য সুবিধাভোগীদের ব্যক্তিদের মতো, অংশীজনদেরও শুধুমাত্র পরোক্ষ কর্তৃত্ব থাকা উচিত।[৬] অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ব্যবহারিকভাবে দাবি করে যে, এর মাধ্যমে পুঁজিবাদের কার্যকর চাহিদার বাইরের কার্যক্রমের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করা যেতে পারে।[৭]

অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারা সাধারণত যুক্তি দেন যে আধুনিক পুঁজিবাদ পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে, যা কার্যকর চাহিদার অভাবের কারণে ঘটে থাকে; কারণ এমন পরিস্থিতিতে জনগণ তার নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করার জন্য যথেষ্ট আয় উপার্জন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। সাধারণ সম্পদের কর্পোরেট একচেটিয়াতা সাধারণত কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে, যার ফলে আর্থ-সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। ফলে শ্রমিকরা অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এবং ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।[৮] অর্থনৈতিক গণতন্ত্রকে বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক মতাদর্শের একটি স্বতন্ত্র তত্ত্ব এবং বিভিন্ন সংস্কারের সমষ্টি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক গণতন্ত্র বাজার ও বাজারের বাইরে, উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়। একটি সংস্কার হিসাবে, সমর্থনকারী তত্ত্ব এবং বাস্তব-বিশ্বের উদাহরণগুলির মধ্যে বিকেন্দ্রীকরণ, গণতান্ত্রিক সমবায়, পাবলিক ব্যাংকিং, ন্যায্য বাণিজ্য এবং খাদ্য উৎপাদন ও মুদ্রার আঞ্চলিককরণ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

কার্যকর চাহিদার ঘাটতি[সম্পাদনা]

অনেক বিশ্লেষকের মতে, কার্যকর চাহিদার ঘাটতি হলো সবচেয়ে মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা। অর্থাৎ, আধুনিক সমাজের মানুষ নিজেদের প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করার জন্য যথেষ্ট আয় উপার্জন করে না। উদাহরণ স্বরূপ, অর্থনৈতিক ভূগোলবিদ ডেভিড হার্ভে দাবি করেন, "শ্রমিকরা তাদের মজুরি কার্যকর চাহিদার উৎসে ব্যয় করে, কিন্তু মোট মজুরি বিল সর্বদা প্রচলিত মোট মূলধনের চেয়ে কম হয়ে থাকে (অন্যথায় কোন লাভ হবে না)। তাই দৈনন্দিন জীবনকে টিকিয়ে রাখতে মজুরি পণ্য ক্রয় মোট উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক বিক্রয়ের জন্য কখনই যথেষ্ট নয়"। [৭]

যেকোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জর্জিস্ট বা জর্জীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে, "সম্পদ"-এর মধ্যে মানুষের আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি এবং বিনিময় মূল্যের জন্য শ্রম দ্বারা উৎপাদিত সমস্ত বস্তুগত জিনিস অন্তর্ভুক্ত। ভূমি, শ্রম ও পুঁজি সাধারণত সম্পদ উৎপাদনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। "ভূমি" বা "জমি" মালিকানায় সব প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত। শ্রমের মধ্যে সমস্ত মানুষের পরিশ্রমসম্পন্ন কাজ অন্তর্ভুক্ত। পুঁজি আরও সম্পদ উৎপাদনের জন্য নিবেদিত সম্পদের অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেকোন ব্যক্তির আয় ভূমি, শ্রম ও পুঁজি এই তিনটি উৎসের সংমিশ্রণে হতে পারে। এই উৎসগুলো সাধারণত সম্পদের উৎপাদন এবং বন্টনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পারস্পরিক একক কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়। হেনরি জর্জের মতে: "মানুষ সর্বনিম্ন পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের ইচ্ছা পূরণ করতে চায়"। [৮] মানুষ প্রকৃতির সাথে মিথস্ক্রিয়া করে পণ্য এবং পরিষেবাগুলি তৈরি করে, যা অন্য আরেকজন মানুষের প্রয়োজনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই সত্ত্বাগুলির মধ্যে সম্পর্কগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন আইন এবং রীতিনীতিগুলি একটি প্রদত্ত সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন করে।

পর্যায়ক্রমে, ডেভিড শোয়েকার্ট তার বই, আফটার ক্যাপিটালিজম- এ দাবি করেছেন: "পুঁজিবাদী সমাজের কাঠামো তিনটি মৌলিক উপাদান নিয়ে গঠিত:

  • "উৎপাদনের মাধ্যমগুলির বেশিরভাগই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। এটি কখনো কখনো সরাসরি ব্যক্তিদের দ্বারা আর কখনো কখনো (ব্যক্তি মালিকানাধীন) কর্পোরেশনগুলির দ্বারা পরিচালিত হয়।
  • "পণ্যসমূহ একটি বাজারে বিনিময় করা হয় -- অর্থাৎ, পণ্য ও পরিষেবাগুলির বেশিরভাগ অংশ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্ধারিত দামে কেনা ও বিক্রি করা হয় এবং সরকারী মূল্য নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ এটি নিয়ন্ত্রণ করে না৷ ব্যক্তি মালিকানাধীন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তাদের পণ্য এবং পরিষেবা প্রদানের জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে এবং প্রতিটি উদ্যোগে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে। এই প্রতিযোগিতাই দামের প্রাথমিক নির্ধারক।
  • "এই সমাজে যারা বেতনের জন্য কাজ করে তাদের বেশিরভাগই অন্য লোকেদের জন্য কাজ করে, যারা হলো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক। অধিকাংশ শ্রমজীবী ​​মানুষ 'মজুরি শ্রমিক' হিসেবে কাজ করে"।[৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Democracy Economy"Democracy Collaborative। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০২৩ 
  2. "The Democratic Economy"New Economics Foundation। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০২৩ 
  3. "What is Economic Democracy?"bcdi। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মে ২০২৩ 
  4. Schweickart, David। "Economic Democracy: An Ethically Desirable Socialism That Is Economically Viable"The Next System। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মে ২০২৩ 
  5. Malleson, Tom (২০১৪)। "Economic democracy in the 21st Century"Open Democracy। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০২৩ 
  6. Smith 2005
  7. Harvey 2010, পৃ. 107।
  8. George 1912
  9. Schweickart 2002, পৃ. 22–23।