কীর্তিপুরের যুদ্ধ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কীর্তিপুরের যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: নেপালকে একীভূত করার যুদ্ধ

বাঘ ভৈরব মন্দিরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা এই তলোয়ারগুলো কীর্তিপুরের যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল।
তারিখ১৭৬৭
অবস্থান
ফলাফল গোর্খালিদের বিজয়
বিবাদমান পক্ষ
ললিতপুর রাজ্য গোর্খা রাজ্য
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
ধনুবন্ত
কীর্তি লক্ষ্মী
কালু পাণ্ডে 
সুরপ্রতাপ শাহ
দলমর্দন শাহ
তুলারাম পাণ্ডে
বীরভদ্র থাপা
দলজিৎ শাহ
অভিরাম সিংহ বসনিয়াত
বংশরাজ পাণ্ডে
শক্তি
জানা যায়নি জানা যায়নি
কীর্তিপুরের যুদ্ধ নেপাল-এ অবস্থিত
Gorkha
Gorkha
Kirtipur
Kirtipur
আধুনিক নেপালে গোর্খা ও কীর্তিপুরের অবস্থান।
১৭৯৩ সালে কর্নেল কার্কপ্যাট্রিক নেপালে গিয়ে যুদ্ধের ভুক্তভোগী নাক কেটে ফেলা লোকদের দেখতে পান।
শহরের যেসব সিংহদ্বার দিয়ে গোর্খালিরা কীর্তিপুরে প্রবেশ করেছিল তাদের একটি।
কীর্তিপুরের পিছনে হিমালয় পর্বতমালার অবস্থান।

নেপালের একীভূতকরণের ধারাবাহিকতায় গোর্খা রাজ্য কর্তৃক ১৭৬৭ সালে কীর্তিপুরের যুদ্ধ (নেপালি: कीर्तिपुरको युद्ध) সংঘটিত হয় যা নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকার তৎকালীন কীর্তিপুর রাজ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। কাঠমান্ডু উপত্যকার তিনটি প্রধান শহরের একটি ছিল এই কীর্তিপুর[১][২] প্রাচীরবেষ্টিত কীর্তিপুর ছিল ললিতপুর রাজ্যের একটি অংশ। পাহাড়ি ঢালের শীর্ষদেশ বরাবর বিস্তৃত এই শহরে তখন আটশত বাড়ি ছিল।[৩]

কাঠমান্ডু উপত্যকার নেওয়ার এবং আক্রমণকারী গোর্খালিদের মধ্যে সংঘটিত এই যুদ্ধকে গোর্খালি রাজা পৃথ্বীনারায়ণ শাহের রাজ্য বিস্তারের একটি সন্ধিক্ষণরূপে চিহ্নিত করা হয়। এই যুদ্ধ ঈপ্সিত উপত্যকাটির অবশিষ্ট অংশের উপর শাহের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে[৪][৫] এবং প্রাচীন নেওয়ারদের শাসনের পতন ঘটায়।[৬]

অবরোধ[সম্পাদনা]

কাঠমান্ডু উপত্যকার সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক, শিল্প এবং কৃষি সমৃদ্ধির কারণে গোর্খালিরা এটি নিজেদের অধীনে নিতে চেয়েছিল।[৭] ১৭৩৬ সালে গোর্খালি রাজা নরভূপাল শাহ উপত্যকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত শহর এবং দুর্গ নুয়াকোটের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যাচাই করে দেখার উদ্দেশ্যে এখানে একবার আক্রমণ করেন। পরীক্ষামূলক এই আক্রমণে তার সেনাদলগুলো মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়।[৮]

১৭৪২ সালে তার পুত্র পৃথ্বীনারায়ণ শাহ রাজা হওয়ার পর পুণরায় এই অভিযান শুরু করেন।[৯][১০] শক্তি প্রয়োগ করে কাঠমান্ডুকে যে দখল করা সম্ভব নয় সে ব্যাপারে শাহ নিশ্চিত ছিলেন। একারণে তিনি উপত্যকাটির বাণিজ্য ও সরবরাহ লাইনের শ্বাসরোধের মাধ্যমে একে জব্দ করার পরিকল্পনা করেন। তার বাহিনীগুলো পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের কৌশলগত পথগুলো দখল করে নেয় এবং তিব্বত ও ভারতগামী বাণিজ্যিক যে রুটগুলো সচল ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো অবরুদ্ধ করে ফেলে।[১১]

নুয়াকোট শহরটি ট্রান্স হিমালয় বাণিজ্যিক রুটের মধ্যে পড়ে। একারণে ১৭৪৪ সালে শাহ এটি দখল করে নিলে এর মাধ্যমে নেপালে তার একটি সুদৃঢ় অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়, উপরন্তু এটি তাকে নেপাল ও তিব্বতের মধ্যে চলমান বাণিজ্যকে বন্ধ করারও সুযোগ এনে দেয়।[১২] গোর্খালিরা ১৭৬২ সালে কাঠমান্ডু উপত্যকাকে পশ্চিম দিক থেকে ঘিরে থাকা মকওয়ানপুরগড়ীতে এবং ১৭৬৩ সালে এই উপত্যকাকে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘিরে থাকা ধুলিখেলে ছড়িয়ে পড়ে।[১৩]

দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কাঠমান্ডু উপত্যকায় যাতে কোন প্রকার খাদ্যশস্য প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য শাহ বাঁধার সৃষ্টি করেন। জরুরী মালবাহী দ্রুতগামী যানবাহনগুলোকে (Blockade runner) এ সময় গাছে (?) ঝুলিয়ে দেওয়া হতো।[১৪] দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের কারণে কাঠমান্ডুর রাজা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করতে বাধ্য হন। উপত্যকার অবরুদ্ধ বাসিন্দাদের উদ্ধারের নিমিত্তে ক্যাপ্টেন জর্জ কিনলক ১৭৬৭ সালের আগস্টে একটি ব্রিটিশ সেনাদলকে উপত্যকার দিকে প্রেরণ করেন।[১৫] তিনি কাঠমান্ডুর ৭৫ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যান এবং সিন্ধুলী ও হরিহরপুরের দুর্গগুলো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। কিন্তু পথিমধ্যে গোর্খালিরা তাদের আক্রমণ করে।[১৬] এ অবস্থায় রসদ সরবরাহ ফুরিয়ে গেলে এবং তার সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বসলে তার দলকে বেতিয়ায় পিছু হটতে হয়।[১৭][১৮]

প্রথম আক্রমণ[সম্পাদনা]

গোর্খালিরা উপত্যকাটির পশ্চিম প্রান্তের দহচোক পাহাড়ে একটি ঘাঁটি স্থাপন করেছিল, এখান থেকেই তারা কীর্তিপুরে তাদের আক্রমণগুলো চালায়। অস্ত্রের মধ্যে তাদের কাছে ছিল তলোয়ার, ধনুক, তীর এবং মাস্কেট বন্দুক।[১৯]

১৭৫৭ সালে প্রথম আক্রমণের সময় গোর্খালি বাহিনী ব্যাপকহারে মার খায়। তারা কীর্তিপুরের দিকে অগ্রসর হলে নেওয়াররা সেনাপতি কাজী ধনুবন্তের অধীনে তাদের সম্মুখীন হয়। কীর্তিপুরের উত্তর-পশ্চিমে ট্যাংলা পন্থ-এর সমভূমিতে দুই বাহিনীর মধ্যে এ যুদ্ধ হয়। নেওয়াররা তাদের শহরকে দুর্দান্তভাবে রক্ষা করে। গোর্খালি সেনাপতি কালু পান্ডেকে হত্যা করা হয়, এমনকি স্বয়ং গোর্খালি রাজা সাধুর ছদ্মবেশে কোনক্রমে তার প্রাণ নিয়ে পাশের পাহাড়ে পালিয়ে যান।[২০][২১]

দ্বিতীয় আক্রমণ[সম্পাদনা]

বল প্রয়োগ করে কীর্তিপুর দখলের কোনো আশা না থাকায় শাহ শহরের বাসিন্দাদেরকে অনাহারে রাখার প্রয়াসে অবরোধ আরোপ করেন।[২২] নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাস্তায় যাদেরকে লবণ ও তুলো সহ পাওয়া যেত তাদেরকে হত্যা করা হতো। তা সত্ত্বেও নেওয়াররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

১৭৬৪ সালে শাহ তার ভাই সুরপ্রতাপের সেনাপতিত্বে তার সৈন্যদেরকে দ্বিতীয় বার আক্রমণের আদেশ দেন। এবার গোর্খালিরা রাতে আক্রমণ করে। এবারও কীর্তিপুরের বাসিন্দারা গোর্খালিদেরকে তাড়িয়ে দেয়, তারা শহরের দেয়ালগুলো থেকে আক্রমণকারীদের উপর উপর পাথর নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সুরপ্রতাপের চোখে একটি তীর আঘাত করে, ফলে তিনি অন্ধ হয়ে যান।

তৃতীয় আক্রমণ[সম্পাদনা]

১৭৬৭ সালে গোর্খা রাজা তৃতীয় বারের মতো কীর্তিপুর আক্রমণের আদেশ দেন। এবারও সুরপ্রতাপের সেনাপতিত্বে এ আক্রমণ চালানো হয়। জবাবে নেপালের তিন রাজা সম্মিলিত বাহিনী গঠন করে। এদেরকে কীর্তিপুরের উদ্ধারে পাঠানো হয়, কিন্তু তারা গোর্খালিদেরকে তাদের অবস্থান থেকে হটাতে ব্যর্থ হয়। ধনুবন্ত নামক একজন অভিজাত যিনি ললিতপুর রাজ্যের ছিলেন তিনি স্বীয় দল ত্যাগ করে শাহের পক্ষে যোগ দেন। তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করে গোর্খালিদেরকে শহরে ঢোকার সুযোগ করে দেন।

