অমলা এবং কমলা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অমলা এবং কমলা
জন্মআনু. ১৯১২
আনু. ১৯১৮
মৃত্যু২১শে সেপ্টেম্বর ১৯২১
১৪ই নভেম্বর ১৯২৯
জাতীয়তাভারতীয়

অমলা ( আনু. ১৯১৮ – ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯২১[১] ) এবং কমলা ( আনু. ১৯১২ – ১৪ই নভেম্বর ১৯২৯) ভারতের বঙ্গের (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) মেদিনীপুরের দুটি "বন্য মেয়ে" ছিল, যাদের একটি নেকড়ে পরিবার বড় করেছে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

তাদের গল্প মূলধারার যথেষ্ট মনোযোগ এবং বিতর্ক আকর্ষণ করেছিল। যাইহোক, এই ঘটনাটি শুধুমাত্র একটি উৎস থেকেই বর্ণনা করা হয়েছিল এবং প্রচার করা হয়েছিল, যে এক পাদ্রী দাবি করেছেন যে তিনি মেয়েদের আবিষ্কার করেছেন। এই কারণে, গল্পটির সত্যতা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। ফরাসি সার্জন সার্জ অ্যারোলস তাঁর ২০০৭ সালের বই নেকড়ে-শিশুদের প্রহেলিকা (ফরাসি: L'Enigme des enfants-loup) -তে উপসংহারে পৌঁছেছেন যে গল্পটি একটি প্রতারণা।

চেহারা[সম্পাদনা]

১৯২৬ সালে, স্থানীয় অনাথ আশ্রম-এর রেক্টর জোসেফ অমৃত লাল সিং, কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি বিবরণ প্রকাশ করেন যে এই দুটি মেয়ে তাঁকে জেলার গোদামুরি গ্রামের কাছে জঙ্গলে বসবাসকারী এক ব্যক্তি দিয়েছিল। গোদামুরি গ্রাম কলকাতার পশ্চিমে মেদিনীপুরের একটি অঞ্চল। যখন তিনি মেয়েদের প্রথম দেখেন, তারা তখন বাড়ির কাছে এক ধরণের খাঁচার মধ্যে থাকত।[২] পরে, তিনি দাবি করেন যে তিনি নিজেই ১৯২০ সালের ৯ই অক্টোবর নেকড়েদের আস্তানা থেকে মেয়েদের উদ্ধার করেছিলেন। তিনি শিশুদের নামকরণ করেন এবং প্রায় দশ বছর ধরে একটি "ডায়েরিতে" (আলগা পাতায় লেখা, কিছু তারিখ দেওয়া এবং কিছু তারিখবিহীন) তাঁর পর্যবেক্ষণগুলি লিখেছিলেন। এটি সঠিক হলে, বলা যেত এটি বন্য শিশুদের পর্যবেক্ষণ এবং পুনর্বাসনের জন্য সেরা নথিভুক্ত প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে একটি। ডায়েরির ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবরের একটি লিখনে বলা হয়েছে, "...মা নেকড়ের প্রকৃতি এত হিংস্র এবং স্নেহ এত মহৎ ছিল। এটি আমাকে আশ্চর্য চকিত করেছিল। আমি এই ভেবে বিস্মিত হয়েছিলাম যে একটি প্রাণীর এমন মহৎ অনুভূতি আছে যা মানবজাতির চেয়েও বেশি ... এই অদ্ভুত প্রাণীদের প্রতি একজন স্নেহময় ও আদর্শ মায়ের সমস্ত ভালবাসা ও স্নেহ প্রদান করা।" কমলার বয়স তখন প্রায় আট বছর, অমলার প্রায় ১৮ মাস।

আচরণ এবং চিকিৎসা[সম্পাদনা]

