ফালুং গং

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ফালুং গং
ফালুং দাফা প্রতীক
ঐতিহ্যবাহী চীনা 法輪功
সরলীকৃত চীনা 法轮功
আক্ষরিক অর্থধর্ম চাকা অনুশীলন বা ধর্ম চাকা কাজ/ক্ষমতা/শক্তি
ফালুং দাফা
ঐতিহ্যবাহী চীনা 法輪大法
সরলীকৃত চীনা 法轮大法
আক্ষরিক অর্থমহান ধর্ম চাকা অনুশীলন

ফালুং গং (ইউকে: /ˌfɑːlʊn ˈɡɒŋ, ˌfæl-, - ˈɡʊŋ/, ইউএস: /- ˈɡɔːŋ/)[১] or ফালুং দাফা (/ˈdɑːfə/; স্ট্যান্ডার্ড ম্যান্ডারিন চীনা: [fɑ̀lǔn tɑ̂fɑ̀]; আক্ষরিক অর্থে, "ধর্ম চাকা অনুশীলন" অথবা "আইন চাকা অনুশীলন") এটি এক ধরনের শরীরচর্চা । এটি সনাতনি যোগ সাধনা পদ্ধতির একটি ফর্ম ছিল। চীনের মূল ভূখণ্ডের নিষিদ্ধ হয়েছিল এই ফালুন গং। প্রকৃতপক্ষে ফালুন গং হলো শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ এর সাথে সাথে বিশেষ ভাবে হাত পা চালিয়ে এক শরীর চর্চা । এর ফলে শরীর স্বাস্থ্য ভালো হয় সেইসঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তি মনোবৃত্তি ও আধ্যাত্মিক চেতনার উন্নতি। হয় এই শরীর চর্চা উদ্ভাবকের নাম লি হংঝি।