শহরের আত্মসমর্পণের পর পৃথ্বীনারায়ণ শাহ শহরের বাসিন্দাদের কান ও নাক কেটে ফেলার আদেশ দেন। এই ঘটনাটি খ্রীস্টধর্ম প্রচারকারী ক্যাপুচিন সন্ন্যাসীরা প্রত্যক্ষ করেছেন বলে লেখে গেছেন এবং অন্তত দুটি নেপালি সূত্র থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ইতিহাসবিদ জন ওয়েলপ্টনের মতে, ক্যাপুচিন সন্ন্যাসীদের শাহকে অপছন্দ করার কারণ ছিল, কিন্তু তারা এই ঘটনার বানোয়াট বিবরণ তৈরি করবেন তেমনটা ঘটা অসম্ভব।[২৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৯ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ নভেম্বর ২০২১ 
  2. "Archived copy"। ২০১৭-১২-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-২৯ 
  3. Giuseppe, Father (১৭৯৯)। "Account of the Kingdom of Nepal"Asiatick Researches। London: Vernor and Hood। সংগ্রহের তারিখ ১৮ অক্টোবর ২০১২  Page 308.
  4. Kirkpatrick, Colonel (১৮১১)। An Account of the Kingdom of Nepaul। London: William Miller। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০১২  Pages 381-385.
  5. Giuseppe, Father (১৭৯৯)। "Account of the Kingdom of Nepal"Asiatick Researches। London: Vernor and Hood। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০১২  Pages 316-319.
  6. Waller, Derek J. (২০০৪)। The Pundits: British Exploration Of Tibet And Central Asia। University Press of Kentucky। পৃষ্ঠা 171। আইএসবিএন 978-0-8131-9100-3 
  7. Raj, Yogesh (২০১২)। "Introduction"। Expedition to Nepal Valley: The Journal of Captain Kinloch (August 26-October 17, 1767)। Kathmandu: Jagadamba Prakashan। পৃষ্ঠা 7। আইএসবিএন 978-9937-85180-0 
  8. Northey, William Brook and Morris, Charles John (1928). The Gurkhas: Nepal-Their Manners, Customs and Country. Asian Educational Services. আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৬১৫৭৭-৯. Pages 30-31.
  9. Stiller, Ludwig F. (১৯৬৮)। Prithwinarayan Shah in the light of Dibya Upadesh। Catholic Press। পৃষ্ঠা 39। 
  10. Singh, Nagendra Kr (১৯৯৭)। Nepal: Refugee to Ruler: A Militant Race of Nepal। APH Publishing। পৃষ্ঠা 125। আইএসবিএন 978-81-7024847-7। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৭, ২০১২ 
  11. "The Conquest Of Kantipur"The Rising Nepal (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০২ 
  12. Singh, Nagendra Kr (১৯৯৭)। Nepal: Refugee to Ruler: A Militant Race of Nepal। APH Publishing। পৃষ্ঠা 112। আইএসবিএন 978-81-7024847-7। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৭, ২০১২ 
  13. Raj, Yogesh (২০১২)। "Introduction"। Expedition to Nepal Valley: The Journal of Captain Kinloch (August 26-October 17, 1767)। Kathmandu: Jagadamba Prakashan। পৃষ্ঠা 5। আইএসবিএন 978-9937-85180-0 
  14. Giuseppe, Father (১৭৯৯)। Account of the Kingdom of Nepal। London: Vernor and Hood। পৃষ্ঠা 317। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৭, ২০১২ 
  15. Chatterji, Nandalal (১৯৩৯)। "The First English Expedition to Nepal"। Verelst's Rule in India। Indian Press। পৃষ্ঠা 21। সংগ্রহের তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০১৩ 
  16. Raj, Yogesh (২০১২)। "Introduction"। Expedition to Nepal Valley: The Journal of Captain Kinloch (August 26-October 17, 1767)। Kathmandu: Jagadamba Prakashan। পৃষ্ঠা 13–14। আইএসবিএন 9789937851800 
  17. Raj, Yogesh (২০১২)। "Introduction"। Expedition to Nepal Valley: The Journal of Captain Kinloch (August 26-October 17, 1767)। Kathmandu: Jagadamba Prakashan। পৃষ্ঠা 13–14। আইএসবিএন 9789937851800 
  18. Shrestha, Sanyukta (২৭ জুলাই ২০১২)। "Nepali history from new perspectives"Republica। ২ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০১৩ 
  19. Vansittart, Eden (1896). Notes on Nepal. Asian Educational Services. আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৬-০৭৭৪-৩. Page 34.
  20. Majupuria, Trilok Chandra (মার্চ ২০১১)। "Kirtipur: The Ancient Town on the Hill"Nepal Traveller। ১৭ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ অক্টোবর ২০১২ 
  21. Wright, Daniel (১৯৯০)। History of Nepal। New Delhi: Asian Educational Services। সংগ্রহের তারিখ ৭ নভেম্বর ২০১২  Page 227.
  22. Raj, Yogesh (2012). Expedition to Nepal Valley: The Journal of Captain Kinloch (August 26-October 17, 1767). Kathmandu: Jagadamba Prakashan. আইএসবিএন ৯৭৮-৯৯৩৭-৮৫১৮০-০.
  23. Whelpton, John (২০০৫)। A History of Nepal। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 38। আইএসবিএন 9780521804707