অমৃত লাল সিং তাঁর ডায়েরিতে দাবি করেছেন যে, অনাথ আশ্রমে, দুটি মেয়ে নেকড়ে-সদৃশ আচরণ দেখিয়েছিল, যা বন্য শিশুদের জন্য স্বভাবিক। তারা পোশাক পরাতে দেবে না, যারা তাদের খাওয়ানোর চেষ্টা করত তাদের আঁচড়াবে এবং কামড় দেবে, রান্না করা খাবার প্রত্যাখ্যান করত এবং চার হাতে পায়ে হাঁটত। দুটি মেয়েই চার হাতে পায়ে হাঁটার ফলে তাদের হাতের তালু এবং হাঁটুতে পুরু কড়া তৈরি হয়েছিল। মেয়েরা বেশিরভাগই নিশাচর ছিল, সূর্যের আলো সহ্য করতে পারত না ছিল এবং অন্ধকারে খুব ভালোভাবে দেখতে পেত। তাদের গন্ধের অনুভূতি তীব্র ছিল এবং শোনার ক্ষমতাও প্রবল ছিল।

মেয়েরা কাঁচা মাংসের স্বাদ উপভোগ করত এবং মাটিতে একটি বাটি থেকে খেত। তারা ঠাণ্ডা এবং তাপের প্রতি অসংবেদনশীল বলে মনে হয়েছিল এবং ভয় ছাড়া তারা কোন ধরনের মানবিক আবেগ দেখায়নি। রাতে তারা নেকড়েদের মতো চিৎকার করত, তাদের "পরিবার" কে ডাকত। তারা কথা বলেনি।

ইউনিটি লেখক ইমেল্ডা অক্টাভিয়া শ্যাঙ্কলিন তাঁর ১৯২৯ সালের বই, হোয়াট আর ইউ? -তে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন, তিনি লিখেছেন "আমি একবার একজন ধর্মপ্রচারককে এশিয়ার নেকড়েদের গুহা থেকে উদ্ধার করা দুটি মেয়েকে দেখার কথা বলতে শুনেছিলাম। শিশু অবস্থাতেই তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছিল এবং রোমুলাস ও রেমাসের অল্পবয়সী জীবনের মতো, একটি নেকড়ে মা তাদের দেখাশোনা করত। শিশুদুটি চার হাতে পায়ে ছুটত; তারা তাদের বন্দিকারীদের দাঁত খিঁচিয়ে গরগর করল এবং কামড়ে দিল। তাদের কপাল চাপা ছিল, মুখের নিচের অংশ সামনের দিকে প্রসারিত ছিল। তাদের মধ্যে তাদের জন্তু পালক- মাতার আদল বেশি ছিল, যে মা তাদের মানব মায়ের চেয়ে বেশি মাতৃ ভালবাসা দেখিয়েছিল।"[৩]

অমৃত লাল সিং দাবি করেছেন যে তিনি তাদের সাধারণ মানবিক আচরণ শেখানোর চেষ্টা করার কঠিন কাজটি নিয়েছিলেন। অমলা ১৯২১ সালে কিডনি সংক্রমণে মারা যান। তাকে মেদিনীপুরের সেন্ট জনস চার্চের কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।[৪] কমলা তার মৃত্যুতে শোক-এর লক্ষণ দেখিয়েছিল। এর পর কমলার সান্নিধ্যে আসা সহজ হয়েছিল। সে শেষ পর্যন্ত আংশিকভাবে মনুষ্য সমাজ জীবনে প্রশিক্ষিত হয়েছিল এবং অন্যান্য মানুষের সাথে ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছিল। বহু বছর কঠোর পরিশ্রমের পর, সে কিছুটা সোজা হয়ে হাঁটতে সক্ষম হয়, যদিও কখনোই দক্ষতার সাথে দাঁড়াত না এবং যখন তার দ্রুত কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হত তখন প্রায়শই সে চার হাতে পায়ে চলায় ফিরে যেত। সে কয়েকটি শব্দ বলতে শিখেছিল। সে ১৯২৯ সালে যক্ষ্মা রোগে মারা যায়।

বিতর্ক[সম্পাদনা]

অনেকগুলি ভিন্ন বর্ণনার মধ্যে, অমৃত লাল সিং ব্যতীত অন্য কোনো সাক্ষীই সেগুলির সত্যতা সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেন নি, গল্পের সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। নেকড়েদের দ্বারা বেড়ে ওঠার "শ্রুতিকথা" হল একটি প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ধারণা (দেখুন: বন্য শিশু ), যা দিয়ে জন্মগত ত্রুটিযুক্ত পরিত্যক্ত শিশুদের পশু-সদৃশ আচরণের ব্যাখ্যা করা হয়।