এটি একটি নতুন ধর্মীয় আন্দোলনও.[২][৩][৪][৫][৬][৭][৮] ১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে চীনের আইটিস নেতা লি হংঝি ফালুং গং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । বর্তমানে ফালুং গং একটি অনানুষ্ঠানিক সদর দপ্তর , ড্রাগন স্প্রিংস, একটি ৪০০ একর প্রাঙ্গণ নিউইয়র্কের ডেরপার্কের ক্যাডাব্যাকভ্যালির হ্যামলেটের চারপাশে লি হংঝিরের বর্তমান বাসভবনের কাছে অবস্থিত । ১৯৯২ সালে ফালুং গং এর উথান ঘটে। ১৯৯৯ সালের ২২ জুলাই চীন সরকার ফালুং গং আন্দোলন নিষিদ্ধ ঘােষণা করে ।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে লি হংঝি নিউইয়র্কের বাসিন্দা ছিলেন। তখন চীনা নাগরিকদের মধ্যে দ্রুত এই যোগ সাধনা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে । ১৯৯৪ সালে সমগ্র চিনে এর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র কুড়ি লক্ষ। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে তা ১৯৯৯ সালের ১০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে , সে সময় আইন করে ধর্মাচরণ বন্ধ করে দেবার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই সময় জমা হয়েছিল দারুন এক আধ্যাত্মিক ক্ষুধা। সেই ক্ষুদা মেটাতে এই দলে দলে মানুষ এই সময় ফালুন গং এর লাল হলুদ পতাকার তলায় এসে জড়ো হয় । এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট চৈনিক শিক্ষাবিদ শিন মিং (Shin Ming) বলেছেন, “চীনের বর্তমান আর্থিক অগ্রগতির পিছনে লুকিয়ে আছে নানাভাবে বিধস্ত, বিষন্ন, লক্ষহীন চীনা সমাজ এবং কমিউনিসম এর মত অচেনা তথ্য জোর করে চাপিয়ে দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা চীনের সনাতন, সংস্কৃতি মূল্যবোধ এবং সামাজিক ও আর্থিক সংস্কার কে। হারিয়ে গিয়েছে চীনের মূল চরিত্র। এই কারনে ফালুন গং জনগণকে আকৃষ্ট করেছে । এর মধ্য দিয়ে তারা আত্মার মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছে। খুঁজে পাচ্ছে সনাতন মূল্যবোধ।” কিন্তু ফালুন গং এর এই অভাবনীয় উত্থান চীনা কমিউনিস্ট সরকার কে অসম্ভব ভীত করে তুলেছিল । এদের সব থেকে বড় ভয়ের কারণ ছিল এ ১০ কোটি সদস্য সংখ্যা । চীন সরকার উপলব্ধি করেছিল যে এই ১০ কোটি সদস্য যে কোন সময় চীনা সরকারকে উৎখাত করতে পারে । তাই নেতারা ও সরকারি খবরের কাগজ গুলো প্রচার করতে শুরু করল ফালুন গং হলো একটি চক্রান্ত। ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হলো ও সেই কমিশনের লোক ফালুন গং সদস্য হয়ে তার ভিতরে ঢুকে পড়ে তাদের গোপনে কথা বাত্রা রেকর্ড শুরু করলো। সরকারের এই কাজের প্রতিবাদ জানাতে ১৯৯৯ সালের ২৫ এপ্রিল কুড়ি হাজার ফালুন গং সদস্য বেজিং এর সদর দপ্তর জনসমাবেশ করল । এই সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াং জেমিন গাড়ি থেকে গোপনে সেই জনসমাবেশ প্রত্যক্ষ করলেন , বললেন, ” সত্যিই এক ভয়ংকর আন্দোলন এবং সরকার এর থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না …” এর ফলশ্রুতি হিসেবে ২২ তারিখ জুলাই মাসে ফালুন গং কে নিষিদ্ধ করা হল ও একে ডাকিনীবিদ্যা বলে ঘোষণা করা হলো ।শুরু হলো ব্যাপকভাবে ধরপাকড় ও দমন-পীড়ন। প্রত্যেক শহরে ফাগুন গঙ কর্মকর্তা থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। তাদের বই পুস্তককে বাজেয়াপ্ত করা হলো । গুরু লি কে অপরাধী ঘোষণা করা হলো এবং আমেরিকায় তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য ইন্টারপোলের সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। বেজিংয়ের ঘর বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে যেসব বই উদ্ধার করা হয়েছিল সেগুলো সব একত্র করে পুড়িয়ে ফেলা হয় । বেজিংয়ে সহ সমস্ত শহরে সদস্যদের ধরে এনে খোলা আকাশের নিচে স্টেডিয়ামগুলোতে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়েছিল। ভবিষ্যতে কোনদিন ফালুন গং শরীর চর্চা করবেন না এরকম লেখা দিয়ে তারা মুক্তি পেয়েছিল। যারা মুচলেকা দিতে চায়নি তাদের কে অকথ্য অত্যাচার করে চীনের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হয় । কয়েক হাজার প্রধান কর্মকর্তাকে বেদম প্রহার করার পর কোন এক অজ্ঞাত কারণে গুম করে দেওয়া হয় । বেজিং ও অন্যান্য শহরগুলিতে রাস্তায় রাস্তায় সাধারণ মানুষকে পুলিশ খানা তল্লাশি করে হয়রান করতে থাকলো । এ পর্যন্ত ১২০ জন সদস্যকে পুলিশ হাজতে হত্যা করেছিল । বেশ কয়েক হাজার কর্মকর্তা নিখোঁজ ও বেশ কয়েক লক্ষ সদস্য এখনো জেল খাটছে বলে ফালুন গং দের তরফে দাবি করা হয়। এসব ঘটনা থেকেই প্রমাণ হয় যে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলি যে কমিউনিস্টরা ভারতবর্ষে চিৎকার করে থাকে সেই ব্যক্তি স্বাধীনতা আসলে কোন কমিউনিস্ট দেশে নেই । এই ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ শিন মিং , “এ ধরনের দমন-পীড়ন হল এক আহাম্মকের নীতি । এর ফলে সরকারের জন্য কোটি কোটি শত্রু জন্মাচ্ছে। যারা আগে মিত্র ছিল তারাও শত্রুতে পরিণত হয়েছে । “ কিন্তু এই বর্বর দমন-পীড়ন চালিয়ে সরকারের পক্ষে আজ অব্দি এরকম কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করা যায়নি যে ফালুন গং হলো একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত , কমিউনিজমকে (Communism) উৎখাত করা যার উদ্দেশ্য। অথচ তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি বা দমন-পীড়ন বন্ধ করা হয় নি।

চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা জিনহুয়ার খবর অনুসারে গত ২০০১ সালের ২৩ শে জানুয়ারি বেজিং শহরের তিয়া – নান – মেন স্কোয়ারে ফালুন গং মতাদর্শে বিশ্বাসী পাঁচজন সদস্য গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতির চেষ্টা করেছিল । ওই দিন দুপুর দুটো চল্লিশ মিনিটে চারজন মহিলা ও একজন পুরুষ ফালুন গং সদস্য গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয়। একজন মহিলার ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় । বাকিদের পুলিশ উদ্ধার করে । এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে বিগত বেশ কিছু বছর ধরে চীন  সরকার তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে আসছিল এবং তার প্রতিকার জানাতেই আত্মোৎসর্গের করুন পথ বেছে নেওয়া। এর আগে, ১৩ ই জানুয়ারি কুড়ি হাজার সদস্যকে হংকংয়ের ভিক্টোরিয়া পার্কে সরকারের বিরুদ্ধে সমবেত হয়ে ধিক্কার জানিয়েছিল । এছাড়াও তারা হং কং সিটি হলে একটি সভা ও করেছিল ।সেই সভায় ফালুন গং এর উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার তারা নানা দাবি জানিয়েছিল এবং জুলুম বন্ধ করতে রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হস্তক্ষেপের দাবি করেছিল । প্রকৃত সত্য হলো মানুষের ব্যক্তি চিন্তা বাক স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকার করলে মার্কসবাদী তত্ত্ব লুপ্ত হয়। কমিউনিস্ট সরকার বা শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে এই কারণে হয়তো।

উৎপত্তি[সম্পাদনা]

ফালুন গং প্রায়শই চীনের আধ্যাত্মিক আন্দোলন কিগং আন্দোলনের সাথে মিল করা হয়। কিগং একটি আধুনিক আখ্যা যা ধীর গতির ব্যায়াম, ধ্যান, এবং নিয়ন্ত্রিত শ্বাসের সাথে জড়িত বিভিন্ন ধরনের অনুশীলনকে বোঝায়। ফালুন গং এর মধ্যে মূল তত্ত্ব হলো হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রের কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্ব ।শক্তি চক্রের কথা এখানে বলা হয়েছে এবং শক্তি চক্র উদ্দীপিত হলে মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ ঘটে । খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সন্ন্যাসীরা কুংফু ক্যারাটে মতো শরীর বিদ্যা গুলির সঙ্গে সঙ্গেই কুলকুণ্ডলিনী জাগরন এর তথ্যও তিব্বতে নিয়ে গিয়েছিলেন । তাই লি লিখেছিলেন “শাক্য সিংহ বুদ্ধের কর্মবাদ এবং অন্তিম লক্ষ্য হলো বোধি জ্ঞান লাভ করা এবং ফালুন গং তত্ত্বের ভিত্তি হলো সেই বোধি।”

বিশ্বাস এবং অনুশীলন[সম্পাদনা]

কেন্দ্রীয় শিক্ষা[সম্পাদনা]

নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে ফালুং গং এর ধ্যান

ফালুন গং নৈতিক যথার্থতা এবং ব্যায়াম ও ধ্যানের অনুশীলনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে আরোহণ করতে করতে ইচ্ছুক।

গ্রন্থসমূহ[সম্পাদনা]

লি হংঝি ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে ফালুন গং শিক্ষাগুলির প্রথম বইটি লেখেন: চীন ফালুন গং বা কেবল ফ্যালুন গং। এটি একটি প্রারম্ভিক পাঠ্য যা কিগং, ফালুন গং এর বৌদ্ধধর্মের সাথে সম্পর্ক ও চাষের নীতিগুলি নিয়ে আলোচনা করে। তিনি ফালুং গং বিষয়ে অনেক পুস্তক রচনা করেছিলেন। তার মতে এই শরীরচর্চা যে নিষ্ঠা সহকারে করবে তার মধ্যে এক দিব্য প্রশান্তি আসবে ও সে সম্পূর্ণ ভয় শূণ্য হবে। চীনের কমিউনিস্ট নেতারা যোগ বিদ্যাকে ডাইনীবিদ্যা বলে এবং সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর বলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ব্যক্তি স্বাধীনতা কে স্বীকার করলে অস্তিত্ব সংকট সূচিত হয় কমিউনিসমের। তাসের ঘরের মত ভেঙে যায়। এই কারনেই তিব্বতে বৌদ্ধ দের নানাভাবে উৎপীড়ন করে চলেছিল। সেখানকার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে তাদের হত্যা করে । ঠিক এই উপরক্ত একই কারণে চীনের মাক্সবাদী সরকার ১৯৮৯ সালের ৪ঠা জুন তিয়েনআনমেন (Tienanmen) চত্বরে হাজার হাজার গণতন্ত্রকামী ছাত্রকে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে ও ট্যাঙ্ক দিয়ে পিসে পৈশাচিক নরমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিল। এবং এই কারণেই ১৯৯৯ সালের ২২ শে জুলাই চীনের কমিউনিস্ট সরকার ফালুন গং আধ্যাত্বিক শরীরচর্চা কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং তার অনুসরণকারীদের ওপর বর্বর দমন-পীড়ন শুরু করে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Wells, John C. (২০০৮), Longman Pronunciation Dictionary (3rd সংস্করণ), Longman, আইএসবিএন 978-1405881180 
  2. Junker, Andrew. 2019. Becoming Activists in Global China: Social Movements in the Chinese Diaspora, pp. 23–24, 33, 119, 207. Cambridge University Press. আইএসবিএন ৯৭৮-১১০৮৬৫৫৮৯৭
  3. Barker, Eileen. 2016. Revisionism and Diversification in New Religious Movements, cf. 142–43. Taylor & Francis. আইএসবিএন ৯৭৮-১৩১৭০৬৩৬১২
  4. Oliver, Paul. 2012. New Religious Movements: A Guide for the Perplexed, pp. 81–84. Bloomsbury Academic. আইএসবিএন ৯৭৮১৪৪১১২৫৫৩৮
  5. Hexham, Irving. 2009. Pocket Dictionary of New Religious Movements, pp. 49, 71. InterVarsity Press. আইএসবিএন ৯৭৮-০৮৩০৮৭৬৫২৫
  6. Clarke, Peter. 2004. Encyclopedia of New Religious Movements. Taylor & Francis. আইএসবিএন ৯৭৮-১১৩৪৪৯৯৬৯৪
  7. Partridge, Christopher. 2004. Encyclopedia of New Religions: New Religious Movements, Sects and Alternative Spiritualities, 265–66. Lion. আইএসবিএন ৯৭৮-০৭৪৫৯৫০৭৩০.
  8. Ownby, David. 2005. "The Falun Gong: A New Religious Movement in Post-Mao China" in Lewis, James R. & Jesper Aagaard. Editors. Controversial New Religions, 195–96. Oxford University Press.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]