সাম্প্রতিক গবেষণা[সম্পাদনা]

ফরাসী সার্জন সার্জ অ্যারোলেস-এর মতে, অমলা এবং কমলার ঘটনাটি হিংস্র শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কলঙ্কজনক প্রতারণা। তাঁর নেকড়ে-শিশুদের প্রহেলিকা (ফরাসি: L'Enigme des enfants-loup) বইতে অ্যারোলস তাঁর এই ঘটনা নিয়ে গবেষণার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি সংরক্ষণাগার এবং পূর্বে অজানা উৎসগুলি পরীক্ষা করে উপসংহারে এসেছিলেন:

  • অমৃত লাল সিং যে মূল ডায়েরিটিতে "দুটি নেকড়ে-মেয়েদের জীবনে দিনের পর দিন" লিখেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন তা মিথ্যা। এটি ভারতে ১৯৩৫ সালের পরে লেখা হয়েছিল, যা হলো কমলার মৃত্যুর ছয় বছর পরে। (মূল পাণ্ডুলিপিটি ওয়াশিংটন, ডিসির ইউএস লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের পাণ্ডুলিপি বিভাগে রাখা হয়েছে)।
  • যে ছবিতে দুটি নেকড়ে-মেয়ে চার হাতে পায়ে হাঁটছে, কাঁচা মাংস খাচ্ছে এবং অন্যদের দেখা যাচ্ছে, সেটি ১৯৩৭ সালে তোলা হয়েছিল, তখন দুজন মেয়েরই মৃত্যু ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে ছবিতে যারা আছে তারা হলো মেদিনীপুরের দুটি মেয়ে, যারা সিংয়ের অনুরোধে অঙ্গভঙ্গি করছে।
  • অনাথ আশ্রমের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকের মতে, কমলার মধ্যে অমৃত লাল সিং দ্বারা উদ্ভাবিত কোনও অসঙ্গতি ছিল না, যেমন খুব তীক্ষ্ণ এবং লম্বা দাঁত, হস্ত এবং পদের স্থিরসন্ধির সাথে চার হাতে পায়ে চলা, রাতে তার চোখ থেকে তীব্র নীল আভা নির্গমনের সাথে নিশাচর দৃষ্টি ইত্যাদি।[৫]
  • ১৯৫১ - ১৯৫২ সালে সংগৃহীত বেশ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য অনুসারে,[৬] অমৃত লাল সিং কমলাকে মারধর করতেন যাতে সে দর্শকদের সামনে আদেশ মতো অভিনয় করে।
  • অ্যারোলেসের কাছে অমৃত লাল সিং এবং অধ্যাপক রবার্ট এম. জিংগের মধ্যে লেখা চিঠি রয়েছে বলে জানা যায়। সেখানে জিংগ এই গল্পের আর্থিক দিকের প্রতি তাঁর বিশ্বাস প্রকাশ করেন এবং এর প্রকাশনায় সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করেন। সিংয়ের ডায়েরি প্রকাশের পর, জিংগ সিংকে ৫০০ মার্কিন ডলারের রয়্যালটি প্রদান করেন। অমৃত লাল সিংয়ের অনাথ আশ্রম চালু রাখার জন্য অর্থের নিদারুণ প্রয়োজন ছিল।[৭]
  • রবার্ট এম. জিংগ বলেছেন তিনি মেয়েদের সম্পর্কে অমৃত লাল সিংয়ের কথাকেই সত্য বলে মনে করে নিয়েছিলেন। তিনি অমৃত লাল সিংয়ের সাথে উলফ-চিলড্রেন অ্যাণ্ড ফেরাল ম্যান বইটির সহলেখক, বইটি নৃতত্ত্ববিদদের কাছ থেকে ব্যাপক সমালোচনা পেয়েছিল, সমালোচকদের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্টভাষী ছিলেন অ্যাশলে মন্টাগু। অমৃত লাল সিংয়ের বক্তব্যের সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য রবার্ট এম. জিংগকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল এবং এই বিতর্কের ফলস্বরূপ তাঁকে ১৯৪২ সালে ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর একাডেমিক পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। কেলেঙ্কারির পর তিনি আর পড়াননি।[৮]
  • কমলা একটি স্নায়বিক বিকাশমূলক ব্যাধি, রেট সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিল।

জাপান এবং ফ্রান্সের পণ্ডিতরা পরে সার্জ অ্যারোলেস-এর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন।[৯]

সংস্কৃতিতে সূত্র[সম্পাদনা]

  • ভানু কপিলের বই "হিউম্যানিমাল, এ প্রজেক্ট ফর ফিউচার চিলড্রেন" অমলা এবং কমলার উপর ব্যাপকভাবে ফোকাস করে এবং রেভারেণ্ড সিংয়ের মধ্যস্থতা থেকে তাদের গল্প পুনরুদ্ধার করে।
  • জেন ইয়োলেনের বই, চিলড্রেন অফ দ্য উলফ, তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের জন্য গল্পের একটি কাল্পনিক বিবরণ।
  • জেন ইয়োলেন এবং হেইডি ইওয়াই স্টেম্পলের বই, হিস্ট্রি মিস্ট্রি: দ্য উলফ গার্লস, এই গল্প সম্পর্কে ছোটদের একটি নন-ফিকশন বই।
  • লর্ড রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল তাঁর ১৯৪০ সালের বই, কেনিয়ার মোর স্কেচের অধ্যায় ৬-এ গল্পের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন
  • আর্নল্ড গেসেলের বই উলফ চাইল্ড অ্যাণ্ড হিউম্যান চাইল্ডও সিংয়ের বিবরণের উপর নির্ভর ক'রে। এখানে এটি সমালোচনামূলকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Shih, Jun-Hao Rosalyn (২০০৭–২০০৮)। "Daughters of the Wild: The Feral and Human Perspective" (পিডিএফ) (PDF)। 
  2. J. H. Hutton: "Wolf-Children" in Folklore, Transactions of the Folk-Lore Society, vol. 51, nr. 1, pages 9 to 31, William Glaisher Ltd., London, March 1940.
  3. Shanklin, Imelda Octavia. What Are You? (1929) Unity Classic Library 2nd Edition. Unity Village, Missouri: Unity Books, 2004, 16. http://www.truthunity.net/books/imelda-shanklin/what-are-you-5-21
  4. Candland, Douglas K. (১৯৯৫-১০-২৬)। Feral Children and Clever Animals: Reflections on Human Nature (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-535614-4 
  5. The American Journal of Psychology, 1934, p. 149
  6. The Genetic Psychology Monographs, 1959, n°60, pp. 117–193
  7. P. J. Blumenthal: Kaspar Hausers Geschwister – Auf der Suche nach dem wilden Menschen (Deuticke, Vienna/Frankfurt, 2003, আইএসবিএন ৩-২১৬-৩০৬৩২-১)
  8. J. C. Fikes, P.C. Weigand, A.G. Weigand: Huichol Mythology (The University of Arizona Press, 2004, আইএসবিএন ০-৮১৬৫-২৩১৭-৭)
  9. Suzuki, Kotaro; Vauclair, Jacques (২০১৬)। De quelques mythes en psychologie : Enfants-loups, singes parlants et jumeaux fantômes (ফরাসি ভাষায়)। Le Seuil। আইএসবিএন 9782021103663 

সূত্র[সম্পাদনা]

  • John McCrone (১৯৯৪)। "Wolf Children and the Bifold Mind"The Myth of Irrationality: The Science of the Mind from Plato to Star Trek। Carroll & Graf Pub। সংগ্রহের তারিখ ১৮ অক্টোবর ২০০৫ 
  • David Horthersall (২০০৪)। History of Psychology 
  • P. J. Blumenthal: Kaspar Hausers Geschwister – Auf der Suche nach dem wilden Menschen (Deuticke, Vienna/Frankfurt, 2003, আইএসবিএন ৩-২১৬-৩০৬৩২-১)

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]